বায়ু দূষণের ফলে শুধু মানুষ নয়, উদ্ভিদের স্বাস্থ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ যেমন ওজোন গ্যাস ধানগাছের ফলন কমিয়ে দেয়৷ জার্মান বিজ্ঞানীরা ক্রস-ব্রিডিং-এর মাধ্যমে এই সমস্যার এক সাময়িক সমাধান খুঁজে পেয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
এশিয়ার অনেক দেশে জীবাশ্মভিত্তিক জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বায়ু দূষণ বেড়ে চলেছে৷ বিশেষ করে ওজোন একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ চীন ও ভারতে এই সমস্যা এত বেড়ে গেছে যে, ধান উৎপাদনের উপর তার কুপ্রভাব পড়ছে৷ এক্ষেত্রে আয় প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে৷ কোটি কোটি মানুষের জন্য এটা মারাত্মক এক সমস্যা৷
বন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিবিজ্ঞানীরা কয়েক'শ ধানের প্রজাতির উপর ওজোন-এর প্রভাব নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন৷ গোটা বিশ্বে এর আগে এত বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ অধ্যাপক মিশায়েল ফ্রাই বললেন, ‘‘গত বছর আমরা গোটা বিশ্বের ৩২৮টি প্রজাতির ধান পরীক্ষা করেছি৷ তাদের ওজোন সহ্য করার ক্ষমতায় বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা গেছে৷ কয়েকটি প্রজাতি কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি৷ কয়েকটির ক্ষেত্রে উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে৷''
ঢাকায় বায়ু দূষণে মরছে বছরে ১৫ হাজার মানুষ
প্রায়ই ঢাকা শহরের উপরে ভেসে বেড়ায় কুয়াশা ও ধোঁয়ার মিশ্রণ বা স্মগ৷ আর শুধু বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর মারা যায় শহরটির ১৫ হাজার মানুষ৷ তবে শুধু ঢাকা নয়, আরো অনেক শহরের অবস্থা এমন৷ দেখুন এখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উলান বাটর, মঙ্গোলিয়া
উলান বাটর শুধুমাত্র বিশ্বের সবচেয়ে ঠান্ডা রাজধানী নয়, এটি চরম বায়ু দূষণের শিকারও৷ শীতের মাসগুলোতে টেসিগি-র তাঁবুগুলো গরম রাখতে কয়লা এবং কাঠ ব্যবহার করা হয়, যা শহরের সত্তর শতাংশ স্মোগের কারণ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ সীমার চেয়ে সাতগুন বেশি দূষিত উলান বাটরের বাতাস৷
ছবি: DW/Robert Richter
বেইজিং, চীন
চীনের রাজধানী স্মগে এতই ক্ষতিগ্রস্ত যে বিজ্ঞানীদের মতে, শহরটি বসবাসের প্রায় অনুপযোগী৷ তাসত্ত্বেও দুই কোটি মানুষ বাস করে সেখানে৷ ধারণা করা হয়, বিশ্বে প্রতিবছর ৩৫ লাখ মানুষ বায়ু দূষণের কারণে মারা যায়, যাদের মধ্যে অর্ধেকই চীনের বাসিন্দা৷
ছবি: picture alliance/Photoshot
লাহোর, পাকিস্তান
পরিবেশ নিয়ে পাকিস্তানের উদ্বেগগুলোর মধ্যে অন্যতম বায়ু দূষণ৷ দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর করাচির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়৷ শহরটিতে স্মগের মূল কারণগুলো হচ্ছে রাস্তায় অনেক যান চলাচল, ময়লা পোড়ানো এবং আশেপাশের মরুভূমি থেকে আসা ধূলিকণা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নতুন দিল্লি, ভারত
ভারতের রাজধানী নতুন দিল্লিতে কারের সংখ্যা গত ৩০ বছরে এক লাখ ৮০ হাজার থেকে ৩৫ লাখে পৌঁছেছে৷ তাসত্ত্বেও অবশ্য সেখানে স্মগের সবচেয়ে বড় কারণ কয়লাচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র৷ শহরের দূষিত বায়ুর ৮০ শতাংশের উৎসই এগুলো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রিয়াদ, সৌদি আরব
রিয়াদে ধুলিঝড় স্মগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ৷ কেননা এটি বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কায়রো, মিশর
