গাঁজার নেশা তেমন ক্ষতিকারক নয় বলে যারা মনে করেন, বিশেষজ্ঞরা তাদের সাবধান করে দিচ্ছেন৷ বিশেষ করে কম বয়সে নিয়মিত বেশি করে গাঁজা সেবন করলে শরীর ও মনের উপর তার কুপ্রভাব তুলে ধরা হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর গাঁজা সেবনকারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে৷ বিশেষ করে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে জয়েন্টের প্রতি আসক্তি বাড়ছে৷
প্রফেসর মাক্সিমিলিয়ান গার সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, যত কম বয়সে এমন আসক্তি হয়, ক্ষতির ঝুঁকির মাত্রাও তত বেশি হয়৷ এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি, যেসব মানুষ জীবনের প্রথম পর্যায়ে, অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সে নিয়মিত ও বেশি পরিমাণ গাঁজা সেবন করেছেন, তাঁদের শরীরে ক্রনিক ও স্থায়ী পরিবর্তন এসেছে৷ এমনকি মস্তিষ্কেও পরিবর্তন ঘটেছে৷ বিশেষ করে মস্তিষ্কের সামনের অংশে, যেখানে সমস্যার সমাধান, নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণের মতো কাজ হয়, সেখানে এমন প্রভাব দেখা যায়৷ এ ক্ষেত্রে কম বয়সে নিয়মিত গাঁজা সেবন শুরু করা মানুষের মস্তিষ্কের সংকোচন লক্ষ্য করা গেছে৷''
জয়েন্ট সেবন শুরু করার সময়ে লিনুস নয়মায়ারের কখনো কোনো মানসিক সমস্যা ছিল না৷ কিন্তু কয়েক মাস ধরে গাঁজা সেবনের পর তাঁর ‘প্যানিক অ্যাটাক' শুরু হলো৷ লিনুস বলেন, ‘‘ঘাম, টাকিকার্ডিয়া বা বুক ধড়ফড়ানি, গা গুলানো, মাথা ঘোরা শুরু হলো৷ মাথায় নানা চিন্তা ঘুরে চলতো, কিন্তু সেগুলির নাগাল পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না৷ কখনোই সম্পূর্ণ চিত্র পেতাম না৷ মনে ভয় জন্মাতো৷ এমন অবস্থার ঠিকমতো বর্ণনা দেওয়া কঠিন৷ মনে হতো, যে কোনো মুহূর্তে মরে যেতে পারি, হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারবো না৷ যে কোনো চেষ্টা শুরু করি না কেন, খেই হারিয়ে যেত৷''
বর্তমানে এমন অবস্থার জিনগত উৎস নিয়ে গবেষণা চলছে, যা অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে৷ মাদকের গঠনও এ ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে৷ প্রফেসর মাক্সিমিলিয়ান গার বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরে ‘ক্যানাবিস স্যাটাইভা' জাতের গাছ পালনের চেষ্টা করা হয়েছে, যার টিএইচসি মাত্রা বেশি৷ কারণ সে ক্ষেত্রে সিউডোফিন বা মানসিক প্রভাব আরও শক্তিশালী হয়, সেটা একটা বড় ভূমিকা পালন করে৷ এক গবেষণার আওতায় আমরা ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এমন রোগী সম্পর্কে তথ্য বিশ্লেষণ করেছিলাম৷ আমরা লক্ষ্য করলাম, এই সময়কালে জার্মানির হাসপাতালগুলিতে গাঁজা সেবনের কারণে মানসিক ব্যাধি নিয়ে অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়েছিলেন৷''
বার্লিনে ‘৪২০’ উদযাপনে গাঁজা সেবন বৈধ করার দাবি
প্রতি বছর ২০ এপ্রিল বিশ্বের অনেক দেশেই এ দাবি তোলেন গাঁজাসেবীরা৷ এবার রাজধানী বার্লিনে সমবেত হয়ে জার্মানির নতুন জোট সরকারের কাছে এ দাবি আরো জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন সমাজের নানা পেশার গাঁজাসেবীরা৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Ben Werner Knight/DW
কেন ‘৪২০’?
