1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কমছে আদিবাসী, বিলুপ্ত হচ্ছে সংস্কৃতি

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

গত ৬৪ বছরে ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই লাখ দুই হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে৷ দেশে আদিবাসী কমছে, বিলুপ্ত হচ্ছে তাঁদের সংস্কৃতি৷ আদিবাসীদের এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্র এবং বাঙালির জাত্যাভিমানকেও দায়ী মনে করেন অনেকে৷

বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী
ছবি: Sanchay Chakma

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত গত মাসে ‘পলিটক্যিাল ইকোনমি অফ আনপিপলিং অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অফ বাংলাদেশ' শিরোনামে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন৷ সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে সরকার ২২টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে স্বীকার করে না৷ ২৭টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে স্বীকার করা হলেও বাস্তবে দেশের ৪৮ জেলায় ৪৯টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস৷ আর তাদের মোট জনসংখ্যা ৫০ লাখ, যদিও সরকারি হিসেবে ২৫ লাখ৷''

গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, গত ৬৪ বছরে সমতলের ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর  দুই লাখ দুই হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে, যার দাম প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা৷

বাংলাদেশ জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে আদিবাসীর সংখ্যা কমছে৷ আমাদের হিসেবে ৬শ'র মতো সমতলের আদিবাসী পরিবার বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে৷ ভূমিদস্যুদের আক্রমণের আতঙ্কে তারা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছে৷ অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ উত্তরবঙ্গের করা সম্প্রদায় হারিয়ে গেছে৷ দিনাজপুর এবং রাজশাহীর কোল ও ভিল সম্প্রদায়ের আর কোনো অস্তিত্ব নাই৷''

Rabibdra Saren - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তাঁর এই কথার সমর্থন মেলে প্রাণ ও প্রকৃতি গবেষক এবং আদিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে গবেষণায় নিয়োজিত পাভেল পার্থ-র বক্তব্যে৷  তিনি বলেন, ‘‘শুধু আদিবাসীই বিলুপ্ত হচ্ছে না, তাঁদের সংস্কৃতিও বিলুপ্ত হচ্ছে, কারণ, তাঁদের অনেক উৎসবই ফসল কাটাসহ নানা উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত৷ কখনো ইকো পার্কের নামে, কখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে তাঁদের আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে৷ বন, প্রকৃতি, জুমচাষ থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়েছে৷ ফলে তাঁরা তাঁদের নিজস্বতা হরিয়েছে৷''

অধ্যাপক আবুল বারাকাত তাঁর গবেষণায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীকে জমিজমা এবং বসত বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ১৬টি কৌশলের কথা বলেছেন৷ এইসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে – সরকারি বনায়ন, খাস সম্পত্তি রক্ষা, ন্যাশনাল পার্ক বা জাতীয় উদ্যান, টুরিস্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা, ইকো পার্ক স্থাপন, ভূমি জরিপ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শত্রু সম্পত্তি আইন, ভুয়া দলিল, গুজব ছড়িয়ে সংঘাত, দাঙ্গা, জোর জবরদস্তি, ভীতি সৃষ্টি প্রভৃতি৷ প্রধানত তাঁদের রক্ষার নামেই রাজনৈকি প্রভাবশালী ও ভূমি দস্যুরা তাঁদের উচ্ছেদ করে৷ এবার গাইবান্ধার চিনিকল এলাকায় সাঁওতালদের উচ্ছেদে সেই সব রাজনৈতিক নেতারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন, যাঁরা কয়েক বছর আগে তাঁদের রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন৷

১৯৫০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাপ্তাইয়ে বাঁধ দেওয়ার নামে যেমন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হয়, তেমনি মধুপুরে ন্যাশনাল পার্ক করার নামেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করা হয়৷ মৌলভীবাজারের মাগুরছড়ায়ও তাঁরা সরকারি  উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন৷ ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা এবং ভূমি কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করছে না৷

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র  নৃ-গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন এবং বিলুপ্তিকরণের প্রধান তিনটি কারণের কথা জানিয়েছে ‘আদিবাসী' গবেষক আলতাফ পারভেজ৷ তিনি বলেন, ‘‘তাঁরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক কারণে উচ্ছেদের শিকার হচ্ছেন৷''

Altaf pervez - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

তাঁর মতে, ‘‘প্রথমত, আদিবাসীদের কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই৷ সংসদসহ স্থানীয় সরকারে তাঁদের কোনো প্রতিনিধি নেই৷ যে দু-একজন আছেন, তাঁরা আসলে আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করেন না৷ রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকায় এই মনোভাব গড়ে উঠেছে যে আদিবাসীদের নির্যাতন, উচ্ছেদ করা যায়৷''

‘‘দ্বিতীয়ত, এরা বাংলাদেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী৷ অধিকাংশই ভূমিহীন, তাঁদের হাতে ভূমি নেই৷ আর বাংলাদেশে সাধারণভাবে ভূমির অধিকার যাঁদের নাই, তাঁদের ক্ষমতাহীন বলেই ভাবা হয়৷ ''

