কঙ্গোর কাহুজি-বিয়েগা জাতীয় অরণ্যে বাস করেন শতাব্দীপ্রাচীন বাটওয়া জনগোষ্ঠী। কঙ্গোর সেনা তাদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালাচ্ছে।
ছবি: Mariel Müller/DW
বিজ্ঞাপন
১৯৮০ সালে জার্মানির অনুদানে কাহুজি-বিয়োগা জঙ্গলটিকে জাতীয় অরণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গোরিলাদের মুক্তভূমি এই অরণ্য। এই জঙ্গলেই বহু শতাব্দী ধরে বসবাস করে বাটওয়া জনজাতি। অরণ্যবাসী এই জনজাতি জঙ্গল নষ্ট করেছে, এমন রিপোর্ট নেই। কিন্তু ১৯৮০ সালে ওই জঙ্গল জাতীয় অরণ্য ঘোষণা হওয়ার আগেই ১৯৭৬ সালে জঙ্গল থেকে প্রায় ছয় হাজার অরণ্যবাসীকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের খুন করা হয়, ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ।
অস্তিত্বের যুদ্ধে বনোবো
মানুষের সবচেয়ে নিকটাত্মীয় বনোবো৷ আবার সেই মানুষই তাদের প্রধানতম শত্রু৷ আর কয়েক হাজার বনোবো টিকে আছে কোনোরকমে৷ প্রতিনিয়ত লড়াই করছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে৷ তবে এই প্রজাতি রক্ষায় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে আফ্রিকার দেশ কঙ্গো৷
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
আমাদের স্বজন
গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গোতে বিলুপ্তির পথে বনোবো৷ চার দশক আগেও এদের সংখ্যা ছিল লাখখানেক৷ আজকের দিনে এসে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ হাজারে৷ তাদের অস্তিত্বের লড়াইয়ে মানুষই সবচেয়ে বড় হুমকি৷ এই প্রজাতির শিম্পাঞ্জির বাচ্চাগুলো শিকার করে পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি করা হয়৷ এছাড়াও প্রাণীটির মাংস চড়া দামে বিক্রি হয় বাজারে৷ আর প্রতিনিয়ত বনভূমি উজাড়ের কারণে বনোবো হারাচ্ছে তাদের বসত-ভিটা৷
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
সাঁতার কাটা তাদের কম্ম নয়
গোটা বিশ্বে এই প্রজাতির যত শিম্পাঞ্জি আছে সবার বসতি কঙ্গোতে৷ বিশেষ করে আফ্রিকার এই দেশটির অববাহিকা তাদের আপন আলয়৷ অববাহিকাটাও বিশাল৷ বলা হচ্ছে, এটি ফ্রান্সের চেয়ে তিনগুণ বড়৷ কঙ্গো নদীসহ পুরো অঞ্চলটি ঘিরে আছে আরো কয়েকটা নদ-নদী৷ এই অববাহিকা ছাড়া অন্য কোথাও যেতেও চায় না বনবোরা৷ মানুষের নিকটাত্মীয় হলেও সাঁতারটা আয়ত্ত্ব করতে পারেনি আজও৷
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
মিল-অমিলের হিসাব-নিকাশ
বনোবোর সঙ্গে মানুষের ডিএনএ-র মিল প্রায় ৯৮ ভাগ৷ গরিলা কিংবা অন্য প্রজাতির শিম্পাঞ্জির তুলনায় বনোবোর সঙ্গে মানুষের ডিএনএ গঠনের মিলটা সবচেয়ে বেশি৷ তাই স্বভাবেও অনেক মিল দেখা যায়৷ আবার লক্ষ্যণীয় কিছু অমিলও আছে৷ এমনকি এইচআইভি/এইডস রোগেও আক্রান্ত হতে পারে৷ তবে ম্যালেরিয়া থেকে সুরক্ষিত বনোবো৷
ছবি: picture-alliance/imageBROKER/I. Kuzmin
যুদ্ধ নয়, ভালোবাসা
মনের ভাব প্রকাশে ভাষা না থাকলেও, বনোবোর লক্ষ্য হলো, ‘ভালোবাসো, যুদ্ধ করো না৷’ যুদ্ধ-সংঘাত এড়িয়ে চলে এই প্রাণীটি৷ লড়াই-ঝগড়া ছাড়া যখন কোনো বিকল্প নেই, তখন আলিঙ্গন আর পারস্পরিক মধ্যস্থতাতে বিশ্বাস রাখে তারা৷ তাদের সমাজটি অবশ্য মানুষের মতো পুরুষশাসিত নয়৷ নারীরাই এখানে শক্তিশালী এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে নারী বনোবো সবসময় ভূমিকা রাখে৷
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
লোলা ইয়া বনোবো
অনাথ বনোবোর জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলটিকে বলা হয় ‘লোলা ইয়া বনোবো’ বা ‘বনোবোর স্বর্গ৷’ কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসার কাছে আছে পেটিটেস চুটেস দে লা লুকায়া জলপ্রপাত৷ আর সেই প্রপাত থেকে দক্ষিণে গেলেই দেখা মিলে সংরক্ষিত অঞ্চলটির৷ ১৯৯৪ সালে এই সংরক্ষিত অঞ্চলটির যাত্রা শুরু হয়৷ পাচারের হাত থেকে অনাথ বনোবোদের রক্ষা করে তাদের জন্য বন্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগটি গ্রহণ করেন বেলজিয়ান বন সংরক্ষক ক্লডিন আন্দ্রে৷
