উৎসবের মরশুমে পশ্চিমবঙ্গে আতসবাজির চাহিদা বাড়ে৷ এবং সেই সূত্রে উঠে আসে এক বিপজ্জনক সমাজচিত্র৷ বোঝা যায়, ওদের প্রাণের বিনিময়ে রোশন হয় আমাদের উৎসব৷
বিজ্ঞাপন
ক'দিন আগের ঘটনা৷ শহরের উপকণ্ঠে বারাসতের দত্তপুকুর এলাকায় একটি বাড়িতে বেআইনি বাজি তৈরি করার সময় বিস্ফোরণ ঘটে মারা যায় নবম শ্রেণির ছাত্র একটি ১৭ বছরের ছেলে৷ বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে পাড়ার লোক ওই বাড়িটিতে গিয়ে দেখেন ঘরের ভেতরে আগুন জ্বলছে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ৷ কোনোমতে দরজা ভেঙে তাঁরা ওই কিশোরকে উদ্ধার করেন৷ কিন্তু ততক্ষণে এমনভাবে আগুনে ঝলসে গিয়েছিল সে, যে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি৷ এই ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, দত্তপুকুর এলাকায় শুধু ওই একটি বাড়ি নয়, অনেক বাড়িতেই উৎসবের আগে এরকম বেআইনি বাজি বানানোর কাজ হয়৷ বসত এলাকায় যা অত্যন্ত বিপজ্জনক৷
সামান্য দুর্ঘটনা থেকেই বহু মানুষের প্রাণসংশয় হতে পারে৷ এবং তেমন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাও যথেষ্ট৷ কারণ, বাজি কারখানার জন্যে সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়ম–বিধি কিছুই পালিত হয় না এইসব গোপন বাজি কারখানায়৷ থাকে না আগুন নেভানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা৷ ফলে প্রতি বছরই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানি হয়৷
এক্ষেত্রে আরেকটা মারাত্মক ঘটনা নিয়মিত ঘটে চলে৷ যখনই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, দেখা যায় হতাহতদের মধ্যে অনেক কমবয়সি ছেলে–মেয়েও থাকে৷ উপরি রোজগারের লোভ দেখিয়ে, কিন্তু কম মজুরিতে অদক্ষ এই ছেলে–মেয়েদের বাজি তৈরির কাজে লাগানো হয়৷ দত্তপুকুরের দুর্ঘটনাতেই যেমন, প্রতিবেশী কিশোরকে মাত্র ১৫০ টাকা মজুরির টোপ দিয়ে বাজি তৈরিতে লাগানো হয়েছিল, যার সে কাজে কোনো দক্ষতা, বা অভিজ্ঞতা ছিল না এবং পাছে সে কাজে ফাঁকি মারে, ঘরের বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে যাওয়া হয়েছিল৷
মাত্র কয়েক টাকার জন্য
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরকে খনি, কারখানা ও কৃষিখাতের বিভিন্ন চরম প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ
১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও-র সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে৷ সেখানে ১৮ বছরের কমবয়সি শিশু-কিশোরদের শ্রমিক কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর বিষয়টি নিষিদ্ধ করা হয়৷
ছবি: imago/Michael Westermann
তোয়ালে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে তোয়ালে তৈরির কারখানায় কাজ করে এই শিশুটি৷ আইএলও-র হিসাবে এশিয়ায় প্রায় সাত কোটি ৮০ লাখ শিশু কাজ করছে৷ অর্থাৎ ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশু-কিশোরের প্রায় ১০ শতাংশ কাজেকর্মে নিয়োজিত৷
ছবি: imago/imagebroker
দিনে ৬৫ টাকা
লেখাপড়ার পরিবর্তে এই শিশুটি ইট তৈরি করছে৷ চরিম দরিদ্রতার কারণে ভারতের অনেক পরিবার তাদের শিশুদের কাজে পাঠিয়ে থাকে৷ দিন প্রতি মাত্র ৮০ সেন্ট, অর্থাৎ প্রায় ৬৫ বাংলাদেশি টাকা পায় তারা৷ এ জন্য তাদের কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়৷
ছবি: imago/Eastnews
সস্তা শ্রম
ভারতের সবশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী, দেশটিতে প্রায় এক কোটি ২৬ লাখ শিশু-কিশোর শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে৷ তারা পণ্য বিক্রি থেকে শুরু করে রান্না করা, রেস্টুরেন্ট পরিষ্কার করা – সব কাজই করে৷ এমনকি ইট কাটা, মাঠে তুলা তোলা ইত্যাদি কাজও করে থাকে শিশুরা৷