গাঁজাসেবীদের কাছে দিনটি আসলে ৪২০, ৪:২০, বা ৪/২০৷ প্রতি বছরের চতুর্থ মাস, অর্থাৎ এপ্রিলের ২০ তারিখ বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে বিশেষ এ দিনটি উদযাপন করা হয়৷
ছবি: Ben Werner Knight/DW
৫০০ গাঁজাসেবীর সমাবেশ
বুধবার বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে বিভিন্ন বয়স, শ্রেণি, পেশার অন্তত ৫০০ জন গাঁজাসেবী সমবেত হয়ে ‘৪২০’ উদযাপন করেন৷ প্রতিবছরের মতো এবারও গাঁজা সেবন বৈধ করার দাবি ছিল তাদের মুখে৷ জার্মানির বর্তমান জোট সরকার এর আগে দেশে গাঁজা বৈধ করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের অঙ্গীকার করছিল৷ তাই ‘৪২০’ দিবসে দাবিটা আরো জোরালোভাবে উঠে আসে গাঁজাসেবীদের মুখে৷
ছবি: Ben Werner Knight/DW
বার্লিনে যারা ছিলেন
বুধবার ব্রান্ডেনবু্র্গ গেটের সামনে হাজির ছিলেন বিভিন্ন বয়স এবং পেশার গাঁজাসেবী৷ সাধারণ চাকুরিজীবী, অ্যাক্টিভিস্ট, র্যাপার, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী, ক্ষুদ্র গাঁজা ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি পথ্য হিসেবে গাঁজা সেবন করেন এমন রোগীরাও ছিলেন সেখানে৷
ছবি: Ben Werner Knight/DW
সরকারের অবস্থান
গত ডিসেম্বরে জোট সরকারের পক্ষ থেকে লাইসেন্সধারী দোকানে প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য সীমিত পরিমানে গাঁজা বিক্রি বৈধ করার আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করা হয়েছিল৷ সরকার মনে করে, সীমিত পরিসরে গাঁজা সেবনকে বৈধতা দিলে ভেজাল গাঁজা সেবন বন্ধ করা এবং তরুণ সম্প্রদায়কে নেশাগ্রস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করা নিশ্চিত করা যাবে৷ জোট সরকারের অন্যতম শরিক গ্রিন পার্টি বুন্ডেসটাগে এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একটা খসড়া জমা দিয়েছে৷
ছবি: Markus Schreiber/AP Photo/picture alliance
গাঁজাসেবীদের দাবি
বুধবার ব্রান্ডেনবুর্গ গেটে সমবেত হয়ে গাঁজাসেবীরা জোট সরকারের কাছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাঁজাসেবনকে আর অপরাধ হিসেবে গণ্য না করার আইন প্রণয়নের দাবি জানান৷
ছবি: Ben Werner Knight/DW
জার্মানিতে গাঁজাসেবন
জার্মানিতে ৪০ লাখের মতো মানুষ গাঁজা সেবন করেন বলে ধারণা করা হয়৷২০২১ সালে ড্যুসেলডর্ফের হাইনরিশ হাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে সারা দেশে গাঁজা সংক্রান্ত মামলায় পুলিশের নানাভাবে যে ব্যয় করেছে তার আর্থিক মূল্য ১.৬৩ বিলিয়ন ইউরোর মতো৷ এর সঙ্গে আদালতের ব্যয় ৪৪৪.৭ মিলিয়ন ইউরোও যোগ করলে দেশের সার্বিক ব্যয়টা কিন্তু বিশাল৷
ছবি: Ben Werner Knight/DW
সরকারের ধীরে চলো নীতি
জার্মানির মাদক ও নেশা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সংস্থার এক মুখপাত্র বলেন, বর্তমান সরকার সীমিত পরিসরে গাঁজা সেবন বৈধ করার পক্ষে, তবে সরকার মনে করে, এ সংক্রান্ত আইনটি তাড়াহুড়ো করে প্রণয়ন করলে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ কৃষি, অর্থনীতি, বিচার এবং পররাষ্ট্র- কমপক্ষে এই চারটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা করে প্রণয়ন করতে হবে আইনটি৷ তাই একটু সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকার৷
ছবি: Ben Fajzullin/DW
7 ছবি1 | 7
এমন রোগীর সংখ্যা সব মিলিয়ে পাঁচ গুণ বেড়ে গিয়েছিল৷ সেইসঙ্গে লিনুস নয়মায়ারের মতো রোগী ভর্তি না হয়েও চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে এসেছেন৷ তাঁর আরও ঘনঘন ‘প্যানিক অ্যাটাক' হচ্ছিল এবং তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন৷ এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ গাঁজার কারণে সাইকোসিস শনাক্ত করে ভীতি কাটাতে তাঁর জন্য অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধের প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছিলেন৷ হাই স্কুলের গণ্ডি শেষ করার সেই বয়সে তিনি আচমকা এমন অ্যাটাক সামলাতে শিখেছিলেন৷ লিনুস বলেন, ‘‘আমি নিজে যেটা লক্ষ্য করেছিলাম, সেটা হলো অ্যাটাক হতে দিলে তার সংখ্যা কমে যায়৷ এমনই কিছু ঘটে৷ যখন মনে হয় উদ্বেগ বা ভয় দেখা দিচ্ছে, তখন ভাবতাম যা হবার হবে৷ আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো বা হয়তো মরেই যাবো৷ সেটা হতে দেবার চিন্তা বা ‘নিজেকে উন্মুক্ত' করার সেই ভাবনা থেকেই আমার অবস্থার উন্নতি হলো৷''