‘‘তৃতীয়ত, আদিবাসীরা জাতীয়তাবাদী ঘৃণার শিকার৷ ১৯৭১ সালের আগে আমরা যেমন পাকিস্তানি বা পাঞ্জাবিদের ঘৃণার শিকার হয়েছি, তেমনি আমরা এখন আদিবাসীদের ঘৃণা করছি৷ আমরা বাঙালি ছাড়া আর কোনো জাতিকে স্বীকৃতি দেই না৷''

এর ফলে কী হয় তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন পাভেল পার্থ, তিনি বলেন, ‘‘আদিবাসীদের বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশের সংবিধান, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়না৷ আর এই কারণেই তারা দুর্বল৷ এই দুর্বলতার সুযোগ নেয় রাষ্ট্র থেকে শুরু করে দখলদার ভূমিদস্যুসহ সবাই৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘লানেং, কড়া, বড়া, দোষাদ, কোল, ভীলের মতো আরো অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী সরকারের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতিও পায়নি৷ তাঁদের অবস্থা আরো করুণ৷ মধুপুর শালবন, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, সুনামগঞ্জ, বরেন্দ্রভূমি, চা বাগানসহ উত্তরবঙ্গের সমতলের অনেক আদিবাসীই আর টিকতে পারছেন না৷''

রবীন্দ্র সরেন বলেন, ‘‘রাষ্ট্র যদি সহানুভূতি না দেখায় তাহলে আদিবাসীদের টিকে থাকা সম্ভব নয়৷ আমরা আদিবাসী মন্ত্রনালয়ের দাবি করেছি, কিন্তু আছে মাত্র একটি সেল৷''

আদিবাসীদের ভাষা এবং সংস্কৃতিও এখন নানা হুমকির মুখে বলে জানান তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এবার জানুয়ারি মাসে নতুন শিক্ষা বছরে প্রাথমিক পর্যায়ে আদিবাসীদের ছয়টি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হবে৷ কিন্তু স্কুল নাই, শিক্ষক নাই, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নাই৷''

কিন্তু এই জনগোষ্ঠী বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে৷ ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁতাল হুল প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হিসেবে স্বীকৃত৷ আর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অবদান অনেক৷

রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায় ৩২টি নৃ-গোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকার কথা বারবার সংবাদ মাধ্যমে এসেছে৷ পাভেল পার্থ-র গবেষণা থেকেও উত্তর বঙ্গের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা জানা যায়৷ দিনাজপুর জেলার ওরাঁও ও সাঁওতালদের ১০০০ জনের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠনের কথা জানা যায়৷ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা এলাকার গারো, হাজং, কোচ জনগোষ্ঠীগুলো থেকে প্রায় ১৫০০ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন৷ ১১৫ জন ছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকা থেকে৷ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের মধ্যেই ৫০ জনের অধিক সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন৷ অনেকে জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য৷ তাঁদের মধ্যে গিরিশ সিংহ ও ভূবন সিংহ উল্লেখযোগ্য৷ সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া, বড়লেখা, চুনারুঘাট, মাধবপুর, বৈকুণ্ঠপুর, গোয়াইনঘাট, সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ৮৩টি বাগান এলাকার ক্ষুদ্র- নৃ-গোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০২ জন শহিদ, আহত ৪৩, নির্যাতিত ৮৩ হয়েছেন৷ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকে৷

এছাড়া বীরাঙ্গনা হিরামনিও একজন সাঁওতাল নারী৷ তিনি গত মার্চে ৬৮ বছর বয়সে মারা যান৷ এই হিরামনি সাঁওতাল চা শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম নারী, যিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন৷ পাক হায়েনাদের বর্বর নির্যাতনের শিকার হন৷ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চানপুর চা বাগানে তাঁর বীরত্ব গাঁথা সবার জানা৷ ২০১২ সালে বীরাঙ্গনা হিরামনি সাঁওতালকে মুক্তিযোদ্ধার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় সরকার৷

Pavel partho - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

দেশের জন্য লড়াই করা এই জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে অধাপক আবুল বারাকাত তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণায় বলেন, ‘‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নানা ক্ষেত্রে অবহেলিত, নির্যাতিত৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি সেবা পেতে সাধারণ মানুষের চেয়ে তাঁদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয়৷ সরকারের বিদ্যুৎ সেবা থেকে একেবারেই বঞ্চিত তাঁরা৷ গ্রামের ৪০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ পেলেও একই গ্রামে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের রাখা হয়েছে অন্ধকারে৷ সরকার নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগ নিলেও নারীদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো চিত্র৷''

পাভেল পার্থৃর কথায়, ‘‘এই রাষ্ট্র জাত্যাভিমানী৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছাড়া অন্য কোনো জাতির অস্তিত্ব স্বীকার করে না৷ তাই এই জাতিগোষ্ঠীগুলো স্বীকৃত নয়, তাঁদের নিজস্ব পরিচয় আদিবাসী হলেও তাঁরা তা পরিচয় হিসেবে পাচ্ছে না৷ রাষ্ট্র দিচ্ছে না৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