নিজ জায়গা থেকে ঈদ করতে বলেছে সরকার, ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে বের হওয়া ও ফেরার পথ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ৷ তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না ঈদযাত্রা৷
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে দেশে প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ আছে গণপরিবহন৷ প্রতিদিনই রেকর্ড সংখ্যায় নতুন রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন সরকার ঈদের ছুটি অন্তর্ভুক্ত করে সাধারণ ছুটির মেয়াদ আগামী ৩০ মে পর্যন্ত বাড়িয়েছে এবং জনগণকে এ বছর যে যেখানে আছে সেখানে থেকেই ঈদ উদযাপনের পরামর্শ দিয়েছে৷
ঘরমুখো মানুষের স্রোত আটকাতে ঈদের আগে ও পরে সাত দিন জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষের যাতায়াত আটকাতে ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় নেমেছে প্রশাসন৷
রোববার মাঠ পর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে আইজিপি বেনজীর আহমেদ রাজধানী ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানায় বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনেটন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷
বেনজীরের নির্দেশ ছিল, ‘‘সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত যেন কোনোভাবেই ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় এবং ঢাকা থেকে ঢাকার বাইরে কেউ যেতে না পারে৷ একইভাবে প্রতিটি জেলা ও মহানগরীতেও জনস্বার্থে কঠোরভাবে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হবে৷’’
রোববার সকাল থেকেই রাজধানী ছাড়তে উদ্যোত মানুষের ঢল আটকাতে সড়কগুলোতে পুলিশের সক্রিয় ভূমিকায় থাকার খবর নানা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে৷ তারপরও মানুষের ঢাকা ছাড়া থেমে নেই৷
গণপরিবহন বন্ধ থাকায় মানুষ নিজের বা ভাড়া গাড়িতে চেপে বাড়ির পথে রওয়ানা হয়েছেন৷ কেউ কেউ ছোট ছোট যানবাহনে চড়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পথ পাড়ি দিচ্ছেন৷
রোববার দক্ষিণাঞ্চলমুখী অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ি মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে ঢাকায় ফেরতও পাঠিয়েছে পুলিশ৷ ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের প্রবেশ মুখ সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়ায় চেক পোস্ট বসিয়ে পুলিশ এ কাজ শুরু করেছে৷ জরুরি পণ্যবাহী যান এবং জরুরি কোনো প্রয়োজন ছাড়া কেউ এই চেক পোস্ট পার হতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে পুলিশ৷
কিন্তু থামছে না মানুষ৷ একদিক দিয়ে যেতে ব্যর্থ হলে গাড়ি ঘুরিয়ে অন্যদিকে রওয়ানা হচ্ছে৷ ফলে সোমবার অনেকটা বাধ্য হয়েই মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া নৌপথে সব ধরনের ফেরি চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
করোনা সংক্রমণ রোধে জেলা প্রশাসনের অনুরোধে সোমবার বেলা ১১টা থেকে সব ধরনের যাত্রী ও যানবাহন পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানায় ফেরি কর্তৃপক্ষ৷
এই নিষেধাজ্ঞা কতদিন বহাল থাকবে তা জানতে ডয়চে ভেলে থেকে টেলিফোনে বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি৷
স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানায়, এই ঘাট দিয়ে রোববার মধ্যরাত থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি পারাপার বন্ধ করে দিয়ে শুধু পণ্যবাহী গাড়ি পারাপারের জন্য চার-পাঁচটি ফেরি সচল রাখা হয়েছিল৷ কিন্তু ফেরিগুলো ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে শতশত মানুষ নদী পার হওয়ার জন্য হুড়মুড় করে ফেরিতে উঠে যেত৷
ফলে কর্তৃপক্ষ ফেরি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়৷ যার ফলে এখন পণ্যবাহী পিবহনগুলো নাদী পার হতে না পেরে বিপাকে পড়েছে৷
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের গোলড়া এলাকায়ও রোববার থেকে পুলিশ তল্লাশি চৌকি বসিয়ে জরুরি ও পণ্যবাহী পরিবহন ছাড়া বাকি যানবাহন ফিরিয়ে দিচ্ছে৷ পুরো সড়কে চলছে পুলিশি টহল৷
৯ মে’র ছবিঘরটি দেখুন...
