বিশ্বের দুই প্রধান অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে পুরোপুরি সংঘাত শুরু হয়ে গেছে৷ ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট' নীতির আওতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের উপর বাড়তি শুল্ক চাপানোর পর চীনও পালটা আঘাত হানলো৷
বিজ্ঞাপন
শুরু হয়ে গেল বাণিজ্য যুদ্ধ৷ অ্যামেরিকা চীন থেকে অ্যালুমিনিয়াম কিছু পণ্য আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপানোর ঘোষণার পর চীনও পালটা পদক্ষেপের ঘোষণা করেছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার মূল্যের ১২৮টি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অবিলম্বে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপাচ্ছে বেইজিং৷ এর মধ্যে শুকরের মাংস, ওয়াইন, কিছু ফলমূল, বাদাম ইত্যাদি খাদ্যপণ্য রয়েছে৷ রবিবার ঘোষণার পর সোমবার থেকেই কার্যকর হচ্ছে এই পদক্ষেপ৷
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমদানির উপর একতরফাভাবে শুল্ক চাপাচ্ছেন ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপের পথে চলেছেন, তার পরিণাম যে অ্যামেরিকাকেও ভোগ করতে হবে, মার্কিন প্রশাসন তা এখন টের পাচ্ছে৷
বাণিজ্য যুদ্ধ হলে কী ক্ষতি হবে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘অ্যামেরিকা ফার্স্ট’ নীতি রূপায়ন করতে আমদানির পথে বাধা সৃষ্টি করছেন৷ সেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ তারই কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো৷
ছবি: Imago/Ralph Peters
বাণিজ্য যুদ্ধের অর্থ কী?
কোনো দেশ কোনো এক বা একাধিক পণ্য আমদানির উপর কর, শুল্ক বা অন্য কোনো আর্থিক বোঝা চাপালে বাকি দেশগুলিও পালটা পদক্ষেপ নিতে পারে৷ বিশেষ করে অ্যামেরিকা ও চীনের মতো বিশাল দেশের সংঘাতের জের ধরে গোটা বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্য যুদ্ধের আকার নিতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণে আনা মোটেই সহজ হবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Peter
অতীত দৃষ্টান্ত
১৯৩০-এর দশকে শেষ বাণিজ্য যুদ্ধের জের ধরে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা বিশাল মন্দা আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুবার সে বছর শুল্ক সংক্রান্ত নতুন আইন কার্যকর করার ফলে ২০ হাজারেরও বেশি পণ্যের উপর শুল্ক চাপানো হয়েছিল৷ ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য দাবি করছে যে, এ ক্ষেত্রে শুধু নির্দিষ্ট কিছু পণ্য ও দেশের জন্য শুল্ক চাপানো হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/Library of Congress
ট্রাম্প কেন বাণিজ্য যুদ্ধের পথে এগোচ্ছেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রতিকূল বাণিজ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে শুরু থেকেই তোপ দেগে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ তবে সমালোচকদের মতে, এমন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ফলে তিনি অ্যামেরিকার সার্বিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের স্বার্থ দেখতে পাচ্ছেন না৷ কারণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কাঠামো তোলপাড় হয়ে গেলে আখেরে অ্যামেরিকারই ক্ষতি হবে৷ ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাবে, রপ্তানি কমে যাবে এবং প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷
ছবি: picture-alliance/K. Ohlenschläger
পালটা পদক্ষেপ
ট্রাম্প প্রশাসন একের পর এক শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করলে বাকি দেশগুলিও হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না৷ ক্যানাডা, মেক্সিকো, চীন, জাপান, ব্রাজিল ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অ্যামেরিকার বিরুদ্ধেও পালটা পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ এমন বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার চেয়ে বহুপাক্ষিক সমাধানসূত্রের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
