কথা না শুনলে চাকরি থাকবে না
৭ মে ২০২১তিনি হয়তো স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারেন৷ কিন্তু এমন সৌভাগ্যবান সাংবাদিক কত জন আছেন?
পত্রিকার নাম নাইবা বললাম৷ ২০০৪ সালের ঘটনা৷ দেশের একটি প্রভাবশালী পত্রিকায় অপরাধ রিপোর্টিং বিভাগের সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে মাত্র যোগ দিয়েছি৷ পত্রিকার মালিক যেমন ‘সুবিখ্যাত' সম্পাদকও ডাকসাইটে৷ যোগদানের পরের সপ্তাহেই পত্রিকার রিপোর্টারদের সাপ্তাহিক বৈঠকে হাজির হলেন মালিক৷ আছেন সম্পাদকও৷ ওই প্রথম মালিককে সরাসরি আমি দেখি৷ সবাই তটস্থ৷ যেন ভয়ে কাঁপছেন৷ সম্পাদক কী কথা বলবেন! মালিকই রিপোর্টারদের রিপোর্টের ফলোআপ এবং আপডেট নেয়া শুরু করলেন৷ আর সেটা ছিল ভয়াবহ অভিজ্ঞতা৷ অমুক ব্যাংককে ধসিয়ে দেয়ার কী হলো? ওই বিভাগের (সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান) চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লেখো, ট্যাক্স নিয়ে ঝামেলা করছে৷ আমাদের তো ওই ব্যাংক এখনো লোন দেয়নি৷ ব্যাংকের এমডি টিকে আছেন কীভাবে?
আমি নতুন হওয়ায় সেই যাত্রায় আমার ওপর কোনো ফরমায়েশ ছিলনা৷ বেঁচে গেলাম৷ তবে যতদিন ছিলাম ভয়ে ভয়ে ছিলাম৷ কারণ, ওই মালিক বসতেন মতিঝিলের একটি ভবনে৷ সেখানে প্রায়ই রিপোর্টারদের ডাক পড়তো৷ আর ডাক পড়া মানে কাউকে ধসিয়ে দেয়ার অ্যাসাইনমেন্ট নাজিল হওয়া৷ চাকরি করতে হলে সেটা করতে হবে৷ কেউ সেটা করতে অস্বীকার করলে বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেয়ার হুমকিও নাকি দেয়া হতো৷
ওই মালিকের যেহেতু জমির ব্যবসা, তাই দেখেছি কয়েকজন রিপোর্টারের কাজই ছিল অন্য হাউজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে নিয়মিত ‘গল্প' লেখা৷ তারা বাধ্য হয়েই সেটা করতেন৷ না করলে চাকরি থাকতো না৷
বড় পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে তখন আমার মোহভঙ্গ হয়৷ আমার কপাল ভালো ওই পত্রিকায় ছয় মাসের বেশি চাকরি করতে হয়নি৷ বেশি বেতনে নতুন আরেকটি পত্রিকায় চাকরি পেয়ে যাই৷ তখন বিএনপি ক্ষমতায়৷
সেখানে গিয়ে পড়ি আরেক সংকটে৷ তবে আমি ‘বড় ভাই' বলে জানি তেমন আরেকজন ক্রাইম রিপোর্টার ছিলেন সেখানে৷ তিনি মাঝে মাধ্যেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমাদের বাঁচাতেন৷ একবার তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একটা ভালো প্রতিবেদন করলাম৷ তার ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে৷ পুরোটাই সরকারি ডকুমেন্টভিত্তিক৷ সম্পাদকও প্রশংসা করলেন৷ কিন্তু রিপোর্ট আর ছাপা হয় না৷ আমিও আর খোঁজ নিতে সাহস পাই না৷ তারপর সম্পাদক একদিন নিজেই ডাকলেন আমাদের পুরো ক্রাইম টিমকে৷ জানালেন ওই প্রতিবেদন ছাপা যাবে না৷ আমরা কেউই কারণ জানতে চাইলাম না৷ তারপরও সম্পাদক নিজেই বললেন, মালিক পক্ষের নিষেধ আছে৷ রিপোর্টের মৃত্যু হলেও সম্পাদক যে নিজেই কৈফিয়ত দিয়েছিলেন, তার জন্য অনেক খুশি হয়েছিলাম আমি৷
তবে ওই পত্রিকার একজন উপ-সম্পাদক আমাকে বেশ ঘাঁটিয়েছিলেন৷ তখন জঙ্গিদের গোপন বৈঠকের একটি অডিও এসেছিল আমার হাতে৷ সেটা নিয়ে প্রতিবেদন করার সময় কিছু বিষয় আমি বাদ দিই রাষ্ট্রীয় স্বার্থে৷ কিন্তু তিনি আমার কাছে সেই অডিও টেপ চাচ্ছিলেন একটি দূতাবাসকে দেয়ার জন্য৷ আমি না দেয়ায় তিনি সেই দূতাবাসকে দিয়ে আমাকে কৌশলে হুমকি দেয়ারও ব্যবস্থা করেছিলেন৷ আর হুমকি ছিল ওই দেশে যেতে চাইলে ভিসা না দেয়ার৷ সেই দেশটিতে আজও আমার যাওয়া হয়নি৷
