ক্যাম্পে ঢুকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে খুন করল দুষ্কৃতীরা। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
বুধবার রাত সাড়ে আটটা নাগাদ কক্সবাজারের উখিয়ায় লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে একদল দুষ্কৃতী। ক্যাম্পে ঢুকে তারা সোজা মুহিবুল্লাহর কাছে চলে যায়। সামনে থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করে পালায় ওই দুর্বৃত্তরা। গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গা নেতাকে উদ্ধার করে কুতপালং এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। দুর্বৃত্তরা যখন ক্যাম্পে আসে, তখন ক্যাম্পের বাইরে আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুষ্কৃতীদের ধরা যায়নি।
ভাসানচরে স্থানান্তর: কী বলছেন রোহিঙ্গারা
শুক্রবার রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচ ভাসানচরে পৌঁছেছে৷ তাদের অনেকে সেখানকার সুযোগ-সুবিধা দেখে ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন৷ তবে জোর বা নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ভাসানচর প্রকল্প
প্রায় তিন হাজার একশ কোটি টাকা খরচ করে ভাসানচরে আশ্রয়ন প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার৷ সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, ভাসানচরে যাওয়া প্রত্যেক রোহিঙ্গা পরিবার আলাদা ঘর পাচ্ছে, আছে রান্নার ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পানি আর পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা৷ সেই সঙ্গে আছে খেলার মাঠ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ৷
ছবি: DW/A. Islam
প্রথম ব্যাচ পৌঁছেছে
বাসে ও জাহাজে করে প্রথম ধাপে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা শুক্রবার ভাসানচরে পৌঁছেছেন৷ পরে তাদের অনেককে মোবাইল ফোনে কক্সবাজারে থাকা সঙ্গীদের ভাসানচরের খবর দিতে দেখা গেছে৷ কেউ কেউ ভিডিও কলও করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
বাবা-মাকে আনতে চান হোসেন
কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্প থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাসনচরে গেছেন মোহাম্মদ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে অনেক ভালো লাগছে৷ আমি এখানে ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার যাবো৷ ওখানে গিয়ে তাদের (বাবা-মা ও ভাইয়ের পরিবার) নিয়ে আসবো৷ তারা যদি না আসে, তাহলে আমি আবার এখানে ফিরে আসবো৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
‘আল্লাহ মিলায়ে দিছে’
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে গেছেন মোহাম্মদ জোবায়ের৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এত ভালো পরিবেশের কথা আমরা ভাবতেই পারছি না৷ জীবনে আমরা এত ভালো বাসায় থাকতে পারিনি, থাকতে পারব এটাও আশা করিনি৷ আল্লাহ আমাদের মিলায়ে দিছে৷’’
ছবি: bdnews24.com
নিরাপত্তাবোধ
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাওয়া আবদুর রহমান এখন নিজেকে কিছুটা নিরাপদ ভাবছেন৷ ‘‘ওখানে (বালুখালী ক্যাম্পে) ঘরের বেড়া কেটে চুরি করে নিয়ে যেতো৷ ঘুমিয়ে থাকলে ছুরিও মারতো৷ এখানে তা পারবে না৷ যে ঘরটা পেলাম, সেটা খুবই নিরাপদ৷ কেউ চাইলেই চুরি করতে বা ঘরে ঢুকতে পারবে না৷’’
ছবি: DW/A. Islam
‘লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে’
বালুখালীর ক্যাম্প থেকে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়ে ভাসানচরে যাওয়া আব্দুস সামাদ বলেন, ‘‘এখানে এসে খুব ভালো লাগছে৷ ঘরবাড়ি অনেক৷ অনেক বড় বড় রুম৷ এখানে লেখাপড়ার জন্য স্কুল, মাদ্রাসা আছে৷ বড় খেলার মাঠ আছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে জায়গা কম৷ মানুষ অনেক৷ একজন বের হলে আরেকজন বের হওয়ার জায়গা থাকে না৷’’
ছবি: DW/N. Conrad
পার্থক্য
ভাসানচর আর কক্সবাজারের পরিবেশের পার্থক্য সম্পর্কে জমিনা আক্তার বলেন, ‘‘এখানে বেশি ভালো লাগছে৷ ভালো ঘর, থাকার জায়গা ভালো৷’’
ছবি: bdnews24.com
নির্যাতনের অভিযোগ
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিতে বৃহস্পতিবার কক্সবাজারের উখিয়ায় একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে নেয়া হয়েছিল৷ সেখানে উপস্থিত ৬০ বছর বয়সি শরণার্থী সুফিয়া খাতুন এএফপিকে জানান, ‘‘আমার ছেলে যেন ঐ দ্বীপে যেতে রাজি হয় সেজন্য তারা আমার ছেলেকে নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে, তার দাঁত ভেঙে ফেলেছে৷ আমি এখানে তাকে ও তার পরিবারকে হয়ত শেষবারের মতো দেখতে এসেছি৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
