ওমানে বাংলাদেশের ৭০ হাজার প্রবাসী শ্রমিক কর্মস্থল ছেড়ে লাপাত্তা হয়ে গেছেন৷ তাঁরা কোথায় আছেন তা জানে না ওমান সরকার৷ তাই তাঁদের খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ সরকার একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার ঢাকায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ওমান সরকারের একটি প্রতিনিধি দল৷ বৈঠকের পর প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী জানান, ‘‘ওমানের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন যে, তাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ৭০ হাজার বাংলাদেশি কাজ ছেড়ে লাপাত্তা হয়েছেন৷ তবে কেন তাঁরা কাজ ছেড়েছেন তার কারণ তাঁরা জানাতে পারেননি৷ এছাড়া তাঁরা কোথায় আছেন তাও তাঁরা জানেন না৷'' মন্ত্রী জানান, বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে ওমানে পাঠানো হবে৷ তবে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী মনে করছেন, ‘‘কাজের পরিবেশ এবং বেতনের কারণে শ্রমিকরা নিজেদের কর্মস্থল ছেড়ে যেতে পারেন৷''
বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি কাজ নিয়ে ওমানে গেছেন৷ জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব আলি হায়দার চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ওমানে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির বাজার বেশি দিনের নয়৷ আর ঐ দেশে বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিকই গেছেন ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং দালালের মাধ্যমে৷'' তিনিও মন্তব্য করেন যে, সেখানে যাওয়ার পর শ্রমিকরা কাজের পরিবেশ এবং প্রতিশ্রুত বেতন না পেয়ে হয়ত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে গোপনে কাজ নিয়ে চলে গেছেন৷ তাঁর ধারণা তাঁরা ওমানেই আছেন৷'' তবে তিনি মনে করেন এর নেতিবাচক প্রভাব আছে৷ এই কারণে শুধু ওমান নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে৷ তাই সরকারের উচিত হবে দ্রুত ওমান সরকারের সহযোগিতা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের খুঁজে বের করা৷
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৯০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন৷ তাঁদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যেই আছেন প্রায় অর্ধেক৷ গত বছর বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকরা রেকর্ড পরিমাণ ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন৷ আলি হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘‘তাই এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে এই বাজার নষ্ট না হয়৷''
তিনি এ জন্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের যেমন সেসব দেশের নিয়ম-নীতি মেনে চলার আহ্বান জানান, তেমনি নানা ধরণের অনিময়মের জন্য ঐ সব দেশের জনশক্তি প্রতিষ্ঠানকেও দায়ী করেন৷
পোশাক শিল্পে শ্রমশোষণ: ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ
দু মুঠো অন্নের সংস্থান করতে রানা প্লাজায় গিয়ে লাশ হয়ে ফিরেছিলেন এগোরো শ-রও বেশি মানুষ৷ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের অনেকেরই বাকি জীবন কাটবে দুর্বিষহ কষ্টে৷ পোশাক শ্রমিকদের জীবনের এই নির্মমতার ইতিহাস কিন্তু অনেক দীর্ঘ৷
ছবি: DW/M. Mohseni
বৈশ্বিক শিল্প
প্রতিটি পোশাকে মিশে থাকে শ্রমিকের শ্রম-রক্ত-ঘাম৷ ১৯৭০-এর দশক থেকে ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো এশিয়া আর ল্যাটিন অ্যামেরিকার কিছু দেশ থেকে পোশাক কিনতে শুরু করে৷ খুব কম মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায় বলে দাম পড়ে কম, লাভ হয় বেশি৷ এমন সুযোগ ছাড়ে তারা! কম টাকায় পণ্য কিনবেন, ছবির মতো পোশক তৈরি হবে মিষ্টির দোকানে – তারপর আবার শ্রমিকের অধিকাররক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ করবেন – তাও কি হয়!
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার জন্য পোশাক
বড় আঙ্গিকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পোশাক তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটেনে, অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই শিল্পবিপ্লবের সময়টাতে৷ এখন বিশ্বাস করতে অনেকের হয়ত কষ্ট হবে, তবে ইতিহাস বলছে, শিল্পবিপ্লবের ওই প্রহরে ব্রিটেনের লন্ডন আর ম্যানচেস্টারও শ্রমিকদের জন্য ছিল আজকের ঢাকার মতো৷ শতাধিক কারখানা ছিল দুটি শহরে৷ শিশুশ্রম, অনির্ধারিত কর্মঘণ্টার সুবিধাভোগ, অল্প মজুরি, কারখানার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ – সবই ছিল সেখানে৷
ছবি: gemeinfrei
সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন কর্তৃত্বে
যুক্তরাষ্ট্রেও পোশাকশ্রমিকরা স্বর্গসুখে ছিলেন না সব সময়৷ সেখানেও এক সময় কারখানায় আগুন লাগলে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ভেতরে রেখেই সদর দরজায় তালা লাগাতো৷ ১৯১১ সালে তাই নিউ ইয়র্কের ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে পুড়ে মরেছিল ১৪৬ জন শ্রমিক৷ মৃতদের অধিকাংশই ছিলেন নারী৷ মজুরি, কর্মঘণ্টা, কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা – কোনো কিছুই এশিয়ার এখনকার কারখানাগুলোর চেয়ে ভালো ছিল না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পোশাক শিল্পে চীন বিপ্লব
পোশাক রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চলছে সবচেয়ে কম খরচে পোশাক তৈরির প্রতিযোগিতা৷ রপ্তানিকারী দেশগুলোর মধ্যে চীনের অবস্থা সবচেয়ে ভালো৷ রপ্তানি সবচেয়ে বেশি, শ্রমিকদের মজুরিও খুব ভালো৷ চীনে একজন পোশাক শ্রমিক এখন মাস শেষে ৩৭০ ইউরো, অর্থাৎ, বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৭ হাজার টাকার মতো পেয়ে থাকেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শ্রমশোষণ কাকে বলে...
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য তামিলনাড়ুর সুমাংগলি৷ তামিল শব্দ ‘সুমাংগলি’-র অর্থ, ‘যে নববধু সম্পদ বয়ে আনে’৷ এলাকায় পোশাক এবং সুতা তৈরির প্রশিক্ষণের নামে খাটানো হয় প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মেয়েকে৷ দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে তাঁরা হাতে পান ৬০ ইউরো সেন্ট, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় ৬০ টাকা৷ সে হিসেবে মাস শেষে পান ১৮০০ টাকা৷ টাকাটা তাঁদের খুব দরকার৷ বিয়ের সময় বাবাকে তো যৌতুক দিতে হবে!
ছবি: picture-alliance/Godong
অধিকার আদায়ের করুণ সংগ্রাম
কম্বোডিয়াতেও অবস্থা খুব খারাপ৷ ৩ লক্ষের মতো পোশাক শ্রমিক আছে সে দেশে৷ কাজের পরিবেশ আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কেমন? মাসিক বেতন মাত্র ৫০ ইউরো, অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রায় বড় জোর ৫ হাজার টাকা৷ মালিকের কাছে শ্রমিকদের মানুষের মর্যাদা প্রাপ্তি সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ মজুরি বাড়ানোর দাবিতে মিছিলে নেমে শ্রমিকরা মালিকপক্ষের গুলিতে মরেছেন – এমন দৃষ্টান্তও আছে সেখানে৷
ছবি: Reuters
ট্র্যাজেডি
গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশের রানা প্লাজা ধসে পড়ায় মারা যান ১১শ-রও বেশি তৈরি পোশাককর্মী৷ দেয়ালে ফাটল ধরার পরও সেখানে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় এতগুলো জীবন শেষ হওয়াকে বিশ্বের কোনো দেশই ভালো চোখে দেখেনি৷ ঘটনার পর জার্মানির এইচঅ্যান্ডএম, কেআইকে এবং মেট্রোসহ বিশ্বের ৮০টির মতো পোশাক কোম্পানি শ্রমিকের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক রপ্তানিকারী কারখানাগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷
ছবি: Reuters
আলোয় ঢাকা আঁধার
অভিজাত বিপণিবিতান কিংবা দোকানের পরিপাটি পরিবেশে ঝলমলে আলোয় ঝিকমিক করে থরে থরে সাজানো বাহারি সব পোশাক৷ দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়৷ ক্রেতাদের ক’জনের মনে পড়ে রানা প্লাজা কিংবা অতীতের ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাহতদের কথা?