নানা প্রচলিত গুজব ভুল প্রমাণ করে গাঁজা যে সত্যি আসক্ত করে তোলে, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে৷ এমন ভুল ধারণার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়৷ প্রো. মাক্সিমিলিয়ান গার মনে করেন, ‘‘সত্যিকারের আসক্তি থাকলে খুব কম রোগীই প্রথম চেষ্টায় মাদক সেবন বন্ধ করতে পারে এবং সেই সিদ্ধান্ত ধরে রাখতে পারে৷ অর্থাৎ, গাঁজা সেবন চালিয়ে যাবার হার অত্যন্ত বেশি৷ রোগী এর পরেও গাঁজা সেবন করতে থাকলে এবং তারপর থামিয়ে দিলে আরও খারাপ প্রভাব দেখা যায়৷ তার পরেও কিছু উপসর্গ থেকে যেতে পারে৷''
লিনুস সেটা পেরেছেন৷ ছয় বছর ধরে সাইকোথেরাপির পর তাঁর আজ কোনো উপসর্গ নেই৷ ধাপে ধাপে ওষুধ খাওয়াও বন্ধ করতে চান তিনি৷ উচ্চশিক্ষা শেষ করে তিনি ইতোমধ্যে নির্মাণক্ষেত্রে ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেছেন৷ লিনুস আর কখনোই জয়েন্ট না ধরানোর ব্রত নিয়েছেন৷
গাঁজা চাষে ভবিষ্যৎ দেখছে পাকিস্তান
২০২১ সালে শিল্পের জন্য বৃহদাকারে গাঁজা চাষের অনুমতি দেয়ার পরিকল্পনা করেছে পাকিস্তান সরকার৷
ছবি: NDR
গাঁজার বাজার
অনেকের কাছে মাদক হিসেবে পরিচিত হলেও চিকিৎসায় গাঁজা ব্যবহার হচ্ছে যুগ যুগ ধরে৷ ঔষধ শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা৷ বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল মার্কেট ইনসাইটের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বে গাঁজার বৈধ বাজারের আকার ৫৯ হাজার কোটি ডলার ছাড়াবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Medina
জাতিসংঘে ভোটাভুটি
সম্প্রতি সদস্য দেশগুলোর এক ভোটাভুটির মাধ্যম গাঁজাকে কঠিন মাদকের তালিকা থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ৷ চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় গাঁজার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই নেয়া হয় এই সিদ্ধান্ত৷ এর আগে ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এই বিষয়ে জাতিসংঘকে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়েছিল৷
ছবি: Nature Picture Library/imago images
পাকিস্তানের পরিকল্পনা
গত কয়েক বছর ধরেই ভালো যাচ্ছে না পাকিস্তানের অর্থনীতি৷ দেশটির কৃষি শিল্প পড়তির দিকে৷ রপ্তানির ৬৪ ভাগ যেই তুলা থেকে আসে ২০১৯ সালে তার উৎপাদন ২০ ভাগ কমেছে৷ এ কারণে লোকসানে পড়ছেন কৃষকরা৷ সেই জায়গায় গাঁজা চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছে দেশটির সরকার৷
ছবি: Imago Images/All Canada Photos
শতকোটি ডলারের হাতছানি
শিল্পে ব্যবহারের জন্য গাঁজা চাষের অনুমতি দেবে পাকিস্তান৷ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এমন ঘোষণা এসেছে সরকারের তরফ থেকে৷ দেশটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের একটি অংশ ধরতে পারলে তিন বছরে এই খাত থেকে পাকিস্তানের আয় দাঁড়াবে ১০০ কোটি ডলার৷ যেখানে গোটা আন্তর্জাতিক বাজারের আকার এখন ২৫ হাজার কোটি ডলার৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/J. Marshall Mantel
পরিবেশ-বান্ধব ও সহজ চাষ
পাকিস্তানে বসবাসরত জার্মান পরিবেশবিদ হেলগা আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, গাঁজা এমনকি খারাপ আবহাওয়াতেও সহজে চাষ করা সম্ভব৷ ‘‘এর উৎপাদনে কোনো কীটনাশকের প্রয়োজন নেই, যার কারণে এটি পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ৷ এমনকি অল্প জমিতেও এটি যথেষ্ট জন্মে এবং তুলার চাষের চেয়ে কম পানির প্রয়োজন হয়৷
ছবি: Richard Vogel/AP/picture alliance
গাঁজা-সংস্কৃতি
অ্যালকোহলের বিষয়ে রক্ষণশীল হলেও পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যানাবিস বা গাঁজা উন্মুক্তভাবেই চাষ এবং বেঁচাকেনা হয়ে আসছে৷ বিশেষ করে আফগানিস্তানের কাছে সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী অনেক আগে থেকেই গাঁজা চাষ করছে৷ সেসব ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও কার্যকর৷