‘কঠোর লকডাউনেই' হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। আর রোজাও শুরু হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি, কাজ হারনো আর অনিশ্চয়তায় অদ্ভুত একটা অবস্থার মধ্যে আছেন দেশের মানুষ। তার মধ্যেই চলছে ঝুঁকি নিয়ে লকডাউনে বাড়ি ফেরা।
বিজ্ঞাপন
সাধারণ বিবেচনায় মনে হতে পারে অনেকে উৎসবের আমেজে বাড়ি ফিরছেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতে ভিন্নতা আছে। এরকম বাড়ি ফেরর অপেক্ষায় একজন আমজাদ আলি বললেন," লকডাউনে বাড়ি যাব না কী করব? ঢাকায় বসে খাব কী, বাসা ভাড়া দেব কীভাবে?” তিনি রাস্তার পাশে ছোট একটি দোকান দেন। কিন্তু লকডাউনে চালাতে পারবেননা। তাই বাড়ি যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নাই। এখানে থাকলে তিনি কী খাবেন। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। যাত্রীবাহী কোনো যানবাহন না চললেও আশা করেন ট্রাকে বা অন্য কোনো উপায়ে যেতে পারবেন।
ধানমন্ডি এলাকার আরেকজন হকার, রাস্তার পাশে ডাব ও লেবু বিক্রি করেন। তার কথা ," লকডাউনে খাব কী। মরব নাকি? তাই আমি আমার ব্যবসা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করব। তারপর পুলিশ যদি ধরে নেয় নেবে। কী আর করা যাবে।”
সদ্য শেষ হওয়া সাত দিনের যে লকডাউন বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, সেটাকে তারা লকডাউন মনে করে না। কারণ দূর পাল্লার যাত্রীবাহী যানবাহন ছাড়া বাস্তবে আর সবই ছিলো খোলা। কিন্তু বুধবার থেকে যে সাত দিনের লকডাউন শুরু হচ্ছে তা কঠোর হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। সব ধরনের যানবাহন বন্ধ তো থাকবেই, সব ধরনের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও বন্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। সীমিত আকারে কাঁচাবাজার খোলা থাকলেও সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ থাকবে। আর খাবার রেস্তোরাঁ খোলা থাকবে শুধু খাবার কিনে নেয়ার জন্য। সব ধরনের অফিস বন্ধ। তবে এবারও পোশাক কারখানা খোলা থাকছে। ব্যাংক শুরুতে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত সীমিত আকারে খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ডা. লেনিন চৌধুরী
চিকিৎসা, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ জরুরি সেবা চালু থাকবে । চালু থাকবে সংবাদমাধ্যম।
লকডাউনে সাধারণের জরুরি প্রয়োজনে বাইরে চলাচলের জন্য ‘মুভমেন্ট পাস' দেবে পুলিশ। অ্যাপস-এর মাধ্যমে এই পাসের জন্য আবেদন করতে হবে। অ্যাপসটি এরইমধ্যে চালু হয়েছে। চালুর পর প্রতি মিনিটে গড়ে ১৫ হাজার করে আবেদন হচ্ছে।
লকডাউনের আগের দিন ঢাকার সড়কে তীব্র যানজট দেখা গেছে। শপিংমল, মার্কেট ও কাঁচাজারে বেজায় ভিড়। আর ব্যাংকগুলোতে ছিলো টাকা তুলতে লম্বা লাইন। অনেকেই সাত দিনের বাজার করে রাখছেন। আবার রোজার কারণেও ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়েছে। সরকার ছয়টি নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও বাস্তবে সেই দামে পণ্য মিলছে না। আর টিসিবিও ট্রাকে করে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির কথা বললেও নির্ধারিত সময়ে ট্রাক আসে না বলে অভিযোগ আছে।
হাতিরপুল কাঁচা বাজারে শেখ সোহেল নামে একজন ক্রেতা জানান," জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ৩০ টাকা হালির লেবু এখন ১২০ টাকা। আর সরকার কিছু পণ্যের দাম বেধে দিলেও সেই দামে কোথাও পাওয়া যায় না। আমরা যারা নির্ধারিত আয়ের মানুষ তারা চরম বিপদে আছি।”