ছবি: imago/imagebroker
অমানবিক অবস্থা
২০১৩ সালে প্রকাশিত আইএলও-র একটি প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের শিশু শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেক বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে৷ তাদের অধিকাংশকেই কোনোরকম চুক্তিপত্র ও চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই কাজ করতে হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
‘মেড ইন বাংলাদেশ’
জাতিসংঘের শিশু কল্যাণ সংস্থা ইউনিসেফ-এর হিসাবে, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ লক্ষ শিশু-কিশোর তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে৷
ছবি: imago/Michael Westermann
কম্বোডিয়ার পরিস্থিতি
কম্বোডিয়ায় স্কুল পড়ুয়া শিশু-কিশোরের সংখ্যা অনেক কম৷ বেশিরভাগই তাদের মা-বাবার সঙ্গে কাজ করে৷ এছাড়া হাজার হাজার শিশু রাস্তায় বাস করে কম্বোডিয়ায়৷ এই যেমন এই শিশুটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি
২০০০ সালের পর বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও এশিয়ার অনেক দেশ যেমন বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপাল, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারে পরিস্থিতির এখনও ততটা উন্নতি হয়নি৷
ছবি: AFP/Getty Images
8 ছবি1 | 8
পশ্চিমবঙ্গে সব থেকে বেশি আতসবাজি তৈরি হয় মেদিনীপুর জেলায় এবং প্রায় সবই বেআইনি বাজি কারখানা৷ ঘন জনবসতি এলাকায়৷ বছরের বাকি সময় এই জেলার বাসিন্দারা কৃষিকাজ, পশুপালন, পাইকারি ব্যবসায় ব্যস্ত থাকলেও উৎসবের আগে গোটা এলাকাজুড়ে ঘরে ঘরে বাজি তৈরি হয়৷ ছেলে–বুড়ো হাত লাগায় বাজি তৈরিতে, এমনকি ঘরের মেয়েরাও৷ অনেক মহিলাই কাজের সময় নিজেদের শিশুদের সঙ্গে রাখেন৷ কার্যত বারুদের স্তুপের ওপর বসে থাকে এখানকার সবকটি পরিবার৷
বেশিরভাগই মুসলিম প্রধান গ্রাম, গরিব৷ আতসবাজি তৈরি তাদের কাছে বাড়তি রোজগারের এক বাড়তি সুযোগ৷ প্রশাসন এই আতসবাজি তৈরির বেআইনি কারবার বন্ধে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয় না৷ মাঝে মধ্যে পুলিস ‘রেইড' করে বটে, কিন্তু বোঝা যায়, তা অনেকটা দায়সারা৷
ক্যামেরার চোখে বাংলাদেশে শিশু শ্রম
বাংলাদেশে ৪৫ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত৷ তাদের মধ্যে ১৭ লাখের বেশি আবার কাজ করে রাজধানী ঢাকায়৷ আমাদের আলোকচিত্রী মুস্তাফিজ মামুন শিশুশ্রমের কিছু চিত্র তুলে এনেছেন আপনাদের জন্য৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বেলুন কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের একটি বেলুন তৈরির কারখানায় কাজ করছে দশ বছরের এক শিশু৷ সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত, যার প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক খোদ রাজধানীতেই৷
ছবি: Mustafiz Mamun
নেই কোনো নজরদারি
কামরাঙ্গীর চরের এই বেলুন কারখানায় খোলামেলাভাবে নানা ধরনের রাসায়নিকের মাঝে কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ বাংলাদেশ সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ৩৮টি কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করলেও আদতে তা মানা হচ্ছে না৷ সরকারিভাবে নেই কোনো নজরদারির ব্যবস্থা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সিংহভাগই শিশু শ্রমিক
ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে কমপক্ষে দশটি বেলুন তৈরির কারখানা আছে, যেগুলোর সিংহভাগেই শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সড়ক থেকে একটু আড়ালে ভেতরের দিকেই কাজ করানো হয় শিশুদের৷ সপ্তাহে সাত দিনই সকাল-সন্ধ্যা কাজ করতে হয় তাদের৷ তবে শুক্রবারে আধাবেলা ছুটি মেলে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে সিলভারের তৈজসপত্র তৈরির কারখানায় কাজ করে শিশু শ্রমিক আলী হোসেন৷ মারাত্মক উচ্চ শব্দের মধ্যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয় তাকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ট্যানারি কারখানায় শিশু শ্রমিক