মনস্তাত্ত্বিক যত্নআত্তিও শারীরিক চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ৷ অনেক সময় মা হারানোর বেদনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে নবজাতক বনোবো৷ এ ধাক্বা সইতে না পেরে কয়েকটি বনোবোর বাচ্চা মারাও গেছে৷ এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঠেকাতে নারীর কোলে তুলে দেয়া হয় শিশু বনোবোকে৷ ভালোবাসা আর যত্নআত্তি নিয়ে মানব কোলেই বড় হয় তারা৷ শক্তপোক্তভাবে গড়ে তুলতে, অন্তত চার বছর পর্যন্ত বনোবোর বাচ্চাকে আদর-ভালোবাসা দিতে হয়৷
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
বনোবোর বিচরণভূমি
ইক্যুয়েটর প্রদেশই হলো এ প্রাণীর প্রাকৃতিক নিবাস, যার আয়তন ম্যানহাটনের প্রায় দুই গুণ৷ সাধারণ বনাঞ্চলের পরিমাণ সেখানে ২০ হাজার হেক্টর৷ স্থানীয়ভাবে এটি ‘একোলো ইয়া বনোবো’ নামে পরিচিত, যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বনোবোদের বিচরণ ভূমি৷’
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
লোলা ইয়া বনোবো ঘিরে আছে গ্রীষ্মমণ্ডলিয় বনভূমি৷ সেখানে ৭৫ হেক্টর বনভূমিতে বাস করছে ৬০টিরও বেশি বনোবো৷ এখানেই উদ্ধার পাওয়া বনোবোদের যত্ন-আত্তি আর চিকিৎসাটা করা হয়৷ অন্য বনোবোদের সঙ্গে থাকার উপযোগী হওয়া পর্যন্ত তাদের ঠিকানা হয় এই বনভূমিটি৷ ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এখানে বেড়ে ওঠা বনোবোদের দুটি দলে ছাড়া হয়েছে তাদের প্রকৃত ঠিকানায়৷
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
মানুষের হাতেই ভবিষ্যৎ
লোলা ইয়া বনোবো ঘুরে দেখতে বছরে অন্তত ত্রিশ হাজার প্রকৃতিপ্রেমী ভিড় করেন৷ তাঁদের বেশিরভাগই কঙ্গোর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী৷ বলা যায়, শুধু দেশটির ভবিষ্যতের কর্ণধারই নয়, বরং বনোবোর বিষয়েও সিদ্ধান্ত প্রণেতা তাঁরাই হবেন৷ এই প্রজাতি রক্ষায় কেউ যদি এগিয়ে আসে, এই শিক্ষার্থীদেরই আসতে হবে৷ আর এখন বনোবোদের স্থানীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন যাঁরা, তাদের বলা হয় লোংলা পো৷
ছবি: Imago Images/Nature Picture Library/C. Ruoso
9 ছবি1 | 9
সম্প্রতি কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন রিপোর্টে জানিয়েছে, গত তিনবছর ধরে ফের ওই জনগোষ্ঠীর উপর চূড়ান্ত অত্যাচার শুরু হয়েছে। ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো এবং জঙ্গলের রেঞ্জাররা ওই জনগোষ্ঠীর মানুষদের লাগাতার ধর্ষণ করছে বলে অভিযোগ। গ্রামে ঢুকে তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হত্যা করা হচ্ছে। জঙ্গলের অদূরে একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বহু বাটওয়া জনজাতির মানুষ। তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হার হিম হয়ে যাওয়ার মতোই।
মানবাধিকার সংগঠনগুলি কথা বলেছিল কিবিবি কালোবার সঙ্গে। ৩০ বছরের কিবিবির পাঁচ সন্তান। জঙ্গলের গ্রামে থাকতেন। একদিন তিনি যখন মাঠে কাজ করছেন, শুনতে পেলেন আক্রমণ হয়েছে। বাড়ি পৌঁছে দেখেন, আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ছাই থেকে ধোঁয়া বার হচ্ছে। একটি লাঠি নিয়ে ছাইয়ের স্তূপ ঘাঁটতে শুরু করেন তিনি। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে দুই সন্তানের মাথার খুলি। কঙ্গোর সেনা বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে জীবন্ত মেরে ফেলেছিল দুই কোলের শিশুকে।
ছবি: Mariel Müller/DW
বাকি তিন সন্তানকে নিয়ে এখন ওই ক্যাম্পে বসবাস করছেন কিবিবি। জানিয়েছেন, সেখানে খাওয়ার জল নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই। কিবিবির মতো আরো মানুষ বাস করছেন ওই ক্যাম্পে। তারা জানিয়েছেন, সেনা জঙ্গলে ঢুকে গ্রামের মানুষের হাত কেটে দেয় প্রথমে। তারপর তাদের হত্যা করা হয়। কাটা হাত দেখানো হয় সকলকে। যাতে কেউ আর গ্রামে না থাকে।
প্রশাসনের দাবি, ওই জঙ্গল জাতীয় অরণ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বলেই তাকে মানুষমুক্ত করার চেষ্টা চলছে। তবে ধর্ষণ এবং খুনের কথা প্রশাসন স্বীকার করেনি। বরং তাদের দাবি, জঙ্গলের মানুষের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলির দাবি, বিকল্প যে ক্যাম্প তৈরি হয়েছে, তা বসবাসের অযোগ্য।