জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিকাজের উপরেও প্রভাব পড়ছে, এ বিষয়ে আর সন্দেহ নেই৷ ইউরোপে বড় আকারে এক গবেষণাক্ষেত্রে হাতেনাতে সেই পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক বোঝার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা৷
বিজ্ঞাপন
চাষের ক্ষেত্রে পানির অভাব পূরণে গবেষণা
02:54
এক বিশাল খেতে প্রত্যেক মরসুমে প্রায় ১০ লক্ষ কিলোগ্রাম পরিমাণ পালং বা লেটুসের মতো পাতা উৎপাদন হয়৷ জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে শস্য উৎপাদনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, তা বোঝার জন্য এই ক্ষেত্র গবেষকদের কাছে খোলা আকাশের নীচে এক গবেষণাগারের মতো৷ জলবায়ু সংক্রান্ত বর্তমান মডেল সঠিক প্রতিপন্ন হলে ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলে অদূর ভবিষ্যতে পানির মারাত্মক অভাব দেখা যাবে৷ এমনটা ঘটলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও তার মানের উপর কী প্রভাব পড়বে, বিজ্ঞানীরা তা জানতে চান৷ খাদ্য বিষয়ক মাইক্রোবায়োলজিস্ট মাবেল গিল বলেন, ‘‘২৫ শতাংশ কম পানি ব্যবহার করে সেচের কাজ করলে আদতে সুবিধাই হবে বলে আমাদের ধারণা৷ কম পানি ব্যবহার করলে পরিবেশের উপকার হবে৷ তাছাড়া এর ফলে কিছু শাকসবজি আরও বেশিদিন তাজা থাকবে৷''
গবেষকদের ধারণা, বিভিন্ন পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে পানির অভাব পূরণ করা সম্ভব৷ গাছপালার উপর এই অবস্থার প্রভাব তাঁরা খতিয়ে দেখছেন৷ মাবেল গিল মনে করেন, ‘‘কিছু প্রজাতি খরা ও পানির অভাব আরও ভালোভাবে সামলাতে পারে৷ ভিন্ন ধরনের পুষ্টির উপাদানও সৃষ্টি করা যেতে পারে৷ যেমন কৃষিপণ্যের মান বাড়াতে সারের মধ্যে আরও নাইট্রোজেন যোগ করা যায়৷ শোধনাগারের মতো পানির বিকল্প উৎস ব্যবহার করাও সম্ভব কিনা, তাও আমরা খতিয়ে দেখছি৷ সেচ ব্যবস্থায় এমন পানি ব্যবহার করলে শাকসবজি নিরাপদ হবে কিনা, সেগুলি কত সময় তাজা থাকবে – সে সবও আমরা দেখতে চাই৷''
ফসল তোলার আগে ও পরে প্যাথোজেন, টক্সিন, কীটনাশক ও অন্যান্য বিষয় শাকসবজির নিরাপত্তা ও মানের উপর কত প্রভাব ফেলে, বিজ্ঞানীরা সেই প্রশ্নেরও উত্তর চান৷ পরিবর্তনশীল জলবায়ুর ফলে সমস্যাগুলিও কীভাবে বদলে যাবে, সেটাও বড় প্রশ্ন৷ ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল কি আরও শুষ্ক হয়ে উঠবে এবং উত্তরে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত বাড়বে? খাদ্য মাইক্রোবায়োলজিস্ট হিসেবে আনা আলেন্দে বলেন, ‘‘আমাদের মনে হয়েছিল, আর্দ্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষিপণ্যের মান ও নিরাপত্তাও বাড়বে৷ কিন্তু এখন আমরা জানি, যে আর্দ্রতা আসলে কিছু ধরনের প্যাথোজেনকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে৷ তাই আমরা বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা একটু কমানোর পক্ষে সওয়াল করছি৷ এই সব কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়ে সেই মাত্রা ৯৫ থেকে ৯৬ শতাংশের নীচে আনতে হবে৷''
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ‘ভাসমান’ যুদ্ধ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় আবাদি জমি বছরে ছয় মাসেরও বেশি সময় পানির নীচে তলিয়ে থাকে৷ জলবায়ু পরিবর্তনকে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকার গল্প শুনুন তাদের মুখেই৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