ঢাকার হাজারীবাগের একটি ট্যানারি কারখানায় বাইরে কাজ করে নোয়াখালীর আসিফ৷ বয়স মাত্র বারো৷ রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শুকানোর কাজ করে সে৷ দিনে ১২ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে সামান্য যে মজুরি পায় তা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সাহায্য করে আসিফ৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মায়ের সঙ্গে রাব্বি
কামরাঙ্গীর চরের একটি প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে মায়ের সঙ্গে কাজ করে চাঁদপুরের রাব্বি৷ এই কেন্দ্রের মালিক নাকি শিশু শ্রমিক নিয়োগের বিরোধী৷ মায়ের অনুরোধে রাব্বিকে কাজ দেয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর৷ কারণ রাব্বির মা সারাদিন খেটে যে মজুরি পান তাতে সংসার চলে না৷ সংসার চালাতে তাই কাজ করতে হচ্ছে রাব্বিকে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
হিউম্যান হলারে শিশু হেল্পার
ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী হিউম্যান হলারগুলোতে শিশু শ্রমিক চোখে পড়ার মতো৷ বাহনগুলো দরজায় ঝুলে ঝুলে কাজ করতে হয় এ সব শিশুদের৷ চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকারও হয় এসব শিশুরা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ব্রিক ফিল্ডে শিশুরা
ঢাকার আমিন বাজারের বিভিন্ন ব্রিক ফিল্ডেও কাজ করে শিশু শ্রমিকরা৷ প্রতি হাজার ইট বহন করে পারিশ্রমিক পায় ১০০-১২০ টাকা৷ একটি কাঁচা ইটের ওজন কমপক্ষে তিন কেজি৷ একেকটি শিশু ৬ থেকে ১৬টি ইট এক-একবারে মাথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় কমপক্ষে ৫০০ গজ দূরে, ইট ভাটায়৷ তাদের কোনো কর্মঘণ্টাও ঠিক করা নেই৷ একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত পর্যন্ত কাজ করে তারা৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেদ কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা
পুরনো ঢাকার লালবাগের একটি লেদ কারখানায় কাজ করে ১১ বছরের শিশু রহিম৷ সারাদিন লোহা কাটা, ভারি যন্ত্রপাতি মেরামত, হাতুরি পেটানোসহ নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে সে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
9 ছবি1 | 9
জনজীবন নিরাপদ করার দায়িত্ব পালনের থেকে আইন–শৃঙ্খলা বজায় থাকলেই প্রশাসন খুশি৷ বাজি তৈরির এই কাজকে যদি এক ছাতার তলায় আনা যেত, তা হলেও একটা সংগঠিত বাণিজ্যিক উদ্যোগের চেহারা নিত, একটা অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ থাকত তার, কারণ, শুধু উৎসবের মরশুমে নয়, পশ্চিমবঙ্গে সারা বছরই বাজির একটা চাহিদা থাকে৷ সে বিয়ে–শাদিতে হোক, কিংবা বছরভর নানা খেলার বিজয় উৎসব পালনের সময়৷ কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগও কখনো কোনো সরকার দেখায়নি৷ পুরো কাজটাই একটা অসংগঠিত, বিচ্ছিন্ন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী উদ্যোগ হয়েই থেকে গেছে৷
নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই৷ না মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে, না নিরাপত্তা ব্যবস্থায়৷ কোনো বিধিবদ্ধ আচরণের তোয়াক্কা কেউ করে না৷ ফলে যা ঘটার, ঘটছে৷ প্রায় প্রতি বছরই দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রাণহানি হচ্ছে, আর তার থেকেও বড় কথা, অল্পের জন্যে এড়িয়ে যাচ্ছে আরো বড় বিপর্যয়৷