ওদের লাথি খেয়ে মরবো না: হামিদুল্লাহ
২২ ডিসেম্বর ২০১০পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের বৈষম্যমূলক আচরণ কখনোই মেনে নিতে পারেননি হামিদুল্লাহ খান৷ চাকরি করতেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে৷ কিন্তু দেশ স্বাধীন করার গোপন ইচ্ছা ছিল তাঁর মনে, বললেন তিনি৷ ২৫ মার্চ সেই সুযোগ আসতেই তা লুফে নিলেন হামিদুল্লাহ৷ তিনি বলেন, আমি সেসময় বিমানবন্দরের দায়িত্বে ছিলাম৷ আমি দেখেছি, দিনে ১৫-১৬টা বিমান ভর্তি হয়ে সেনা আসছে৷ এসব দেখে আমি শঙ্কিত ছিলাম৷
হামিদুল্লাহ বলেন, যেই মুহূর্তে ওরা চারদিকে তুমুল হত্যাযজ্ঞ শুরু করে দিল - চট্টগ্রামে প্রায় এক হাজার সেনা হত্যা করলো৷ সেটা শুনে আমি আর অপেক্ষা করতে পারিনি৷
মানকাচর সাব সেক্টর
যুদ্ধ শুরু হবার পর হামিদুল্লাহকে উত্তর ফ্রন্টে বদলি করেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী৷ এরপর বৃহত্তর রংপুর ও ময়মনসিংহ জেলার বিপরীতে মেঘালয়ের নদীবন্দরে স্থাপিত মানকাচর সাব সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি৷ এসময় হামিদুল্লাহ বীরত্বের সঙ্গে রংপুরের কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় অবস্থিত শত্রু ঘাঁটিসমূহে যুদ্ধ পরিচালনা করেন৷ একই সঙ্গে রৌমারি ও রাজিবপুর থানাধীন ৫৫০ বর্গমাইল মুক্তাঞ্চলের প্রতিরক্ষার দায়িত্বও ছিল তাঁর স্কন্ধে৷ এই সেনা কখনোই কাপুরুষের মতো পাকিস্তানিদের হাতে মরতে চাননি৷ বরং বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধেই সায় ছিল তাঁর৷ এই যোদ্ধা বলেন, পশ্চিমারা চারদিকে মানুষ মেরেছে৷ অনেক বাঙালি সেনাকে বন্দি করেছে, হত্যা করেছে৷ এসব দেখে আমি ভাবলাম, কুকুরের মতো বেঁচে থাকা আমি পছন্দ করিনা৷ মরতে হলে লড়ে মরবো, কিন্তু ওদের লাথি খেয়ে মরবো না৷
দুই মণ চাল আর বৃদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অনেক স্মৃতি এখনো নাড়া দেয় হামিদুল্লাহ খানকে৷ ভুলতে পারেন না সেই বৃদ্ধাকে, যিনি তুলে নিতে না পারে ২ মণ ওজনের চালের বস্তা জড়িয়ে ধরে বসেছিলেন৷ খাদ্যের যে বড় অভাব তখন৷ হামিদুল্লাহ বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর চিলমারিতে বিস্ময়কর অপারেশন পরিচালনা করি আমরা৷ সেখানকার একটি খাদ্য গুদামে গুলি করে তালা ভেঙে দেয়া হয়৷ এরপর শত শত মানুষ সেখান থেকে চাল নিয়ে যেতে শুরু করে৷
তিনি বলেন, সেসময় আমি এক বৃদ্ধাকে দেখি দুই মণ ওজনের একটি চালের বস্তা আকড়ে ধরে বসে আছেন৷ আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তুমি বস্তা ধরে বসে আছো কেন? বৃদ্ধা বললেন, বাবা আমিতো এটাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবো না৷ আর ছেড়ে দিলে এটা থাকবে না৷
সেদিন যুদ্ধের ব্যস্ততার কারণে সেই বৃদ্ধাকে সাহায্য করতে পারেননি হামিদুল্লাহ৷ এই দুঃখটা তাঁর আজও রয়ে গেছে৷
সেক্টর-১১
নভেম্বরের ২ তারিখে গুরুতর আহত হন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের৷ ফলে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে সেক্টর ১১৷ এরপর ৩ নভেম্বর এই সেক্টরের দায়িত্ব পান এম হামিদুল্লাহ খান৷ যুদ্ধের বাকি সময় তিনিই সামলেছেন সেক্টর ১১৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নথিপত্রেও এই তথ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়৷ এই প্রসঙ্গে হামিদুল্লাহ বলেন, দুই নভেম্বর সকাল ন'টার সময় মাইন বিস্ফোরণে তাহের সাহেবের একটি পা উড়ে যায়৷ সেসময় তিনি নিজের হাতে লিখে গেছেন এবং তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ আছে যে, আমি সেক্টরের ভার হামিদুল্লাহ'র হাতে বুঝিয়ে দিয়ে চিকিৎসার জন্য পুনে চললাম৷
কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ি-আরিচা থকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী ও তীর অঞ্চল ছিল সেক্টর ১১-এর আওতায়৷ হামিদুল্লাহ'র নেতৃত্বে আনুমানিক ২২,৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ সাফল্য দেখায়৷
গর্ব আর হতাশা
সেক্টর কমান্ডার এম হামিদুল্লাহ খান মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ অবদানের জন্য বীরপ্রতীক উপাধি লাভ করেন৷ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে শুরু হয় তাঁর কর্মকাল৷ পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন হামিদুল্লাহ৷ বিজয়ী এই সেনা স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে গর্বের সঙ্গেই বললেন, আমাদের যে প্রজন্ম, আমাদের যে ছেলেরা, আমাদের সন্তানেরা অনেক দূর এগিয় গেছে৷ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়েছে তারা৷ এই প্রজন্ম আমাদের জন্য গর্বের বিষয়৷
এরপরই খানিকটা হতাশা নেমে এলো এই বীর প্রতিকের গলায়৷ তিনি বললেন, আমরা যারা রাজনীতিতে আছি, তারা দেখছি এটার মধ্যে শুধু বিভাজন, বিভাজন আর বিভাজন আসছে৷ এটা আমাদের জন্য খুব দুঃখজনক৷
প্রতিবেদন: আরাফাতুল ইসলাম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক