কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারগুলিকে লেখা চিঠিতে এ নিয়ে সতর্কবাণী দিয়েছে৷ তারা বলেছে, নয়া ভ্যারিয়েন্ট তিনগুণ বেশি সংক্রামক৷ তাই চূড়ান্ত সতর্ক থাকতে হবে৷ কোনো এলাকায় আক্রান্তের হার ১০ শতাংশের বেশি হলে পরিস্থিতি বিপদসীমায় পৌঁছে গেছে এমনটা ধরে নিতে বলে হয়েছে৷ তাছাড়া অক্সিজেন সরবরাহের সুবিধাযুক্ত হাসপাতালের আইসিইউ বেডের ৪০শতাংশ যদি পূর্ণ হয়ে যায় সেক্ষেত্রেও বুঝতে হবে পরিস্থিতি বিপজ্জনক৷
কেন্দ্রের বিশেষ কমিটি ইতিমধ্যেই পূর্বাভাস দিয়েছে, জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারিতে ভারতে তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে পারে৷ তাই রাজ্যে রাজ্যে চিকিৎসা পরিকাঠামো প্রস্তুত রাখার ওপর জোর কেন্দ্রীয় সরকারের৷
কলকাতাসহ দেশের আটটি মেট্রো শহরে পজিটিভিটি রেট এখন পাঁচ শতাংশের আশেপাশে৷ শুক্রবার কেন্দ্রের দেওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ওমিক্রন আক্রান্ত ৩৫৮ জনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের তিনজন৷ এই সংখ্যা নগণ্য হলেও বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন চিকিৎসকরা৷
ওমিক্রন চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে জরুরি জিনোম সিকোয়েন্সিং অর্থাৎ ডিএনএর ক্রমবিন্যাস খতিয়ে দেখা হয়৷ এই পদ্ধতির মাধ্যমে জেনেটিক কোড পরপর সাজিয়ে পরীক্ষা করা হয় যে কোথাও কোনো গলদ আছে কিনা৷ কিন্তু কলকাতাসহ দেশের বড় শহরগুলিতে জিনোম সিকোয়েন্সিং করার যথেষ্ট পরিকাঠামো আছে কি?
জিনোম সিকোয়েন্সিং-এর জন্য নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয় কলকাতার অদূরে নদীয়ার কল্যাণীতে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স নামক সংস্থায়৷ কিন্তু সেখানে চারটের মত জিনোম সিকোয়েন্সিং করতে দিন তিনেক সময় লেগে যাচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে এই বিপুল জনসমষ্টিতে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে এত সংখ্যক জিনোম সিকোয়েন্সিং কীভাবে সম্ভব হবে?
‘পরিকাঠামো না থাকা খুবই উদ্বেগের’
চিকিৎসক মহলে অবশ্য এ ব্যাপারে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে৷
চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘কল্যাণীর সংস্থায় অত্যাধুনিক পরিকাঠামো রয়েছে৷ সেখানে বড় সংখ্যায় জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্ভব বলে আমি জানি৷ নতুন ভ্যারিয়েন্ট-এর চরিত্র বুঝতে এই পদ্ধতি জরুরি৷’’
যদিও ভাইরোলজিস্ট ডা. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার বলেন, ‘‘গোড়ায় আরটিপিসিআর টেস্ট করাতে সমস্যা হচ্ছিল৷ পরিকাঠামো ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে৷ এখন হাজার হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ কিন্তু সেভাবে জিনোম সিকোয়েন্সিং এখনই সম্ভব হবে না৷ যেখানে পরীক্ষা করাই এই রোগ নির্ণয়ের চাবিকাঠি, সেক্ষেত্রে পরিকাঠামো না থাকা খুবই উদ্বেগের৷’’
কীভাবে নয়া ভ্যারিয়েন্টের মোকাবিলা সম্ভব এমন প্রশ্নে চিকিৎসকরা বলছেন, ‘‘আমাদের হাতে চারটে হাতিয়ার রয়েছে৷ মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া, দূরত্ব বজায় রাখা ও ভ্যাকসিন দেওয়া৷’’
চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘ব্যাপক টিকাকরণের ফলে ভাইরাস আটকাতে আমরা এখন অনেকটাই সক্ষম৷ নতুন ভ্যারিয়েন্টের পরিপ্রেক্ষিতে টিকা কতটা কাজ করবে সেটা পরে বোঝা যাবে৷ তবে বিশ্বজুড়ে টিকাকরণ না হলে অতিমারি রোখা যাবে না৷ সেক্ষেত্রে সব বিমানবন্দর একেবারে বন্ধ করে দিতে হবে৷’’
তবে চিকিৎসক পুণ্যব্রত গুণ বলেন, ‘‘ভাইরাস নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ক্রমাগত মিউটেশন চালিয়ে যায়৷ সেটা বিদেশে হবে কিন্তু এদেশে হবে না, এভাবে বলা যায় না৷ তাই বিদেশ থেকে যাতায়াত বন্ধ করে সমস্যা মিটবে না৷’’
নয়া ভ্যারিয়েন্টের বিপদ যখন অপেক্ষারত তখন উৎসবের উদ্দীপনাও তুঙ্গে৷ বড়দিন ও বর্ষবরণে মেতে উঠেছে কলকাতা৷ রাজ্য সরকার বিধির কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করেছে উৎসবের জন্য৷ আর এতে বিপদ দেখছেন চিকিৎসকরা৷ এরইমধ্যে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সব রাজ্যের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছেন৷
তবে চিকিৎসকরা আশার কথা শোনাচ্ছেন৷ ডা. পুণ্যব্রত গুণ বলেন, ‘‘ডেল্টা থেকে তিনগুণ বেশি সংক্রামক ওমিক্রন৷ কিন্তু এর মারণ ক্ষমতা কম৷ তাই কোভিড বিধি মেনে চললে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷ উৎসবে গা ভাসালে মুশকিল৷ প্রয়োজনে বুস্টার ডোজ বা তৃতীয় ডোজের উপর জোর দিতে হবে৷’‘
বুস্টার ডোজ নিয়ে বিস্তারিত দেখুন ছবিঘরে
বুস্টার ডোজের আদ্যোপান্ত
করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ও টিকার আলোচনায় সবশেষ সংযোজন ওমিক্রন ও বুস্টার ডোজ৷ বুস্টার ডোজের আলোচনা আগেই ছিল৷ তবে ওমিক্রন আসায় বুস্টার ডোজের প্রয়োগে গতি পেয়েছে বেশ৷ ছবিঘরে দেখুন বুস্টার ডোজের আদ্যোপান্ত৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/picture alliance
বুস্টার ডোজ কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, করোনা ভাইরাস ঠেকাতে টিকার প্রাথমিক পূর্ণ ডোজ (ধরন হিসেবে এক বা দুই ডোজ) পাওয়া একটি জনসংখ্যার মাঝে টিকার কার্যকারিতা নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে যাওয়ায় বাড়তি যে ডোজ দেয়া হচ্ছে তাকেই বলা হচ্ছে বুস্টার ডোজ৷ এটি দেয়ার মূল লক্ষ্য হল, মানবশরীরে টিকার কার্যকারিতা বাড়ানো৷
ছবি: Tsafrir Abayov/AP Photo/picture alliance
পেলেন কতজন?
‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’র ২২ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত হিসেব বলছে, পুরো পৃথিবীতে প্রতি ১০০ জনে ৫.৮৬ জন বুস্টার ডোজ পেয়েছেন৷ এর মধ্যে চিলির বুস্টার পাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি ৫২.৬৮%৷ এছাড়া যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০০ জনে ৪৫.২২, ইসরায়েলে ৪৪.৮৯ ও উরুগুয়েতে ৪২.৫৯ জন পেয়েছেন এই ডোজ৷
ছবি: Lukas Barth/REUTERS
ছয় না তিন মাস?
প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছিল, টিকার পূর্ণডোজের ছয়মাস পর বুস্টার ডোজ নেয়া যেতে পারে৷ কারণ ছয় মাস পর টিকার কার্যকারিতা এরপর কমতে শুরু করে৷ কিন্তু সম্প্রতি জার্মানির টিকা কমিশন বা এসটিআইকেও বলছে, পূর্ণ ডোজের তিন মাস পরই নেয়া যাবে বুস্টার৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/picture alliance
ওমিক্রনের টেনশন
করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রকোপের কারণে বুস্টার ডোজের প্রতি ঝুঁকছে দেশগুলো৷ যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে ওমিক্রনের প্রভাব বাড়ায় নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি বুস্টার টিকার ওপর জোর বাড়ানো হচ্ছে৷
ছবি: Fleig/Eibner-Pressefoto/picture alliance
ইউরোপে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এরইমধ্যে বুস্টার ডোজ ছাড়া ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সম্প্রতি ইউরোপীয়ান কমিশন ঘোষণা দিয়েছে, প্রাথমিক পূর্ণ ডোজ পাওয়া ব্যক্তিরা বুস্টার ডোজ না নেয়া থাকলে কেবল নয় মাস ইউরোপে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন৷ অন্যথায় তাদের ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কার্যকর থাকবে না৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/picture alliance
ওমিক্রনে বুস্টার কতটা কার্যকর?
ওমিক্রন ঠেকাতে বুস্টার ডোজ কতটা কার্যকর তা নিশ্চিত করে এখনো (ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত) বলতে পারেনি ইউরোপীয় মেডিসিনস এজেন্সি কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ কোন কোন টিকা কোম্পানি দাবি করছে, তাদের টিকা এই ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে কার্যকর৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু টিকা নয়, মাস্ক পরাসহ বিধিনিষেধ অনুসরণ করলেই কেবল প্রচণ্ড সংক্রমক ওমিক্রনকে ঠেকানো যাবে৷
ছবি: Charlotte Chelsom-Pill/DW
বাধ্যতামূলক টিকা
ইউরোপে অস্ট্রিয়াতে সবার আগে করোনার টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ জার্মানিতে হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোতে কাজ করাদের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যেও অনেক দেশ টিকার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করেছে৷ এছাড়া ২০২২ সালের শুরুতে অনেক দেশেই বিশেষ বিশেষ পেশা বা বয়সের মানুষের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করবে বলে জানিয়েছে৷
ছবি: Martin Meissner/ASSOCIATED PRESS/picture alliance
টিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
অন্যদিকে, বুস্টারসহ কোন ধরনের টিকা নিতে চান না এমন লোকেরও অভাব নেই৷ অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের অনেক জায়গায় টিকা ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ব্যাপক আন্দোলন দেখা গেছে৷ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে প্রতিবাদকারীদের৷
ছবি: Angelo Carconi/ANSA/picture alliance
ধনী দেশে বুস্টার, আর গরীব দেশে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নত বিশ্বের লোকজন যে ঢালাওভাবে করোনার বুস্টার টিকা দেয়া শুরু করেছে, তার নিন্দা জানিয়েছে৷ বিশ্বের অনেক দেশে এখন প্রয়োজনীয় প্রাথমিক টিকার সংস্থানও হয়নি৷ আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে ১ শতাংশের কম মানুষ টিকার আওতায় এসেছেন৷ সেখানে বিশ্বে এখন ২০ ভাগ টিকা বুস্টার ডোজ হিসেবে দেয়া হচ্ছে৷
ছবি: Evrard Ngendakumana/Xinhua/imago images
মিশন চতুর্থ বুস্টার
তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজের পর এখন আলোচনা চতুর্থ ডোজ নিয়ে৷ জার্মানির ডাক্তার অ্যাসেসিয়েশনের প্রধান উলরিশ ভাইগেল্ডট সম্প্রতি বলেন যে, ২০২২ সালের গ্রীষ্মে বা তারপর চতুর্থ বুস্টার ডোজের প্রয়োজন পড়তে পারে৷