বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শতকরা তিন ভাগ মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। সরকার ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে চায়। প্রতি মাসে আসলে কতজনকে টিকা দেয়া দরকার? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এক বছরের মধ্যে সবাইকে টিকা দেয়া দরকার।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
বিজ্ঞাপন
সংসদে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দেয়ার কথার পাশাপাশি একটি রোডম্যাপও ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রতি মাসে ২৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ। তবে বাস্তবে এই জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি হবে। সেই হিসাব ধরলে ১৭ কোটি জনসংখ্যা ৮০ ভাগ হলো ১৩ কোটি ৬০ লাখ। এখন এই এই জনগোষ্ঠীর ২৫ লাখকে যদি প্রতিমাসে টিকা দেয়া হয় তাহলে সবাইকে টিকা দিতে সাড়ে চার বছরেরও বেশি সময় লাগবে। আর এরমধ্যে যদি শিশুদের টিকা এসে যায় তাহলে শতভাগ নাগরিককেই টিকা দিতে হবে।
বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে টিকা দেয়া শুরু হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে তিন কোটি ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা পাওয়ার চুক্তিতে এটা করা হয়েছিল। কিন্তু এই টিকা দেয়া এখন বন্ধ আছে। তারা চুক্তি অনুযায়ী টিকা দেয়নি। তার দুই দফায় ৭০ লাখ ডোজ দেয়ার পর বন্ধ করে দেয়। আরো দেবে এমন কোনো নিশ্চয়তা এখনো পওয়া যায়নি। তবে এর বাইরে বাংলাদেশ ওই সময়ে উপহার হিসেবে ২০ লাখ, পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় উপহার হিসেবে আরো ১২ লাখ ডোজ টিকা পায়। আর ভারতের সেনাপ্রধান দেন এক লাখ ডোজ।
ডা. লেনিন চৌধুরী
This browser does not support the audio element.
সম্প্রতি চীনের কাছ থেকে উপহার পাওয়া গেছে সিনোভ্যাকের পাঁচ লাখ ডোজ। কোভ্যাক্স দিয়েছে এক লাখ ৬২০ ডোজ ফাইজরের টিকা। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ টিকা পেয়েছে এক কোটি ৫৪ লাখ ৬২০ ডোজ। দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিতে হলে লাগবে ২৭ কোটি ২০ লাখ ডোজ।
সরকার চীন থেকে তিন কোটি টিকা আনছে। আরো ছয় লাখ উপহার হিসেবে পাওয়া যাবে। যদিও দাম প্রকাশ করায় তা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়া থেকে এক কোটি ডোজ আনার চুক্তি হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকেও আনা হবে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনিয়েছেন। কোভ্যাক্স থেকে কম দামে তিন কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা আছে। সংসদে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদন করা হবে। কিন্তু এখানকার গ্লোব বায়োটেক তাদের বঙ্গভ্যাক্সের হিউম্যান ট্রায়লের অনুমতি পায়নি এখনো। চীনের সঙ্গে যৌথ উৎপাদনের কথাও বলছে সরকার।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অক্সফোর্ডের প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪২ লাখ ১৬ হাজার ৯৯৬ জন। সব মিলিয়ে দেয়া হয়েছে এক কোটি ৩৬ হাজার ৭১১ ডোজ। অক্সফোর্ডের টিকা পাওয়া গেছে এক কোটি তিন লাখ ডোজ। এখন অক্সফোর্ডের টিকা হাতে আছে দুই লাখ ৬৩ হাজার ১৮৯ ডোজ। কিন্তু বাস্তবে আরো কম। কারণ কিছু টিকা নষ্ট হয়েছে।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
This browser does not support the audio element.
চীনা টিকার ট্রায়াল শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত দুই হাজার ১৬২ জনকে দেয়া হয়েছে। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন ১৩ জুনের পর ফাইজারের টিকা দেয়া শুরু হবে।
জনস্বাস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন,"এখন প্রতিমাসে এক কোটি লোককে টিকা দেয়া প্রয়োজন। কারণ টিকার কার্যকারিতা এক বছর। সেটা হলে এক বছরে সবাইকে টিকা দেয়া যাবে। কিন্তু ২৫ লাখ মানুষকে প্রতিমাসে টিকা দেয়া হলে অনন্তকাল ধরে দিতে হবে। কারণ এরইমধ্যে আবার পুরনোদের টিকা দিতে হবে।”
তিনি বলেন," যতই কথা হোক টিকা গণটিকা দেয়া কিন্তু থেমে গেছে। যে টিকা পাওয়ার কথা বলা হচ্ছে তা কবে আসবে তাও এখনো নিশ্চিত নয়। আসলে না কথায় সময় যাচ্ছে। টিকা আসছে না। কিন্তু এখনই গণটিকা শুরু করে এক বছরের মধ্যে শেষ করা দরকার।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন," এখন ভ্যাকসিন কূটনীতি আরো জোরদার করতে হবে। আমরা শুরুতে একটি দেশের সাথে চুক্তি করে এই কূটনীতিতে পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের অদক্ষতাও প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু এখানে পড়ে থাকলে চলবে না। এক সময় টিকা অনেক পওয়া যাবে। এটা নিয়ে বাণিজ্যও হবে। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন দ্রুত টিকা পাওয়া। বছরের পর বছর টিকা দিলে তো চলবে না।'' তার মতে এখন বাইরের দেশ থেকে টিকা আনার পাশাপাশি যৌথ উৎপাদন এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে জোর দেয়া প্রয়োজন। অনেক দেশই যৌথ উৎপাদন শুরু করেছে।
চীনের সিনোফার্মের টিকাদান কার্যক্রম শুরু
দেশে করোনা সংক্রমণ রোধে চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদান শুরু হয়েছে। এ পর্যায়ে অগ্রাধিকার পাবেন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, মেডিকেল টেকনোলজি কলেজের শিক্ষার্থী এবং চীনের নাগরিকরা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
প্রাথমিকভাবে চারটি মেডিকেলে টিকাদান
