আবরার হত্যার দায়ে ২৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ৷ নৃশংসভাবে খুন হওয়া আবরারসহ তারা সকলেই বুয়েটের ছাত্র৷ চার্জশিটভুক্ত সকলে এই ৫৬ হাজার বর্গমাইলে লেখাপড়ায় সবচেয়ে ভালো ফল করা ছাত্র৷
আবরার হত্যার প্রতিবাদ (ফাইল ছবি)ছবি: bdnews24
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়টিতে পড়তে পড়তে কীসের নেশায় বা কার নির্দেশে এরকম ভয়ংকর খুনি তারা হয়ে উঠলেন আমাদের সকলকেই তা ভাবতে হবে৷
আমি কিন্তু এরকম স্টেরিওটাইপে যেতে চাই না যে, পড়ালেখায় ভালো হলেই কেউ ক্রিমিনাল হতে পারবেন না৷ বরং আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পড়ালেখার সঙ্গে নৈতিকতার কমই সম্পর্ক রয়েছে৷ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, লুটেরা ব্যাংকার বা ঘুসখোর পেশাজীবীদের বেশিরভাগই উচ্চশিক্ষায় নামজাদা৷ আজ পর্যন্ত আমি কাউকে বলতে শুনিনি, আমি কী করে ঘুস খাব আমিতো অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র!
আমার মতে, মানুষ প্রাণী হিসেবে অপরাধপ্রবণ হলেও তার মধ্যে ধরা পড়ার ভয়টা খুব কাজ করে৷ আর পাশাপাশি সে এক ধরনের শান্তি বা স্থিতাবস্থা চায়৷ তাই অন্য কিছু করার অপশন থাকলে সে অপরাধ করতে চায় না৷ তাই আমরা দেখি বঞ্চিত, অবহেলিত এবং ব্যর্থদের মধ্যে অপরাধস্পৃহা বেশি থাকে৷ বুয়েটের দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের অপশনের কোনো কমতি নেই৷ বলতে গেলে পুরো পৃথিবীটাই তাদের হাতের মুঠোয়৷ দেশে বিরক্ত লাগলে তারা বিদেশে চলে যেতে পারেন৷ চাকরি করতে ভালো না লাগলে করতে পারেন ঠিকাদারিসহ অন্য যে কোনো ব্যবসা বাণিজ্য৷ হতাশা বা বঞ্চনায় নিমজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ আপাতত আমার নজরে আসছে না৷ তাহলে আরেকটি হতে পারে যে, এই অল্পবয়সি ছেলেগুলো এটা বুঝেছিল যে, কিছু করলেই তাদের কিছু হবে না৷
বুয়েটে পড়ছে মানে অংক, বিজ্ঞান বা স্বাভাবিক যুক্তিবিদ্যায় ভালো ছেলেগুলোর এরকম কেন মনে হলো যে, তারা যাই করুক পার পেয়ে যেতে পারবে? কে তাদের দিলো এ আশা? কে দিলো ভরসা? কার নির্দেশে মজা করতে করতে বা গল্প করতে করতে অনেকক্ষণ ধরে একজন সতীর্থকে পেটানো যায়৷
খালেদ মুহিউদ্দীন, প্রধান, ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগছবি: DW/P. Böll
অনেকেই একথা বলতে চাইছেন যে, অভিযুক্তরা বুঝতে পারেননি যে আবরার মরেই যাবে- তাই এটিকে দুর্ঘটনা বলাই সঙ্গত৷ আমারও যেন কিছুটা বিশ্বাস হয় এই যুক্তি৷ কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কাউকে পেটানোর ঘটনা এটাই প্রথম নয়৷ এমনকি নয় সর্বশেষও৷ এর অনেকগুলো খবর হয়েছে, আড়ালে রয়ে গেছে তারও বেশি৷ একবার ভাবুন আবরার যদি না মারা যেতো তাহলে কী হতো? তাহলেও কী আমাদের টনক নড়তো? আমরা ফেসবুক ফাটিয়ে ফেলতাম? প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিতেন কাউকে না ছাড়ার? এখনো কি যেসব আবরার মার খাচ্ছেন তাদের একটু সাবধানে মারা হচ্ছে না? যাতে তারা একটুখানি অন্তত বেঁচে থাকেন৷ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবরারদের যারা দলবদ্ধভাবে মারছেন, তারা নিশ্চয়ই আসি আসি শীতের ফুলকপির বড়া খাচ্ছেন, হাত বাড়িয়ে চায়ে আরেকটু চিনি নিচ্ছেন!