পরে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করার সময় মালিকের দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে আরেক সংকটে পড়ি আমি৷ তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে তখন তালাক দেবেন৷ তার প্রতিবাদে ওই নারী টেলিভিশন চ্যানেল ভবনের নীচ তলায় লিফটের সামনে এসে অনশন শুরু করেন৷ আমার ওপর ‘দায়িত্ব’ পড়লো তাকে পুলিশ ডেকে জোর করে উঠিয়ে দেয়ার৷ তা সম্ভব না হলে লোকজন জোগাড় করে তাকে যে-কোনো উপায়ে ওখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে৷ আমার ‘শুভাকাঙ্খী' সহকর্মীরা বার বার মালিককে ফোন করে বলছিলেন , ‘‘হারুন তো কিছুই করছেনা স্যার৷ তাকে আপনি এত সুবিধা দিয়েছেন তাহলে কী জন্য? আপনার বিপদে সে কিছুই করছে না৷’’
আমি তো মহা বিপদে৷ চাপ আরো বাড়ছে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহ সহায়৷ আমি বুঝাতে সক্ষম হলাম যে, পুলিশ আনলে বা কোনো জোর করলে সিন ক্রিয়েট হবে, তাতে ঝামেলা আরো বাড়বে, সবাই খবর পেয়ে যাবে, নিউজও হতে পারে৷ তার চেয়ে বরং চুপচাপ থাকলে তিনি কয়েক ঘণ্টা পর ক্লান্ত হয়ে নিজেই চলে যাবেন৷ শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল৷
আর ওই চ্যানেলেই কয়েকটি হাউজিং কোম্পানির রীতিমতো ডাকাতির খবর প্রচার করতে পারিনি৷ কারণ, তারা বিজ্ঞাপন দিতো৷ একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনার ফুটেজ আনার পরও সেটা প্রচার হয়নি৷ কারণ, ওই কারখানাটি ছিল মালিকের এক ‘পাতানো ভাইয়ের’৷
আমি সাংবাদিকতা শুরু করি ১৯৯৭ সালে দেশের একটি প্রাচীন দৈনিক দিয়ে৷ একবার সরকারের এক শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করলাম৷ লিড হলো৷ ধন্য ধন্য পড়ে গেল৷ কিন্তু সকাল পার হয়ে দুপুর হতেই চাকরি নিয়ে টান৷ কারণ, তিনি মালিকের এলাকার লোক এবং কাছের৷ দুপুরের পর মালিক এলেন৷ বার্তা সম্পাদক ছুটোছুটি শুরু করলেন৷ আমার কাছে ডকুমেন্ট চাইলেন৷ সব নিয়ে গেলেন মালিকের রুমে৷ বের হলেন এক ঘন্টা পর৷ ডকুমেন্ট দেখানোর পর চাকরি রক্ষা পেলো অনেক কষ্টে৷
এবার আরেকটি সংবাদমাধ্যমের কথা বলি৷ সেখানে আমি তখন রিপোর্টার থেকে নিউজ ম্যানেজার৷ সেখানে মালিক বলে দিতেন কার কার কিরুদ্ধে কোনো তথ্যভিত্তিক খবর পেলেও লেখা বা প্রকাশ করা যাবে না৷ সেখানে তালিকা ছিল কাকে রক্ষা করতে হবে আর কাকে ধসিয়ে দিতে হবে৷ বেশ কয়েকবার ঘটেছে, কোনো একটি ঘটনায় একটি-দুইটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর ‘ওহি' নাজিল হতো- আর লেখা যাবেনা৷ একজন ছিলেন মালিক পক্ষের ‘পীর’৷ তিনি যা করবেন সব কিছুই হালাল করার দায়িত্ব ছিল আমাদের৷ আর এই পীর বংশ ধীরে ধীরে বাড়ছিল৷ তাদের রক্ষায় কাজ করতে না পারলে চাকরি থেকে বিদায়৷ সত্যিই এক দিন আমাকে সেখান থেকে বিদায় নিতে হয়েছে৷
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সর্বশেষ সমালোচনার মুখে পড়েছে মুনিয়ার আত্মহত্যার ঘটনার খবর পরিবেশন নিয়ে৷ আর সেই ঘটনায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলার আসামি বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর৷ আমার পর্যক্ষেণ হলো, এই ঘটনায় যেন রাষ্ট্রের ভেতরে আরেক রাষ্ট্র সক্রিয়৷ এখানে বসুন্ধরার নিজেদের ৫ টি সংবাদমাধ্যম চুপচাপ৷ কিন্তু তাদের পক্ষ নিয়েছে আরো কয়েকটি সংবাদমাধ্যম৷ এই পক্ষ নেয়ায় উৎসাহী গ্রুপ যেমন আছে, তেমনি বাধ্যও হয়েছে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম৷ নয়তো ছোট মাছকে বড় মাছ গিলে খাওয়ার আশঙ্কা আছে৷ এখানে আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন৷
আর সাধারণভাবে দেখলে প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই এই ঘটনা কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে৷ বিষয়টি নিয়ে জোরে কথা বলতে যেন ভয় পাচ্ছে৷
কিন্তু সব কিছুর পরও সাংবাদিকতা এমন এক পেশা, যেখানে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার সৎ সাহস থাকতে হয়৷ এই দুঃসময়ের মধ্যেও এই বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এমন অনেক সাংবাদিক আছেন, যারা সেটা পারেন৷ তাদের দেখেই এখনো সাংবাদিকতার সাহস পাই৷ আশার আলো দেখি৷