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
এরইমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমেছে ব্যাপকভাবে৷ দেখা দিয়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ার শঙ্কা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
রপ্তানি ধস
লকডাউনের কারণে ইউরোপ ও অ্যামেরিকায় ব্যবসা বাণিজ্য, মানুষের কেনাকাটা কার্যত বন্ধ৷ এসব দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে, কয়েকশো কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করেছে৷ এর প্রভাবে এপ্রিলে রপ্তানি আয় নেমে এসেছে মাত্র ৫২ কোটি ডলারে, যা আগের বছরে একই মাসের চেয়ে ৮২.৮৫% কম৷ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসেব বলছে চলতি বছর সারা বিশ্বেই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ৩২% পর্যন্ত কমতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yu Fangping
প্রবাসী আয়ে টান
এপ্রিলে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ ভাগ কমেছে৷ প্রবাসী আয়ের সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে৷ জ্বালানি তেলের দাম কমায় তাদের অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়েছে৷ সেইসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা৷ এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স গত বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ কমে যাবে, বলছে বিশ্বব্যাংক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/R. Abd
চাকুরির অনিশ্চয়তা
দেশের ভিতরে যে লকডাউন পরিস্থিতি চলছে তার কারণেও বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও সেবাখাতগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ৷ এসব প্রতিষ্ঠানে যারা চাকুরি করছেন, যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকছে৷ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক চীনে করোনার প্রকোপ শুরুর পর বলেছিল, বাংলাদেশের প্রায় নয় লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে৷ তবে এখন তৈরি পোশাক খাতেই অনেক শ্রমিকের চাকুরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
খাদ্য নিরাপত্তা
গত বছরের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল, এই সময়ে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩.৫৩ লাখ মেট্রিক টন৷ নতুন বছরে তা ১০ লাখ মেট্রিক টন বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ৷ সরকারের খাদ্য গুদামে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে৷ বোরো মৌসুমে আরো ২০ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে সরকার৷ সেক্ষেত্রে খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার আশংকা তেমন নেই৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের হাতে খাদ্য কেনার টাকা থাকবে কিনা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
দারিদ্র্য বাড়ছে
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সোয়া তিন কোটির বেশি৷ এর বাইরে গত দেড় যুগে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ উপার্জন না থাকলে দ্রুতই তারা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন৷ ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক জরিপেও দেখা গেছে করোনার প্রভাবে দেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ ভাগ কমে গেছে, হতদরিদ্র বা যাদের দৈনিক আয় ১৬০ টাকার কম এমন মানুষের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সরকারের প্রণোদনা
অর্থনীতি বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের সরকারও আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যার আকার ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এর বড় একটি অংশ দেয়া হবে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প আর কৃষি খাতে ঋণ হিসেবে৷ পাশাপাশি লক-ডাউনের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের ব্যাংক হিসাব তৈরি করে এককালীন নগদ অর্থ প্রদানের কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোরও৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
টাকার সন্ধান
বাজেটের ঘাটতি মেটাতে এরিমধ্যে ব্যাংক থেকে সারাবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করে ফেলেছে সরকার৷ নতুন ঋণ নেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে৷ বিভিন্ন খাতের ব্যয় কমিয়েও অর্থ সংস্থানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ সবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেতে পারে৷ তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, এমন আশঙ্কায় টাকা ছাপানোর পক্ষে নন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ৷
ছবি: DW
মন্দার শঙ্কা
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে মহামন্দার আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও৷ এরইমধ্যে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি৷ মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশ কতটা সামলাতে পারবে তা বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নির্ভর করছে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপরে৷