কায়রোর দূষিত বাতাস শহরের বাসিন্দাদের অনেক রোগের কারণ৷ বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসযন্ত্রের নানাবিধ সমস্যাসহ ফুসফুসে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে৷ শিল্প উন্নয়ন এবং রাস্তায় যানবাহনের বাড়তি উপস্থিতি দূষণের কারণ৷
ছবি: DW Akademie/J. Rahe
ঢাকা, বাংলাদেশ
জার্মানির মাইনৎস শহরের ম্যাক্স-প্লান্ক ইন্সটিটিউট-এর এক গবেষণা অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে ঢাকায় বছরে মারা যায় ১৫ হাজার মানুষ৷ গবেষকরা ঢাকার বাতাসে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মস্কো, রাশিয়া
বাহ্যিকভাবে একই মনে হলে শহর ভেদে স্মগের ধরন আলাদা৷ যেমন মস্কোর বাতাসে হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি অনেক বেশি৷ আর এই দূষণের মধ্যে শহরের পশ্চিমাঞ্চলের বাতাস তুলনামূলকভাবে ভালো৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো
ভৌগোলিক কারণে মেক্সিকো সিটির স্মগ বিপজ্জনক৷ বাতাসে সালিফার ডাই-অক্সাইড এবং হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতির কারণে দীর্ঘসময় শহরটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল৷ কিছু ফ্যাক্টরি বন্ধ করায় এবং যান চলাচল নীতিতে পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি এখন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
ওজোন এক রংহীন, আগ্রাসী গ্যাস৷ গাড়ির ধোঁয়া সহ নানা কারণে তা সৃষ্টি হয়৷ এর মাত্রা বেশি হলে তা মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদের জন্য বিষাক্ত হয়ে ওঠে৷ বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিশায়েল ফ্রাই বলেন, ‘‘উদ্ভিদের টিস্যু ভেঙে এমন অণু তৈরি হয়, যার মধ্যে একটি ইলেকট্রনের অভাব রয়েছে৷ তখন সেই অণু অন্য অণু থেকে ইলেকট্রন টেনে নেয়৷ ফলে তন্তুর ক্ষতি হয় – যেমন মেমব্রেন, প্রোটিন, ডিএনএ৷ ফলে উদ্ভিদের টিস্যুর অপূরণীয় ক্ষতি হয়৷''
বন শহরের গ্রিনহাউসে এই পরীক্ষামূলক উদ্ভিদগুলির জন্য এশিয়ার উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে৷ ধান চাষ করতে হলে উত্তাপ ও আর্দ্রতার প্রয়োজন৷ ওজোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ ওজোনের ওজন যেহেতু বাতাসের চেয়ে বেশি, তাই বাক্সের উপর দিক খোলা থাকতে পারে৷ ক্ষতিগ্রস্ত উদ্ভিদের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে৷ অধ্যাপক ফ্রাই বলেন, ‘‘এখানে ওজোনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ধানের গাছ দেখা যাচ্ছে৷ হালকা সবুজ রংয়ের পাতা ক্ষতির মাত্রা দেখিয়ে দিচ্ছে৷ একে ক্লোরোসেন বলা হয়৷ ওজোনের চাপে ক্লোরোফিল বা পাতার সবুজ অংশ নষ্ট হয়ে গেলে এমন লক্ষণ দেখা যায়৷ এটা উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর, কারণ সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার জন্য ক্লোরোফিল প্রয়োজন হয়৷ ফলে উদ্ভিদের শক্তি কমে যায়৷ সেটি আরও কম পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড কার্বোহাইড্রেটে পরিণত করতে পারে৷''
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্ষম ধান
বাংলাদেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে নানাভাবে৷ কৃষিও রয়েছে এর মধ্যে৷ তবে আশার কথা, এই প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম কিছু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
বাংলাদেশেই উদ্ভব
