ওয়াশিং মেশিনের জন্য বর্জ্য পানি!
২৫ জুন ২০২০নেদারল্যান্ডসে কল খুললেই জল পাওয়া যায়৷ ফলে সে দেশের শিশুদের কাছে পানি মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে৷ যেমন চিভার ও এভকা হাত ধোয়ার জন্য অনায়াসে পানি পায়৷
তা সত্ত্বেও তাদের পরিবার পানির মূল্য সম্পর্কে সচেতন৷ পরিবারের জামাকাপড় কাচার জন্য পুনর্ব্যবহৃত পানি ব্যবহার করা হয়৷
ওয়াশিং মেশিনে সংসারের ব্যবহৃত পানি ঢালা হয়৷ হাইড্রালুপ নামের এক যন্ত্রের মাধ্যমে সেই পানি পরিশোধন করা হয়৷ যথেষ্ট পরিমাণ পুনর্ব্যবহৃত পানি জমা হলে পরিবারের কর্তা ইয়ান-ভিলেম স্কোনেন এক অ্যাপের মাধ্যমে তা জানতে পারেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জীবনযাত্রায় যত সম্ভব পানি সাশ্রয় করতে ওয়াশিং মেশিনের জন্য এই অ্যাপ দেখি৷’’
নেদারল্যান্ডসে চার সদস্যের পরিবার বছরে গড়ে ১৯১,০০০ লিটার পর্যন্ত পানি ব্যবহার করে৷ হাইড্রালুপের দাবি, এই প্রযুক্তির গ্রাহকদের ৪৫ শতাংশ কম পানি প্রয়োজন হয়৷ এই প্রণালী ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়ান-ভিলেম স্কোনেন বলেন, ‘‘সন্তানসহ এখানে বসবাস করতে এসে আমাদের মনে হলো, যখন আমরা আর থাকবো না, তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কীভাবে পৃথিবীটাকে আরও ভালোভাবে রেখে যেতে পারবো? তখন মনে হলো, আমাদের ‘স্মার্ট' হয়ে আগে থেকেই ভাবনাচিন্তা করতে হবে৷’’
নেদারল্যান্ডসে আপাতদৃষ্টিতে পানির অভাব নেই৷ ঘরবাড়িতে ব্যবহারের পানির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মাটির নীচ থেকে, বাকিটা নদনদী, হ্রদ ইত্যাদি থেকে৷ ব্যবহারের পর বর্জ্য পানি পরিশোধন করে নদী ও সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় অনেক জ্বালানী খরচ হয় এবং অনেক পানি নষ্ট হয়৷
আর্টুর ফলকিসার ‘হাইড্রালুপ’ নামের বিকেন্দ্রীভূত পানি পুনর্ব্যবহার প্রণালী ডিজাইন করেছেন৷ এর আওতায় গোটা প্রক্রিয়ার একটা অংশ বাসার মধ্যেই ঘটে৷ এই প্রণালীতে ফিল্টারের বদলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ছ'টি ধাপে পানি পরিশোধন করা হয়৷ ফলকিসার বলেন, ‘‘আমরা শাওয়ার থেকে এবং কখনো ওয়াশিং মেশিন পানি সংগ্রহ করি৷ তারপর সাবান, চুল, বালু ইত্যাদি সরিয়ে সেই পানি পরিশোধন ও জীবাণুমুক্ত করি৷ তারপর ওয়াশিং মেশিন, টয়লেটের ফ্লাশ ও বাগানে সেই পানি আবার ব্যবহার করা যায়৷’’
পানি একবার মাত্র রিসাইকেল করা যায়৷ তবে সেই পানি মোটেই পানের যোগ্য নয়৷ আর্টুর ফলকিসার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘টয়লেট ফ্লাশ করার জন্য যথেষ্ট রিসাইকেলড পানি আছে কিনা, এলইডি আলো তা দেখিয়ে দেয়৷ আমি যখন ফ্লাশ করি, নীচের ট্যাংক থেকে সেই পানি আসে৷ সেই পানি কমে গেলে আলো নীল হয়ে যায়৷ তখন সাধারণ পানি ব্যবহার করতে হয়৷’’
