কমিক্স কর্মশালা
২ ডিসেম্বর ২০১৩একটি বাঙালি ছেলে, নাম অশোক৷ আর একটি বাঙালি মেয়ে, তার নাম প্রিয়া৷ এরা দু'জনেই পড়াশোনা করেছে, কিন্তু তার বাইরে অন্য কোনো বৃত্তিমূলক কাজের তালিম এরা কখনও নেয়নি৷ ফলে এদের নিজেদের কোনো ধারণাই নেই কোন ধরনের পেশা ওদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে৷ এই অশোক একদিন জার্মানি যায়৷ সেখানে গিয়ে বাড়ির ছাদ সারাইয়ের প্রশিক্ষণ নেয় এবং হয়ে ওঠে মেরামতিতে দক্ষ একজন নির্মাণ কর্মী৷
অন্যদিকে প্রিয়া মেয়েটি পৌঁছে যায় ফ্রান্স৷ সেখানে সে রুটি তৈরির কারখানায় তালিম নেয় এবং একজন ভালো ‘বেকার' হয়ে ওঠে৷ কাজ শিখে আবার কলকাতা ফেরার পথে, বিমানে অশোকের আলাপ হয় প্রিয়ার সঙ্গে, দু'জনের পরস্পরকে পছন্দ হয়, একদিন ওরা বিয়েও করে এবং নিজেদের অধিগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সফল পেশাদার হয়ে ওঠে৷
ওঁরা চারজন একসঙ্গে বসে মাথা ঘামিয়ে এই গল্পটাই শেষ পর্যন্ত ছকে নিয়েছিলেন৷ ওঁরা বলতে জার্মানি থেকে আসা অভিজ্ঞ কমিক স্ট্রিপ শিল্পী ইয়র্গ রয়টার, ফরাসি কমিক স্ট্রিপ শিল্পী অলিভিয়ের তালেস, ভারতে প্রথম গ্রাফিক নভেলের রচয়িতা সারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দিল্লি-প্রবাসী নবীন কার্টুনিস্ট চার্বাক দীপ্ত৷ এঁদের সঙ্গে তিনদিনের এক ‘কমিক স্ট্রিপ ওয়ার্কশপ'-এ যোগ দিতে এসেছিলেন ২৫ জন বিভিন্ন বয়সের শিল্পী, যাঁরা কেউ বিশ্বভারতী অথবা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রী, কেউ যুক্ত বিজ্ঞাপন সংস্থার সঙ্গে, ফ্রি-লান্স শিল্পী কেউ কেউ, আবার কেউ কলেজে পড়াশোনা করেন সম্পূর্ণ অন্য কোনো বিষয় নিয়ে৷
বলা বাহুল্য, এঁরা প্রত্যেকেই ছবি আঁকা, বিশেষ করে কমিক স্ট্রিপ নিয়ে উৎসাহী৷ কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই এঁদের প্রত্যেকের আঁকার স্টাইল অন্যের থেকে আলাদা৷ তাহলে কী ভাবে সবাই মিলে তৈরি করবেন একটা কমিক স্ট্রিপ! মূলত যাঁর আগ্রহে এই আন্তর্জাতিক কলকাতা কমিক্স ওয়ার্কশপ সম্ভব হলো, জার্মান কনসাল জেনারেল রাইনার শ্মিডশেন জানালেন, এটা একটা ওপেন প্রোজেক্ট হিসেবে দেখা হবে৷ এমন হতে পারে যে প্রথম ২৪ পাতায় মূল গল্পটা ছবিতে বলে দেওয়া হলো, আর পরের ৩৬ পাতায় অন্য শিল্পীদের আঁকা পাতাগুলো জুড়ে দেওয়া হলো, যেগুলো এক একটা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে এবং অবশ্যই আলাদা অঙ্কনশৈলীতে গল্পটা বলবে৷ তবে এটা মোটামুটি ঠিক যে ৬০ পাতার একটা কমিকস বই প্রকাশিত হবে, এই ফরাসি-জার্মান-ভারতীয় যৌথ কর্মশালার ফসল হিসেবে৷
জার্মান কমিক স্ট্রিপ শিল্পী ইয়র্গ রয়টার কর্মশালার প্রথম দিনে তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, কমিক স্ট্রিপের সঙ্গে তাঁর আবাল্য সখ্যতার কথা এবং তাঁর ছোটবেলার বন্ধু, কলকাতার কনসাল জেনারেল রাইনার শ্মিডশেনও যে তাঁর মতোই কমিকস-পাগল, সেকথা জানান রয়টার৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক একান্ত আলাপচারিতায় কনসাল জেনারেল শ্মিডশেন নিজেও বললেন, শুধুমাত্র তাঁর নিজের কমিক্স-প্রীতির কারণেই কলকাতার ফরাসি কনসুলেটের সঙ্গে জার্মান কনসুলেটের যৌথ কর্মসূচির কথা যখন ভাবা হচ্ছিল, কোনো নিরস, তাত্ত্বিক সেমিনার বা অন্য কিছুর থেকে কমিকসের কথাই তাঁর প্রথম মাথায় আসে৷
এবং কমিক্স আদতেই যে দেশ বা ভাষার ব্যবধান ঘুচিয়ে সম্মিলিত সৃজনশীলতার যথার্থ এক মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে, তা প্রমাণিত হয়েছে এই কর্মশালায়৷ কনসাল জেনারেল শ্মিডশেন রীতিমত অবাক হয়েছেন যে কলকাতার শিক্ষার্থীরাও কতটা তৈরি কমিক্সের প্রকাশভঙ্গী রপ্ত করতে! সেই কারণেই ভাবনায় আছে, পরবর্তী বছরে যদি এই ওয়ার্কশপ আরও ব্যাপক মাপে করা যায়৷
এবং নিছক কোনো মজার গল্প নয়, এবারের কমিক্সে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষনের প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে, তথাকথিত যে ‘ব্লু কলার জব' সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী জার্মানি৷ বিদেশে যাঁরা কাজ শিখতে বা কাজ করতে যান, তাঁরা যে সবাই তথ্য-প্রযুক্তির মতো হাই প্রোফাইল, তথাকথিত ‘হোয়াইট কলার জব' করবেন, তা নাও হতে পারে৷ এই বার্তাটাই জার্মানি তথা ইওরোপ এখন দিতে চাইছে ভারতের মতো দেশগুলোকে, যেখানে প্রশিক্ষিত, দক্ষ কর্মীদেরও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে৷ এই কমিক্স হয়ত সেই বার্তাটিকে আরও প্রাঞ্জল করে দেবে৷