বাংলাদেশের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে নানাভাবে৷ কৃষিক্ষেত্রও এর মধ্যে রয়েছে৷ তবে আশার কথা, এই প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম কিছু ধানের জাত উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, ব্রি-র মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস৷
ছবি: N.Nanu/AFP/Getty Images
লবণাক্ততা
উপকূলীয় অঞ্চলে যেখানে জমিতে লবণের পরিমাণ বেশি সেখানে রোপা আমন মৌসুমে ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৪১, ব্রি ধান৫৩ ও ব্রি ধান৫৪ – এই চারটি জাত বেশ কার্যকর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বোরো ধান
লবণাক্ত পরিবেশে জন্মানোর জন্য বোরো ধানের জাতের মধ্যে রয়েছে ব্রি ধান৪৭ এবং ব্রি ধান৬১৷
ছবি: CC/Rishwanth Jayaraj
খরা
খরা মোকাবিলায় সক্ষম দুটো উন্নত জাত হলো ব্রি ধান৫৬ এবং ব্রি ধান৫৭ – দুটোই রোপা আমন ধানের জাত৷ ‘‘আরও কিছু নতুন জাত আমাদের হাতে আছে যেগুলো খরায় আরও ভালো করবে,’’ জানিয়েছেন ব্রি মহাপরিচালক৷
ছবি: AP
হঠাৎ বন্যা
ড. বিশ্বাস বলেন, রোপা আমন মৌসুমে আরেকটি পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন ধান লাগানোর পরে দেখা যায় যে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে হঠাৎ করেই পানির নীচে ডুবে যায়৷ ‘‘এই অবস্থা প্রায় সপ্তাহখানেক বা তারও বেশি সময় ধরে থাকে৷ এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রয়েছে ব্রি ধান৫১ ও ব্রি ধান৫২৷’’
ছবি: N.Nanu/AFP/Getty Images
অতি ঠান্ডা, অতি গরম
এই পরিস্থিতির জন্য এখনো কোনো ভালো জাত নেই৷ তবে ব্রি মহাপরিচালক বলেছেন, ‘‘গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে চলছে এবং আমরা আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে এমন ধানের জাত আমরা হাতে পেয়ে যাব৷’’
ছবি: DW/P. Mani Tewari
প্রচারণা
সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে কৃষকদের ব্রি উদ্ভাবিত এসব জাত সম্পর্কে জানানো হয়৷
ছবি: FARJANA K. GODHULY/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ ওজোন শুধু ধান উৎপাদন কমিয়ে দেয় না, চালের মানেরও অবনতি ঘটায়৷ কার্বোহাইড্রেটের অভাবের ফলে ধানের চেহারাও খারাপ হয়৷ অধ্যাপক ফ্রাই বলেন, ‘‘বিশেষ করে এশিয়ার মানুষ স্বচ্ছ চাল পছন্দ করেন, যা দেখতেও সুন্দর৷ কিন্তু কার্বোহাইড্রেটের অভাবে ওজোন বিশ্রী সাদা দাগ সৃষ্টি করে৷ ফলে সেই চাল কেউ কেনে না অথবা অনেক কম দামে তা বিক্রি করতে হয়৷''
বন শহরের বিজ্ঞানীরা ধানের জিনোমের মধ্যে এমন জিন খুঁজছিলেন, যা ওজোনের বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতা বাড়াতে পারে৷ তাঁরা এ কাজে সফল হয়েছেন৷ তারপর তাঁরা সুপরিকল্পিতভাবে সেই জিন উৎপাদনশীল অথচ ওজোনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় – এমন ধানের গাছে ‘ক্রস-ব্রিড' করে দেন৷ ফলে সেই ধানের বীজ অনেক ভালোভাবে ওজোনের প্রভাব সামলাতে পারছে৷ দেখতেও অনেক ভালো লাগছে৷ অধ্যাপক ফ্রাই বলেন, ‘‘এখানে হালকা সবুজ ক্লোরোটিক পাতা কম দেখা যাচ্ছে৷ এক্ষেত্রে সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার মাত্রাও তুলনামূলকভাবে বেশি৷ তাছাড়া আমরা দেখেছি যে, এই প্রজাতির ক্ষেত্রে জিনের ক্রস-ব্রিডিং করার ফলে ক্ষতির মাত্রা প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব৷
ওজোন সহ্য করতে পারে, ধানের এমন প্রজাতি কিছুকালের জন্য ভালো ফসল দিতে পারে বটে, কিন্তু ব্রিডিং-এর মাধ্যমে নতুন প্রজাতির ধান তৈরি করা এই সমস্যা সমাধানের আদর্শ উপায় হতে পারে না৷ দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে এশিয়ায় বায়ু দূষণের মোকাবিলা করতে হবে, যাতে ওজোনের ঘনত্বও কমে যায়৷ তখন কোটি কোটি মানুষের খাদ্যসংস্থান নিরাপদ হয়ে যাবে৷