অ্যামেরিকার ক্ষতি
সব সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ট্রাম্প যদি সত্যি আমদানির উপর বাড়তি শুল্ক চাপান, তার পরিণতি অ্যামেরিকার জন্যও ইতিবাচক হবে না৷ যেমন, ইস্পাত আমদানির উপর শুল্ক চাপালে অ্যামেরিকার বাজারেও তার মূল্য বেড়ে যাবে৷ তার ফলে মার্কিন ইস্পাত কোম্পানিগুলির লাভ হলেও ক্রেতাদের বাড়তি মূল্য গুনতে হবে৷ যে কোম্পানিগুলি ইস্পাত ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন করে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Weihrauch
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া
অ্যামেরিকায় ইস্পাত রপ্তানি করতে না পারলে চীন ইউরোপের বাজারে তা আরও সস্তায় বিক্রি করার চেষ্টা করতে পারে৷ স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হলে এমন আরও দৃষ্টান্ত দেখা যেতে পারে৷ সামগ্রিকভাবে এমন অস্বাভাবিক প্রবণতা নানাভাবে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ সাম্প্রতিক নানা সংকট কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন সবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তখন নতুন করে এমন বিপদ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/XinHua
আইনি লড়াই
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংগঠন ডাব্লিইউটিও সাম্প্রতিক কালে বিশ্ব বাণিজ্যের বিধিনিয়ম স্থির করে এসেছে এবং বিবাদ মেটানোর চেষ্টা করেছে৷ বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে মামলার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে৷ সব পক্ষ ডাব্লিইউটিও-র রায় না মানলে এই সংগঠন অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে৷ এমন কাঠামো তার কার্যকারিতা হারালে ভবিষ্যতে সেই ক্ষতি পূরণ করা সহজ হবে না৷
ছবি: Reuters/N. Kharmis
7 ছবি1 | 7
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ডাব্লিউটিও'র বিধান অনুযায়ী অ্যামেরিকা থেকে ১২০টি পণ্যের আমদানির উপর শুল্ক কমানোর কথা ছিল৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সে দেশ সেই দায়বদ্ধতা আপাতত মুলতুবি রাখছে৷ চীন মনে করিয়ে দিয়েছে ডাব্লিউটিওর কাঠামোয় জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে এমন পদক্ষেপও সম্ভব৷ উল্লেখ্য, ওয়াশিংটনও জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল৷
পুরোদস্তুর বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে চীন অ্যামেরিকার উদ্দেশ্যে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ প্রত্যাহার করার ডাক দিয়েছে৷ সে ক্ষেত্রে ডাব্লিউটিওর বিধিনিয়মের আওতায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে৷ চীনের মতে, বিশ্বের দুই প্রধান অর্থনীতির মধ্যে সহযোগিতাই সঠিক পথ৷
ট্রাম্প প্রশাসন চলতি সপ্তাহে আরও কয়েকটি চীনা পণ্যের আমদানির উপর শুল্ক ঘোষণার তোড়জোড় করছে৷ এই সিদ্ধান্তকে প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে চীনের নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে৷ ফলে অ্যামেরিকার বাজারে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি মূল্যের হাইটেক চীনা পণ্যের দাম বেড়ে যাবে৷
এমন সংঘাত গোটা বিশ্বের অর্থনীতির উপর মারাত্মক আঘাত হানতে পারে বলে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন৷ পরিস্থিতি এড়াতে আলোচনার সময়ও অত্যন্ত কম৷ এসব ক্ষেত্রে সংঘাত এড়াতে ৬০ দিনের সময় স্থির করা হয়৷ কিন্তু অ্যামেরিকা ও চীন পরস্পরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করে এসেছে, এত কম সময়ে তার কারণ দূর করা অত্যন্ত কঠিন৷ তাছাড়া ওয়াশিংটন এখনো পর্যন্ত তর্জনগর্জন করলেও কোনো পদক্ষেপ কার্যকর করেনি৷ অন্যদিকে চীন অবিলম্বে বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে৷