আওয়ামী লীগের জনসভায় নাকি অনেক মানুষ হয়েছিল৷ কিন্তু সরকারের তথ্য অধিদপ্তর তাতে খুশি হতে পারেনি৷ তাই ফটোশপের কারসাজিতে জনসভার মানুষ বাড়িয়েছে৷ আওয়ামী লীগকে আসলে কত জনপ্রিয়, কত উঁচুতে দেখতে চায় তারা? চাঁদের উচ্চতায়?
বিজ্ঞাপন
আওয়ামী লীগকে চাঁদে তোলার আশঙ্কা জাগার কারণ আছে৷ এর একটা অতীতও আছে৷ বাংলাদেশে বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে বিশেষ প্রিয়কে চাঁদে পাঠানোর নজির তো আমরা আগে দেখেছি৷ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির আদেশ দেয়ার পর জামায়াত-শিবির সমর্থকরা দেশে তাণ্ডব চালায়৷ ‘সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে' বলে গুজব ছড়িয়ে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টাও হয়েছে তখন৷ সাঈদী নিজে অবশ্য জানিয়েছিলেন, তাঁকে চাঁদে দেখা যেতে পারে এমন কথা তিনি বিশ্বাস করেননি৷
মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রেস ইনফর্মেশন ডিপার্টমেন্ট (পিআইডি) আওয়ামী লীগের জনসভা নিয়ে যা করেছে, তা দেখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বোধহয় বিশ্বাস করতে পারবেন না৷ এমন কাণ্ড কোনো স্বাভাবিক মানুষ করতে পারে!
২০১৩ সালে জামায়াত-শিবির সমর্থকরা তাদের জেলবন্দি নেতা সাঈদীকে ‘জাদুবলে' মুক্ত করে ফটোশপে চড়িয়ে সোজা চাঁদে পাঠিয়েছিল৷ ২০১ ৭ সালে সরকারের তথ্য অধিদপ্তর সংবাদমাধ্যমকে আওয়ামী লীগের জনসভার এমন ছবি সরবরাহ করেছেন যেখানে একই ব্যানার উল্টো এবং সোজা, একই ব্যক্তির ডাবল ভার্সন, গেঞ্জির ফুঁড়ে মানুষের আত্মপ্রকাশসহ অনেক সার্কাস, অনেক ভৌতিক কাণ্ড-কীর্তি আছে৷
জনসভার দিনে ঢাকার মানুষকে কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সে খবর আমরা সংবাদমাধ্যমেই পেয়েছি৷ সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, রেডিও, অনলাইন পোর্টালগুলোর খবর অনুযায়ী, সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দি উদ্যান অভিমুখে মিছিল শুরু হয়েছিল শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে৷ জনসমায় যথেষ্ট লোক সমাগম হয়েছিল এমন খবরও আমরা পেয়েছি৷
বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ইতিহাস
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১১ বার সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য৷
ছবি: Anupam Nath/AP/picture alliance
প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সে সময় ৩০০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়৷ আর সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ১৫টি৷ ঐ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল ৭ এপ্রিল, তেজগাঁওয়ে অবস্থিত তখনকার জাতীয় সংসদ ভবনে৷ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টিতে জয়লাভ করে৷ বঙ্গবন্ধু সে সময় ঢাকা-১২ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন৷
ছবি: AP
দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন, প্রথম নারী সাংসদ
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণ হয়৷ সেবার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ৩০টি৷ তবে ঐ সংসদেই প্রথমবারের মতো প্রত্যক্ষ ভোটে একজন নারী সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ খুলনা-১৪ থেকে নির্বাচিত হন সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ৷ প্রথম অধিবেশন বসেছিল ২ এপ্রিল৷ নির্বাচনে মাত্র মাস ছয়েক আগে প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি ২০৭টি আর আওয়ামী লীগ ৫৪টি আসন পেয়েছিল৷
ছবি: imago stock&people
তৃতীয় সংসদ নির্বাচন
ভোটগ্রহণ হয় ১৯৮৬ সালের ৭ মে৷ জাতীয় পার্টি ১৫৩টি, আওয়ামী লীগ ৭৬টি আর জামায়াতে ইসলামী ১০টি আসন পায়৷ বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করেছিল৷
ছবি: http://www.parliament.gov.bd
চতুর্থ সংসদ নির্বাচন
১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ আওয়ামী লীগ, বিএনপি সহ বেশ কয়েকটি দল এই নির্বাচন বর্জন করেছিল৷ জাতীয় পার্টি আসন পেয়েছিল ২৫১টি৷ সংরক্ষিত মহিলা আসন সংক্রান্ত আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এই সংসদে মোট আসন সংখ্যা ছিল ৩০০টি৷
ছবি: http://www.parliament.gov.bd
পঞ্চম সংসদ নির্বাচন
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি, আওয়ামী লীগ ৮৮টি আর জাতীয় পার্টি ৩৫টিতে জয়লাভ করে৷ এছাড়া নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ৩০ জন মহিলাকে সাংসদ নির্বাচিত করা হয়৷ অবশ্য তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি সংবিধানের অংশ ছিল না৷ পরের সংসদে সেই বিল পাস হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images
ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি৷ আওয়ামী লীগ সহ অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দল নির্বাচনটি বর্জন করেছিল৷ ফলে মোট ভোট গৃহীত হয়েছিল মাত্র ২১ শতাংশ৷ ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ২৭৮টিতে জয়লাভ করেছিল৷ মাত্র চার কার্যদিবসে সংসদ বসার পর তা বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়৷ এই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়৷
ছবি: picture-alliance/Dinodia Photo
সপ্তম সংসদ নির্বাচন
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬, বিএনপি ১১৬ ও জাতীয় পার্টি ৩২টি আসনে জয়লাভ করে৷ পরে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ৷
ছবি: Reuters
অষ্টম সংসদ নির্বাচন
ভোটগ্রহণ হয় ২০০১ সালের ১ অক্টোবর৷ অষ্টম সংসদের মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩০০টি৷ কারণ সংরক্ষিত মহিলা আসন সংক্রান্ত আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শুরুতে কোনো মহিলা আসন ছিল না৷ পরে আইন করে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ এ উন্নীত করা হয়৷ নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩ আর আওয়ামী লীগ ৬২টি আসনে জয়ী হয়েছিল৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
নবম সংসদ নির্বাচন
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত সবশেষ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর৷ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার পেয়েছিল ২৬৩টি আসন৷ আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট পায় ৩৩টি আসন৷
ছবি: picture-alliance/A.A./N. Kumar
দশম সংসদ নির্বাচন
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি৷ ফলে ১৫৩ জন সাংসদ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই সাংসদ নির্বাচিত হন৷
ছবি: DW/M. Mamun
একাদশ সংসদ নির্বাচন
বাংলাদেশের সবশেষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০১৮ সালে৷ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া এই নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের ২৮৮টিই পেয়েছিল ক্ষমতাসীন দল ও মহাজোট৷ সেই নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট পড়েছে পাঁচ ভাগের চার ভাগ৷ ঘটেছে নজিরবিহীন ঘটনাও৷ ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে৷ প্রায় আট হাজার কেন্দ্রে পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি৷
ছবি: Anupam Nath/AP/picture alliance
11 ছবি1 | 11
কিন্তু পিআইডি-র তাতে মন ভরেনি৷ তাই ছবির সঙ্গে ছবি জোড়া দিয়ে জনসভায় জনসংখ্যা বাড়ানো হয়েছে৷
নিজেদের ওয়েবসাইটে পিআইডি দাবি করে, তারা ‘‘বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়াধীন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তর৷ বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম এ সংস্থাটি দেশের তথ্যসম্পদ উন্নয়ন, তথ্য সংরক্ষণ, তথ্যের নিরাপদ সঞ্চালন, তথ্য অধিকার সংরক্ষণ, অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিতকরণসহ তথ্যসংশ্লিষ্ট বিবিধ আইন-বিধি-বিধান-প্রবিধান প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে৷''
পিআইডি নাকি ‘‘সবসময় জনকল্যাণকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি সংবাদ এবং ছবি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশের জন্য সরবরাহ করে থাকে৷ তথ্য অধিদফতর জনগণের ভূমিকাকে সবসময় মূল্যায়ন করে এবং গুরুত্ব দিয়ে থাকে৷ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সহযোগিতায় তথ্য অধিদফতর সর্বান্তকরণে দেশবাসীর সেবার পাশাপাশি রাষ্ট্রকে সেবা দিয়ে থাকে৷''
অথচ আমরা বুঝতে পারছি না এমন ভৌতিক ছবি প্রকাশ করে পিআইডি তথ্যসম্পদ উন্নয়ন, তথ্য সংরক্ষণ, তথ্যের নিরাপদ সঞ্চালনের কী অবদান রাখল৷
এর মাধ্যমে জনগণ ও সরকারকে ‘বিনোদন' ছাড়া আর কী ধরনের সেবা দেয়া হলো তা-ও আমাদের বোধগম্য হয়নি৷
আমরা জানতাম, পিআইডি চিরকালই সরকারের৷ সেই সুবাদে সরকারি দলের হয়েই তারা কাজ করে৷ অনেক সময় সরকারি দলের প্রতি তাদের আনুগত্য দলীয় কর্মীদেরও লজ্জায় ফেলে৷ কিন্তু এবারের ‘কীর্তি' অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করেছে৷
তাদের এবারের ‘কীর্তি' যে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের লজ্জায় ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ পিআইডি আসলে কী চায়? সরকারের ‘সুনজর' থাকা নিশ্চিত করতে তারা কি আওয়ামী লীগকে চাঁদে পাঠাতে চায়?
আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান নীচের মন্তব্যের ঘরে৷