হাইড্রালুপের দাম ৩,৩০০ ইউরো বা তার বেশি হতে পারে৷ ইউরোপ ছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রণালী বিক্রি হচ্ছে৷ এই যন্ত্র পুরানো বাড়িঘরেও বসানো যায় অথবা নতুন প্রণালীর অংশ হিসেবে কাজে লাগানো যায়৷ ফলকিসার এই ব্যবসা আরও বাড়াতে চান৷ তিনি বলেন, ‘‘এর পরের পর্যায়ে আমরা ভারত, বাংলাদেশের মতো দেশের কোম্পানিগুলির সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে যৌথ উদ্যোগে অনেক কম দামে এই প্রণালী উৎপাদন করতে চাই৷ তখন স্থানীয় বাজারেও এই প্রণালী আনা যেতে পারে৷’’
গোটা বিশ্বে পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে৷ বর্জ্য পানি পুনর্ব্যবহার অন্যতম সমাধানসূত্র হতে পারে৷ জাতিসংঘের সূত্র অনুযায়ী ৮০ শতাংশ বর্জ্য পানি যথেষ্ট পরিশোধন না করেই আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়৷
লেউভার্ডেন শহরে ‘ওয়াটার ক্যাম্পাস’-এ হাইড্রালুপের মতো কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সমন্বয় ঘটায়৷ হাইন মোলেনকাম্প ওয়াটার অ্যালায়েন্স গোষ্ঠীর ডিরেক্টারদের একজন৷ তিনি বলেন, ‘‘ওয়াটার ক্যাম্পাসে আমরা কোম্পানিগুলিকে গবেষণার গতি বাড়িয়ে পণ্য বাজারজাত করতে সহায়তা করি৷ একদিকে বাজারে চাহিদা রয়েছে, অন্যদিকে কোম্পানির মধ্যেও নানা আইডিয়া রয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত তাদেরই উপযুক্ত পণ্য বাজারে আনতে হবে৷’’
সংশ্লিষ্ট কোম্পানি, আঞ্চলিক সরকার ও ইউরোপীয় কমিশনসহ কয়েকটি উৎস থেকে ওয়াটার ক্যাম্পাসের ব্যয়ভার বহন করা হয়৷
কোম্পানিগুলি নিজস্ব আইডিয়া পরীক্ষা করে পণ্য তৈরি করার লক্ষ্যে এখানে আন্তর্জাতিক কোম্পানি ও স্টার্ট আপের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নিতে পারেন৷ সাধারণত এমন প্রক্রিয়ার জন্য কয়েক দশক সময় লেগে যায়৷ এই মঞ্চে সহযোগিতার ফলে কেই কাজ অনেক দ্রুত করা সম্ভব৷ হাইন মোলেনকাম্প বলেন, ‘‘বিশ্বের বড় চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান করতে ওয়াটার ক্যাম্পাস কীভাবে নতুন টেকসই প্রযুক্তি বাজারে আনতে সাহায্য করবে, সেটাই এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়৷ যেমন আমরা কীভাবে আরও খাদ্য উৎপাদন করবো? কীভাবে আরও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে স্যানিটেশন নিশ্চিত করা সম্ভব? আমাদের একার পক্ষে এমন সব বড় বিষয় সমাধান করা সম্ভব নয়৷ একমাত্র সহযোগিতার মাধ্যমে এ সব করা যায়৷’’
স্কোনেন পরিবারের সন্তানরা আপাতত পানি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছে না৷ কিন্তু ভবিষ্যতে সেই পরিস্থিতি অবশ্যই বদলে যেতে পারে৷ ইয়ান-ভিলেম বলেন, ‘‘আমাদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট আরও না কমালে এমনিতেই সবকিছু শেষ হয়ে যাবে৷ তাই কোনো এক সময়ে পরিবেশ বদলা নেবে৷ তখন খরার ফলে খাদ্য ও পানির অভাব দেখা দেবে, যুদ্ধও হতে পারে৷ আমরা এমনটা চাই না৷ তাই কিছু একটা করতে হবে৷’’
এখনই পানি সংরক্ষণের উপায় শেখা সন্তানদের প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে৷
লুইস অসবোর্ন/এসবি