ফের বিতর্কে ট্রাম্প প্রশাসন। ইসরায়েলের পশ্চিম তীরে গিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করলেন বিদেশ সচিব পম্পেও।
বিজ্ঞাপন
এ বার ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক বা পশ্চিম তীর নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য ট্রাম্প প্রশাসনের। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব মাইক পম্পেও ইসরায়েল সফরে গিয়ে আচমকাই পশ্চিম তীরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই প্রথম কোনো মার্কিন সচিব পশ্চিম তীরে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি বলেছেন, পশ্চিম তীরে তৈরি হওয়া জিনিস 'মেড ইন ইসরায়েল' বলেই বিদেশে রপ্তানি করা উচিত। কারণ, এটি ইসরায়েলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পম্পেও-র এই মন্তব্যের পরে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছে ফিলিস্তিন এবং আরব বিশ্বে।
ট্রাম্প মানেই বিতর্ক। গত চার বছরে অ্যামেরিকা তো বটেই, গোটা বিশ্বই তা বুঝে গিয়েছে। নির্বাচনে জো বাইডেন জিতলেও বিতর্ক থামাননি ট্রাম্প। এখনও পদ ছাড়তে রাজি হননি তিনি। গত চার বছরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একাধিক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প এবং পম্পেও। কিছু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। এই মুহূর্তে আফগানিস্তান থেকে সেনা ফেরানো নিয়ে নতুন বিতর্ক জড়িয়েছেন। তারই মধ্যে, প্রেসিডেন্সির একেবারে শেষ অধ্যায়ে পম্পেওকে ইসরায়েল সফরে পাঠান ট্রাম্প।
রেস্তোরাঁয় শেফ-এর সহকারি হওয়ার আশায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন ফিলিস্তিনের প্রতিবন্ধী তরুণ ইয়াদ হালাক৷ প্রতিদিনের মতো সেদিনও হেঁটে যাচ্ছিলেন স্কুলে৷ ইসরায়েলের পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে তাঁকে৷ ছবিঘরে দেখুন বিস্তারিত....
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Milstein
ইয়াদ হালাকের কী অপরাধ?
ইয়াদ হালাক৷ বয়স ৩২৷ তবে আচরণে ঠিক আট বছরের শিশুর মতো৷ স্বপ্ন ছিল বড় কোনো রেস্তোরাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট শেফ হবেন৷ এলউইন এল কুদস সেন্টারে চলছিল প্রশিক্ষণ৷ মে মাসের শেষ শনিবার সকালে পূর্ব জেরুসালেমের পুরাতন শহর থেকে হেঁটে সেখানেই যাচ্ছিলেন৷ ইসরায়েলের সীমান্ত পুলিশ পথেই গুলি করে হত্যা করে তাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Gharabli
পুলিশের মিথ্যা বিবৃতি
লায়ন্স গেটের কাছে গুলি করে হত্যা করার পর ইয়াদ হালাকের পরিচয় এভাবেই তুলে ধরেছিল ইসরায়েলের সীমান্ত্র পুলিশ৷ এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ’’পিস্তলের মতো একটা সন্দেহজনক জিনিস নিয়ে এক ব্যক্তিকে হেঁটে যেতে দেখা যায়৷’’ বাধা দিতে চাইলে সে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে এবং পুলিশ তাকে ‘‘দৌড়ে তাড়া করে’’৷ বারবার থামতে বলা সত্ত্বেও না থামায় তাকে গুলি করতে বাধ্য হয় পুলিশ৷
এক শিক্ষিকার আপ্রাণ চেষ্টা
ইয়াদ হালাকের এক শিক্ষিকা দূর থেকে দেখছিলেন পুরো ঘটনা৷ শিক্ষার্থীর বিপদ দেখে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি৷ ইসরায়েলি পুলিশ কর্মকর্তাদের হিব্রু ভাষায় চিৎকার করে বলছিলেন, ‘‘ও প্রতিবন্ধী৷ ও কারো ক্ষতি করে না৷’’ তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ কেউ শোনেনি তাঁর কথা৷ রাস্তার পাশের এক ডাস্টবিনের আড়ালে লুকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন ইয়াদ৷ পুলিশের গুলিতে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে তাঁর দেহ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Milstein
ইসরায়েলি পুলিশের ভুল স্বীকার
পরে ইয়াদ হালাকের কাছে যে কোনো অস্ত্র ছিল না তা স্বীকার করে নেয় ইসরায়েলের পুলিশ৷ তার কাছে কোনো পিস্তল বা অন্য কোনো আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া না যাওয়ার কথা স্বীকার করা হয় এক বিবৃতিতে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Getty Images/AFP/A. Gharabli
তদন্ত শুরু
ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে ইসরায়েলের বিচার মন্ত্রণালয়৷ মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র জানান, ঘটনায় জড়িত দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Getty Images/AFP/A. Gharabli
‘ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা সহজ’
ইয়াদ হালাকের এমন মৃত্যুতে এলউইন এল কুদস সেন্টারে নেমেছে শোকের ছায়া৷ স্থানীয়রাও শোকাহত এবং ক্ষুব্ধ৷ এলউইন এল কুদস সেন্টারের অন্য শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকরা আতঙ্কিত৷ এক ছাত্রীর বাবা ইমাদ মুনা বলছিলেন, ‘‘ (ইসরায়েলের) ওই লোকগুলোর কাছে হত্যা যেন সহজ একটা ব্যাপার৷ বিষয়টা খুব আতঙ্কের৷ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা সহজ৷’’ (ফাইল ফটো)