‘নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না’
ট্রানজিট ক্যাম্পে উপস্থিত আরেক শরণার্থী হাফেজ আহমেদ এএফপিকে বলেন, ‘‘গত দুইদিন ধরে আমার ভাই নিখোঁজ ছিল৷ আমরা জানতে পেরেছি, সে এখানে আছে৷ এখান থেকে তাকে দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হবে৷ সে সেখানে নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
জাতিসংঘের আশঙ্কা, অভিযোগ
জাতিসংঘের আশঙ্কা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে ভাসানচরে পানি উঠে গিয়ে রোহিঙ্গাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়ে উঠতে পারে৷ এছাড়া রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘকে যুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ তাদের৷ ভাসানচরে স্থানান্তর প্রসঙ্গে রোহিঙ্গারা যেন ‘স্বাধীন ও তথ্যসমৃদ্ধ’ সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
ছবি: DW/A. Islam
‘ভুল ব্যাখ্যা’ না দেয়ার অনুরোধ
রোহিঙ্গারা ‘স্বেচ্ছায়’ ভাসানচরে গেছে জানিয়ে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ বলেছে, ‘‘জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একমাত্র বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হওয়া উচিত প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে ও কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত হওয়া, সেটাই একমাত্র স্থায়ী সমাধান৷ একইসঙ্গে বাংলাদেশের আন্তরিক চেষ্টাকে খাটো করা ও ভুল ব্যাখ্যা না করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে সবার প্রতি আমরা আহ্বান জানাচ্ছি৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বিএনপির বক্তব্য
রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ায় তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে বলে মনে করছে বিএনপি৷ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে উপেক্ষা করে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়াকে ‘আত্মহনন’ বলেও আখ্যায়িত করেছে দলটি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
12 ছবি1 | 12
দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্দোলন করছেন মুহিবুল্লাহ। কীভাবে তারা দেশে ফিরে যেতে পারেন, তা নিয়েও আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোচনা করেছেন তিনি। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে দেখা করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। আলোচনা করেছিলেন রোহিঙ্গাদের সমস্যা এবং তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। এর আগে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
মুহিবুল্লাহের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের দাবি, বেশ কিছুদিন ধরে রোহিঙ্গা নেতাকে খুনের ষড়যন্ত্র চলছিল। একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাকে মারার চেষ্টা চালাচ্ছিল। তাকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। ঘনিষ্ঠদের এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। ক্যাম্পের ভিতরেই একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় বলে অভিযোগ ওই ব্যক্তিদের।
সংবাদমাধ্যমকে তারা জানিয়েছেন, বুধবার এশার নামাজের পর লম্বাশিয়ার শিবিরে এআরএসপিএইচের কার্যালয়ে বসে গল্প করছিলেন মুহিবুল্লাহ। সে সময়েই তার উপর হামলা চালায় আল-ইয়াকিন নামে রোহিঙ্গাদেরই একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দুষ্কৃতীরা পাঁচটি গুলি চালায় মুহিবুল্লাহকে লক্ষ্য করে। তার বুকে তিনটি গুলি লাগে। এরপরই রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
৪৮ বছরের মুহিবুল্লাহকে স্থানীয় মানুষ মাস্টার মুহিবুল্লাহ বলে ডাকতেন। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিশাল সমাবেশেরও আয়োজন করেছিলেন তিনি। কীভাবে দেশে ফেরা যায়, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই সরব তিনি। তারই জেরে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি তার উপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল বলে মুহিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অনুমান।