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভির টিকাদান কার্যক্রম প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এবং মুগদা মেডিকেল কলেজে চালু করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য মেডিকেল কলেজে এই কার্যক্রম শুরু হবে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকাদান
দেশে স্বাস্থ্যসেবায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য টিকা দেয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্টদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে উপহারের মোট পাঁচ লাখ ডোজের মধ্যে দুই লাখের মতো ডোজ দেওয়া হবে শিক্ষার্থীদের। বাকি টিকা চীনের অনুরোধের ভিত্তিতে পাবেন চীনা নাগরিকেরা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকা কার্যক্রম উদ্বোধন
মঙ্গলবার সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেকের উপস্থিতিতে ৩ জন শিক্ষার্থীকে টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা মেডিকেলের ২৫৭ জন শিক্ষার্থীসহ মোট এক হাজার জনকে প্রথম দিনে টিকা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
‘টিকা নিয়ে শুরুতে যে ভয়টা ছিল, সেটি কেটে গেছে‘
প্রথম স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে টিকা নেওয়ার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী অনন্যা সালাম সমতা জানান, “আমরা অনেকদিন যাবত ক্লাস, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছি না। তাছাড়া ফেব্রুয়ারিতে টিকাদানের শুরুতে যে ভয়টা ছিল, এখন সেটা আর নেই। আমি মনে করি, করোনা প্রতিরোধে টিকার কোনো বিকল্প নেই৷”
ছবি: Rashed Mortuza/DW
নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা
ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য মেডিকেলে টিকাদান কার্যক্রমের প্রথমদিনে জরুরি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টিকাদান বুথের পাশাপাশি টিকা পরবর্তী পর্যবেক্ষণ কক্ষ এবং টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যেন সঙ্গে সঙ্গে জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সবখানেই।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
চলছে অক্সফোর্ডের টিকাদান কার্যক্রমও
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভির টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধনের পাশাপাশি পৃথক টিকাবুথে দেখা গেল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্তব্যরত একজন নার্স বলেন, ‘‘যতদিন আমাদের এ টিকার মজুত আছে, ততদিন এ কার্যক্রম চলবে।’’
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকাটি প্রায় ৮০% কার্যকর
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ভিত্তিতে চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকার অনুমোদন দেওয়ার পর পাকিস্তান, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এ টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ টিকার কার্যকারিতা ৮৬ শতাংশের মতো পাওয়া গেছে। তবে গবেষণা বলছে, স্বাভাবিকভাবে এ টিকা গড়ে ৮০ ভাগ কার্যকর।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
‘আমাদের এ সুযোগ লুফে নেওয়া উচিত’
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদানের প্রথমদিনে টিকা নিতে আসা ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী নিয়ামুল হক বলেন, “সরকার আমাদের জন্য বিনামূল্যে এ টিকার ব্যবস্থা করেছেন, আমার মনে হয় এ সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের তা লুফে নেওয়া উচিত। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটির অনুমোদন দিয়েছে, এর পরে এ টিকা নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না।”
ছবি: Rashed Mortuza/DW
এক সপ্তাহের বিরতি
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকাদান কার্যক্রম চালুর প্রথমদিনে হাজার শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে ১ সপ্তাহ বিরতি দেওয়া হবে। টিকাগ্রহীতাদের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না দিলে পরবর্তীতে বাকিদেরও এই টিকাদানে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
টিকা আনার সর্বোচ্চ চেষ্টার দাবি
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহেদ মালেক বলেন, “ভারত তিন কোটি টিকার ডোজ দেওয়ার কথা থাকলেও তাদের নিজেদের দেশের সংকটের কারণে আমরা মাত্র এক কোটি ডোজ টিকা পেয়েছি। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় চীন এবং রাশিয়া থেকে টিকা আনার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হচ্ছে। খুব শীঘ্রই আমরা কাঙ্খিত ফল পাবো বলে আশা করছি।“
ছবি: Rashed Mortuza/DW
চীনের টিকা সর্বসাধারণের জন্য নয়
চীনের সিনোফার্ম উদ্ভাবিত বিবিআইবিপি-করভি টিকার উপহারের যে পাঁচ লাখ ডোজের চালান চীন সরকার বাংলাদেশকে দিয়েছে, আপাতত সাধারণ মানুষ এ টিকাদান কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন বলে জানানো হয়েছে। চীনের সাথে চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর যখন নিয়মিতভাবে টিকার চালান আসবে, তখন সর্বসাধারণকে এই টিকা প্রয়োগের আওতায় আনা হবে বলে জানান দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা।
ছবি: Rashed Mortuza/DW
11 ছবি1 | 11
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চীনের উপহারের আরো ছয় লাখ টিকা ১৩ জুনে আসতে পারে। ফাইজারের টিকার ব্যবহারের উপাদান ডাইলুয়েন্ট সোমবার রাতের মধ্যে আসবে। চীনা ও ফাইজারের টিকা কার্যক্রম একসঙ্গে চলবে।
তিনি জানন, চীনের সাথে দেড় কোটি টিকার চুক্তি হয়েছে। আরো দেড় কোটি টিকার চুক্তি হচ্ছে।