ছবি: Getty Images/AFP/M. Hams
যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড, ফিলিস্তিনে ইয়াদ হালাক
ইয়াদ হালাক হত্যার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা৷ পশ্চিম তীরের বেথেলহাম শহর এবং জেরুসালেমের বিক্ষোভ সমাবেশে ইয়াদের প্রতি ইসরায়েলি পুলিশের নিষ্ঠুরতাকে তারা তুলনা করেছেন জর্জ ফ্লয়েডের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশের আচরণের সঙ্গে৷ ‘ ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’-এর মতো করে তাই অনেক বিক্ষোভকারী তাদের প্ল্যাকার্ডে লিখেছেন, ‘প্যালেস্টিনিয়ান লাইভস ম্যাটার৷’
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Milstein
ইসরায়েলেও প্রতিবাদ
ইসরায়েলের মানবতাবাদীরাও বসে নেই৷ ইয়াদ হালাক হত্যায় জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবিতে তেল আবিব, জাফা এবং আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন তারা৷
ছবি: DW
‘ওখানে যাওয়া ছিল ওর আনন্দ’
বাবা কাহেইরি হালাক জানালেন, বয়স ৩২ হলেও আসলে ইয়াদ ছিলেন আট বছরের শিশুর মতো৷ প্রথম এক মাস এক শিক্ষক স্কুলে নিয়ে যান তাকে৷ তবে পথ চিনে ফেলার পর একাই হেঁটে যেতে চাইতেন৷ শিক্ষকরা ইয়াদকে বুঝিয়েছিলেন, ‘‘স্বাবলম্বী হতে হবে, স্বাধীনভাবে একা চলতে হবে৷’’ একা স্কুলে যেতে দিয়ে সন্তান হারানোর শোক মানতে পারছেন না কাহেইরি হালাক! মানতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর সন্তান আর কোনোদিন ফিরে আসবে না৷
ছবি: picture-alliance/AA/M. Alkharouf
ইসরায়েলের দুঃখ প্রকাশ
এক মন্ত্রিসভা বৈঠকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গানৎস বলেছেন, ‘‘এ ঘটনায় আমরা সত্যিই দুঃখিত৷ (ইয়াদ হালাকের) পরিবারের শোকের অংশীদার আমরাও৷’’ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘ইয়াদ হালাকের সঙ্গে যা ঘটেছে তা বড় ধরনের ট্র্যাজেডি৷ তিনি প্রতিবন্ধী ছিলেন, অথচ অতি স্পর্শকাতর একটি স্থানে কোনো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া তাকে জঙ্গি মনে করা হয়েছে৷"
ছবি: Reuters/M. Kahana
10 ছবি1 | 10
পম্পেওর ইসরায়েল সফরের উদ্দেশ্য ছিল নেহাতই ধন্যবাদ জ্ঞাপন। গত চার বছরে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের। সে কারণেই তাঁর সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাতে গিয়েছিলেন পম্পেও। কিন্তু ইসরায়েল পৌঁছে তিনি ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই প্রথম কোনো মার্কিন সচিব পশ্চিম তীর গেলেন। সেখানে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময়ও কাটান তিনি। ঘুরে দেখেন কয়েকটি অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখান থেকে ফিরেই বিতর্কিত মন্তব্যটি তিনি করেন। এখানেই শেষ নয়। পম্পেও গোলান হাইটসেও যান। সিরিয়ার থেকে ১৯৬৭ সালে এই অংশটি দখল করে ইসরায়েল। এই জায়গাটি নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। গোলান হাইটসকেও পম্পেও ইসরায়েলের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করে দেন।
পশ্চিম তীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের বিতর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলেও পশ্চিম তীর বিতর্কিত অংশ বলে চিহ্নিত। যে কারণে, এলাকাটি ইসরায়েলের দখলে রয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহলে উল্লেখ করা হয়। গোলান হাইটস নিয়েও একই বিতর্ক রয়েছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে। কিন্তু পম্পেও-র বক্তব্য একপ্রকার স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে ইসরায়েলকে। যা নিয়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক।
ফিলিস্তিনের নেতা এবং বিভিন্ন আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হানান আশরাউই বলেছেন, ''ট্রাম্প প্রশাসনের আরও একটি বেআইনি এবং অবৈধ বক্তব্য শুনলাম আমরা। তারা যে আন্তর্জাতিক আইনেরও তোয়াক্কা করে না, তা আরো একবার প্রমাণিত হলো। পম্পেও-র মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করছি। এর ফলে সমস্যা আরো বাড়লো।''
অন্যদিকে সিরিয়ার সরকার পম্পেও-র গোলান হাইটসে যাওয়া এবং তা ঘিরে মন্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সরকারের বিবৃতিতে পম্পেওকে নেশাগ্রস্ত বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, যাওয়ার আগে নতুন এক অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে দিয়ে গেল ট্রাম্প প্রশাসন।