ঢাকায় লকডাউনের প্রথম তিনদিন
করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে সাতদিনের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণা করেছে৷ লকডাউনের প্রথম তিনদিনে মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক দেখা গেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed
১১ দফা নির্দেশনা
করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ও মৃত্যু মোকাবিলায় সরকার ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করে৷ নির্দেশনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হোটেল বা রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া যাবে না৷ তাই ঢাকার বড় হোটেলগুলোকে শুধু দোকানের অংশবিশেষ খুলে পার্সেল খাবার বিক্রি করতে দেখা যায়৷
ছবি: Mortuza Rashed
যাত্রীদের অভিযোগ ‘ভাড়া বেশি’
লকডাউনের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে প্রধানসড়কে রিক্সা ও সিএনজি অটোরিক্সার সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য৷ একাধিক যাত্রী অভিযোগ করেন, গণপরিবহন বন্ধের সুযোগে যাত্রীদের কাছে ইচ্ছেমতো ভাড়া হাঁকছেন চালকেরা৷ অনেকে বাধ্য হয়েই অতিরিক্ত ভাড়ায় গন্তব্যে যেতে বাধ্য হচ্ছেন৷ তবে এই প্রতিবেদকের কাছে রিক্সা ও অটোরিক্সার চালকেরা এই অভিযোগ অস্বীকার করেন৷
ছবি: Mortuza Rashed
এমন লকডাউনে শুধুই ভোগান্তি
লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে কথা হয় সবুজ ইসলামের সঙ্গে৷ তিনি সস্ত্রীক বাসস্ট্যান্ডে এসেছিলেন শ্বশুরের জানাজায় যোগ দিতে গ্রামের বাড়ি যাবেন বলে৷ কিন্তু কোন দূরপাল্লার বাহন না পেয়ে ক্ষোভের সুরে বলেন, ‘‘এ বছরের এটা কোনো লকডাউনই না, শুধু জনগণের ভোগান্তি৷ বন্ধ করলে সবই বন্ধ করা উচিত ছিল৷’’
ছবি: Mortuza Rashed
বন্ধ দূরপাল্লার গণপরিবহন
লকডাউন কার্যকরের অংশ হিসেবে তৃতীয় দিনে মহাখালীর টাঙ্গাইল বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখান থেকে কোনো দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি৷ দূরপাল্লার বাস ছাড়াও গণপরিবহন হিসেবে বন্ধ আছে ট্রেন, লঞ্চ এবং অভ্যন্তরীণ বিমান৷ এছাড়া বন্ধ রয়েছে শপিং মল, মার্কেট এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ৷
ছবি: Mortuza Rashed
কাঁচাবাজারে নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের কাঁচাবাজার চালু রাখার নির্দেশনা থাকলেও সরেজমিনে তার ছিটেফোঁটাও পাওয়া গেল না৷ বাজারের কয়েকজনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বললে তারা জানান, এখানে এত কিছু মানা সম্ভব না৷
ছবি: Mortuza Rashed
লকডাউনেও যানজট
ছবিটি বুধবারের৷ লকডাউনের তৃতীয় দিনে পান্থপথ সিগন্যালে দেখা গেল বেশ বড়সড় যানজট৷ জটে আটকা পড়া একজন যাত্রী এই প্রতিবেদককে দেখে বলেন, ‘‘লকডাউন চলাকালে জ্যামের নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed
গণভোগান্তি নিরসনে চালু সিটি বাস
লকডাউনের প্রথম দুই দিনে অফিস চলাকালীন গণপরিবহন বন্ধের কারণে সৃষ্ট ভোগান্তিতে জনমনে চরম ক্ষোভ এবং অসন্তোষের জন্ম হয়, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷ সে কারণে সরকার বুধবার থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি প্রদান করেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed
ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ
লকডাউনের প্রথম এবং দ্বিতীয় দিনে ঢাকার নীলক্ষেত মোড় এবং নিউমার্কেট এলাকায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন৷ তাদের দাবি, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারাও ব্যবসাপরিচালনা করতে চান৷ এজন্য ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও পেশ করেছেন বলে জানান একজন নেতা৷
ছবি: Mortuza Rashed
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা
গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, মহাখালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথে ভ্রাম্যমাণ আদালত এবং পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ব্যক্তিগত গাড়িতে অবৈধভাবে দূরপাল্লায় ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন হচ্ছে কিনা তা তদারক করা হচ্ছে বলে জানান ট্রাফিক সার্জেন্ট কবির হোসেন৷ তিনি এও বলেন, এরকম অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Mortuza Rashed
‘রিকশা নিরাপদ, তাই বইমেলা চালু’
করোনা প্রতিরোধে সরকারের বিধিনিষেধ এবং লকডাউনের মধ্যেও রিকশা চলছে এবং এটি নিরাপদ বলে বইমেলা চালু আছে বলে মন্তব্য করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন৷ তবে সরেজমিনে গিয়ে স্টলগুলো প্রায় ক্রেতাশূন্য অবস্থায় দেখা যায়৷
ছবি: Mortuza Rashed
সন্ধ্যার পর উলটোচিত্র
সরকারের ১১ দফার মধ্যে অন্যতম ছিল সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না৷ কিন্তু বাস্তবে সন্ধ্যার পর ঠিক বিপরীতচিত্র দেখা যায়৷ সন্ধ্যার পরই মানুষ অপ্রয়োজনে বের হচ্ছে বেশি৷ কেন বন্ধুদের নিয়ে বের হয়েছেন জানতে চাইলে সাইমুম হাসান নামের এক তরুণ বলেন, ‘‘সারাদিন ঘরেই ছিলাম, বিকালের পর তাই একটু বাতাস খেতে কয়েকজন মিলে বের হলাম৷’’
ছবি: Mortuza Rashed
যারা লকডাউন আওতার বাইরে
জরুরি চিকিৎসাসেবা, মৃতদেহ সৎকার, জরুরি পরিষেবা, সংবাদপত্র, পার্সেল সেবা, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন, বিদেশ প্রত্যাগত বা বিদেশগামী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লকডাউনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না৷
ছবি: Mortuza Rashed
12 ছবি1 | 12
দোকানদাররা দাবি করেন, এখনো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেনি। তবে লকডাউন শুরু হলে সরবরাহ ব্যবস্থা কতটা সচল থাকে তার ওপর পরবর্তী পরিস্থিতি নির্ভর করছে।
এদিকে কঠোর লকডাউন শুরু আগের দিনেও বাইরে বের হওয়ার মানুষের মধ্যে তেমন স্বাস্থ্য সচেতনতা দেখা যায়নি। মাস্ক ব্যবহারের প্রবণতা খুবই কম। মার্কেট, রাস্তাঘাট, বাসষ্ট্যান্ড সবখানেই মানুষের ভিড়।
এর আগে গত বছর করোনার কারণে মোট ৬২ দিন সাধারণ ছুটি ছিলো। আর এবছর ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল একটা ঢিলেঢালা লকডাউন হয়ে গেল। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন," এবার যেভাবে হাজার হাজার মানুষকে মুভমেন্ট পাস দেয়া হবে তাতে লকডাউন আর লকডাউন থাকবে না। আর পূর্ণ প্রস্তুতি না নিয়ে লকডাউন করা যায় না। এই লকডাউনে উদ্দেশ্য কী? সাত দিন পর কী হবে?”
তিনি মনে করেন," এটা কোনো পরিকল্পিত লকডাউন নয়। হঠাৎ করে নেয়া একটা সিদ্ধান্ত। তাই মানুষ বিভ্রান্ত এবং আতঙ্কিত।”