আমাদের সকলের সাবধান হওয়া উচিত একারণে যে, নিজেদের অজান্তেই আমরা কিন্তু ঠাণ্ডা মাথার খুনি তৈরি করছি৷ আজ তাদের ২৫ জন আবরারকে মেরেছেন, কাল তারা আপনাকে বা আমাকে মারতে আসবেন৷ হয়তো একটু খেয়াল রাখবেন আমরা যাতে একেবারে মরে না যাই৷ স্ট্যানলি কুবরিকের ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জের কেন্দ্রীয় চরিত্রদের মতো হয়তো আমাদের পিটিয়ে মেরে নির্বিকারভাবে গ্লাস গ্লাস পুষ্টিকর দুধও পান করবেন তারা৷
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক নৃশংসতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগ৷ বিশ্বজিৎ থেকে আবরার পর্যন্ত তাদের নির্যাতনে মারা গেছে বেশ কয়েকজন৷ কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টি, কারো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে শরীরের হাড়৷ বিচার হয়নি অনেক ঘটনারই৷
ছবি: bdnews24.com
দখলবাজির শিকার আবু বকর
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন মেধাবী ছাত্র আবু বকর৷ ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকরের মাথা থেঁতলে দেয়া হয়৷ এই হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়৷ ২০১৭ সালে আদালতের রায়ে ছাত্রলীগের অভিযুক্ত ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পায়৷ (ছবি: সাম্প্রতিক)
ছবি: bdnews24.com
খাবার নিয়ে বিরোধে হত্যা
২০১০ সালে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ইফতারের টোকেন সংঘর্ষ বাধে রাজশাহী ছাত্রলীগের মধ্যে৷ তার জের ধরে দলটির কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে পিটিয়ে শাহ মখদুম হলের দ্বিতীয় তলা থেকে ফেলে দেয়া হয়৷ ১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর তার মৃত্যু হয়৷ এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় ১০ জন, যাদের সবাই এখন জামিনে৷
ছবি: DW/A. Khanom
জুবায়েরকে কুপিয়ে হত্যা
২০১২ সালে জানুয়ারিতে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের৷ তাকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তারই সংগঠনের প্রতিপক্ষরা৷ এই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালে পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন৷ গত বছরের জানুয়ারিতে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড ও দুজনের যাবজ্জীবন বহাল রাখে হাইকোর্ট৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজনই পলাতক৷
ছবি: bdnews24.com
দুর্ভাগা বিশ্বজিৎ
বিশ্বজিৎ দাস ছিলেন পুরান ঢাকার একজন দর্জি৷ ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নৃশংস হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়৷ সেসময় ১৮ দলের অবরোধ চলছিল৷ বিশ্বজিৎ শিবির কর্মী এমন ধারণা করে তাঁকে চাপাতি, কিরিচ দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কোপায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ আলোচিত এই ঘটনায় নিম্ন আদালতে আট আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন, দুইজনকে খালাস আর পলাতক দুইজনের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট৷
ছবি: bdnews24.com
বাদ যায়নি শিশুও
২০১৩ সালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয় মারা যায় ১২ বছরের শিশু রাব্বি৷
ছবি: bdnews24.com
আধিপত্য বিস্তারের বলি তাপস
২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার৷ ২০১৬ সালে এই ঘটনায় ২৯ নেতাকর্মীর নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ৷ মূল আসামী আশরাফুজ্জামানসহ গ্রেপ্তারকৃত ১৫ জনই জামিনে পান৷ (ছবি: প্রতীকী)
ছবি: Fotolia/Scanrail
খাদিজার মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবরের ঘটনা৷ এমসি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে বের হবার পরই খাদিজা আক্তার নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি)-র ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম৷ নার্গিসকে মৃত ভেবে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা বদরুলকে আটক কোরে পুলিশে দেয়৷ আলোচিত এই ঘটনায় বদরুলের যাবজ্জীবন সাজার রায় দিয়েছে আদালত৷
ছবি: bdnews24.com
হেলমেট বাহিনীর হামলা
গত বছর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র কিছু যুবক ধানমন্ডি, জিগাতলা এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকদের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করে৷ হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী বলে বিভিন্ন গনমাধ্যমে পরিচয় সহ খবর বের হয়৷ কিন্তু এই ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, কারও বিচারও হয়নি৷
ছবি: Bdnews24.com
হাতুড়ি মামুনদের বিচার হয়নি
দেশব্যাপী কোটা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ ওঠে৷ তেমনই একটি ঘটনা ঘটে গত বছরের ২ জুলাই৷ তরিকুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় পেটায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী৷ তাকে হাতুড়ি পেটা করে দলটির সহ-সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: bdnews24.com
চোখ হারানো এহসান
গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে এহসান নামের এক ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা৷ নিজের ক্যালকুলেটর ফেরত চাইলে এই হামলা চালায় তারা৷ এসময় তাকে শিবির কর্মী বলেও অপবাদ দেয়া হয়৷ হামলায় এহসানের চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়৷ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৭ নেতা-কর্মী বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার হলেও তারা হলে থাকতেন বলে খবর বের হয়৷ অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছাড়ে এহসান৷
ছবি: bdnews24.com
আহ্ আবরার!
সবশেষ ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের নৃশংসতার শিকার হল বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ৷ রাত ২টার দিকে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে৷ আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন, যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১০ জন ৷
ছবি: bdnews24
১০ বছরে ২৪ হত্যা
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত ১০ বছরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ যার প্রায় সবগুলোর সাথেই ছাত্রলীগ জড়িত রয়েছে৷ এর মধ্যে ১৭ টিই ঘটেছে নিজেদের অন্তর্কোন্দলে৷ সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ গত ১০ বছরে সেখানে ৮ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: bdnews24
ইচ্ছে হলেই মারধর, হামলা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচীতে ইচ্ছে হলেই হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ কোটা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সময় মারধর করেছে সংগঠনটির নেতা কর্মীরা৷ গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের আন্দোলনেও ছাত্রলীগের হামলা এবং ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে৷ একাধিকবার তাদের হামলার শিকার হয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর৷