শৈশব থেকেই ভাসমান চাষ করেন সানোয়ার মিয়া
পিরোজপুর জেলার বৈঠাকাটা ইউনিয়নের সানোয়ার মিয়ার বয়স ৪৩ বছর৷ শৈশব থেকেই বাবার হাত ধরে শিখেছেন ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ৷ পাঁচ হাজার টাকায় এক খণ্ড জমি দুই বছরের জন্য লিজ নিয়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের সবজির চারা উৎপাদন করছেন৷ সব খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তাতে সংসার চলে যায় কোনোরকমে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
মৌসুমে পাঁচবার চারা
বাবুল হাওলাদার যে যায়গাটিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন, সেটি তাঁর নিজেরই৷ শুকনো মৌসুমে মাত্র একবার এ জমিতে ধান চাষ করতে পারলেও ডুবন্ত জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে তিনি কমপক্ষে পাঁচ বার চারা উৎপাদন করতে পারেন৷ এতে তাঁর লাভও ভালো হয়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
স্বামীকে সহায়তা করেন আকলিমা
আকলিমা বেগমের স্বামী ভাসমান পদ্ধতিতে গাছের চারা ও সবজি চাষাবাদ করেন জলভূমিতে৷ স্বামীর কৃষিকাজে সবসময় সহায়তা করেন তিনি৷ বীজ বপন থেকে চারা গজানো পর্যন্ত যতরকমের পরিচর্যা, তার সবই তিনি করে থাকেন বাড়ির আঙ্গিনায় বসে৷ ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদে, চারা গজানোর কাজটি বাড়িতেই করতে হয়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
বীজ বপন করেই চলে সংসার
আঞ্জু আরা বেগম অন্যের জমির জন্য বীজ বপনের কাজ করেন৷ কচুরিপানা ও ঘাস দিয়ে একটি গোলাকার বল তৈরি করে তার ভেতরে বীজ বপন করতে হয়৷ এক হাজার বীজ বপনের জন্য তিনি পারিশ্রমিক পান দেড়শ টাকা৷ দিনে সর্বোচ্চ দেড় হাজার পর্যন্ত বীজ বপন করতে পারেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
ভাসমান চাষাবাদ সহজ
ডুবে থাকা জমিতে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদই সহজ মনে হয় বৈঠাকাটা এলাকার খায়রুল ইসলামের কাছে৷ ভাসমান পদ্ধতিতে তিনি বিভিন্ন রকম লতা-জাতীয় সবজি চাষ করেন৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
কচুরিপানা বিক্রি
হারুনুর রশীদের মতো অনেকেই আছেন, কচুরিপানা বিক্রিই যাঁদের একমাত্র পেশা৷ বাড়ির আশপাশের বিভিন্ন নীচু এলাকায় তাঁরা আটকে রাখেন কচুরিপানা৷ মৌসুমে তা বিক্রি করেন কৃষকদের কাছে৷ এক নৌকা কচুরিপানা বিক্রি হয় পাঁচ থেকে আট হাজার টাকায়৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
শ্যাওলা-ঘাস বিক্রি করেন হারেছ মিয়া
ভাসমান পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য পানির নিচের শ্যাওলা খুবই প্রয়োজনীয়৷ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে কৃষকদের কাছে শ্যাওলা বিক্রি করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
ছয় মাসে ছয় বার
নিজের জলমগ্ন জায়গায় ছয় মাসে ছয় বার সবজির চারা উৎপাদন করেন আব্দুর রহমান৷ প্রথম দুই বারের চারা বিক্রি করে তাঁর সব খরচ উঠে যায়, বাকি চার বারের পুরোটাই লাভ৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman.
জৈব পদ্ধতিতেই চাষাবাদ
নাজিরপুরের রুহুল আমিন জানান, ভাসমান পদ্ধতিতে যে চাষাবাদ হয়, তাতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার করতে হয় না৷ পচা কচুরিপানাই এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে জৈব সার হিসেবে কাজ করে৷