1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

করতোয়া ট্রাজেডি: দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্বহীনতা

সাংবাদিক
মাসুদ কামাল
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

‘অল অফ আস আর ডেড’ নামে একটা কোরিয়ান টিভি সিরিজ আছে৷ নেটফ্লিক্সে এটা ইদানিং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷

করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে প্রাণ যাওয়া একজনের লাশছবি: Firoz Al Sabah

কাহিনিটা এমন- একটা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে হঠাৎ করেই একটা অজানা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়৷ আর এতে একের পর এক ছাত্রদের মৃত্যু হতে থাকে৷ ছাত্র-ছাত্রীরা বাঁচার চেষ্টা করলেও তারা স্কুলের দায়িত্ববান কারো কোনো সাহায্য পায় না৷ এই বাঁচার চেষ্টা আর একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা নিয়েই এই সিরিজের কাহিনী৷

মুভিটির তিন চারটি এপিসোড প্রচার হওয়ার পরই অনেক দর্শক এর সঙ্গে কোরিয়ায় ২০১৪ সালের বহুল আলোচিত ফেরি ডুবে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে এর মিল খুঁজতে লাগলেন৷ দুই জায়গাতেই ভিকটিম হয়েছিল স্টুডেন্টরা৷ কিন্তু তাতেই বা মিল কোথায়? ওটা তো ছিল ফেরি ডুবির ঘটনা, আর এটি স্কুলে ভাইরাস সংক্রমণের৷ স্থান ও মৃত্যুর ধরনে সাদৃশ্য না থাকলেও মিলটা হলো- বড়দের দায়িত্বহীনতার৷ দুই জায়গাতেই যাদের দয়িত্ব পালনের কথা ছিল, তারা তা করেনি৷ ফেরি দুর্ঘটনার বিষয়টি আরও একবার তাহলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে৷ ছাত্র-ছাত্রীভর্তি ফেরিটা যখন ডুবতে শুরু করে, ফেরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তখন এই স্টুডেন্টদের বলেছিল- শীঘ্রই সাহায্যকারী বোটগুলো চলে আসবে৷ তারা যেন সবাই নিজ নিজ কেবিনে অবস্থান করে৷ কিশোর-কিশোরীরা বড়দের সেই কথাগুলোকে বিশ্বাস করেছিল, কেবিনের ভিতরেই তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে৷ সাহায্যকারী বোটগুলো আর আসেনি৷ অসহায়ভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হয়েছিল ৩০৬ জনকে৷ এর মধ্যে ২৯৯ জনই ছিল স্টুডেন্ট৷ শেষ মুহূর্তে সবচেয়ে কুৎসিত যে ঘটনাটি ঘটেছিল সেটা হচ্ছে- ফেরির ক্যাপ্টেনসহ ক্রুরা ঝাপিয়ে পড়ে নিজেদের জীবন রক্ষা করেছিল৷

এই যে দায়িত্বহীনতা, এর সঙ্গে আমাদের দেশে অতি সম্প্রতি করতোয়া নদীতে যে ৬৯ জনের সলিল সমাধি ঘটল, তার সঙ্গে কি কোন মিল দেখা যায়? আমি তো মনে করি- যায়, মিল দেখা যায়৷ কেবল করোতোয়ার ঘটনার কথাই বা বলি কেন, আমাদের দেশে কিছুদিন পর পরই যে নৌ-দুর্ঘটনা হয়, শত শত নিরীহ মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়, সবকিছুর সঙ্গে আমি ওই মিলটা খুঁজে পাই৷ সবই যেন দায়িত্বহীনতার এক একটা প্রকট উদাহরণ৷

গত ২৫ সেপ্টেম্বর, রোববার করতোয়া পাড়ে অনেক মানুষ একত্রিত হয়েছিল ওপারে যাবে বলে৷ পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার আউলিয়া ঘাট থেকে তারা যাবেন নদীর অপর পারের বদেশ্বরী মন্দিরে৷ মহালয়া উপলক্ষে প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক মানুষ ওই মন্দিরে যান৷ অনেক পুরানো এই মন্দিরে এই সময়ে লোক সমাগম নতুন কিছু নয়৷ প্রতি বছরই হয়৷ সেজন্য মন্দির কমিটি আগেভাগেই নদী পারাপারের ঘাট ইজারাদারকে বলেছিল বাড়তি নৌকার ব্যবস্থা করতে৷ কিন্তু সে ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত হয়নি৷ ফলে এক নৌকাতেই হুড়োহুড়ি করে উঠে পড়েছিল বেশি মানুষ৷ মাঝ নদীতে যাওয়ার পরই ডুবে যায় নৌকাটি৷ মানুষের ওপর মানুষ পড়তে থাকে, ফলে যারা সাঁতার জানেন, তারাও রেহাই পাননি৷ এ পর্যন্ত ৬৯ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে, পাঁচজন এখনো নিখোঁজ৷

এই যে বিপুল মৃত্যু, এর দায় কার? কেবলই কি নিয়তির? এরকম আর সব ঘটনার মতো এক্ষেত্রেও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ পাঁচ সদস্যের কমিটি৷ প্রথমে বলা হলো- তিনদিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে৷ তিনদিনের মাথায় এসে তারা বাড়তি সময় চাইল, বাড়িয়ে দেওয়া হলো আরও পাঁচদিন৷ বিভিন্ন তদন্ত কমিটির অতীত যেসব নজির দেখেছি, আশা করা যায় পাঁচ দিন পর যদি তারা আবারো সময় চায়, বাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ এরকম হয়, তারপর একসময় সবাই ভুলে যায়৷ অনেক পরে যখন তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়, তখন সেখানে কি সব গোঁজামিল দেওয়া হয়- সেটাও হয়তো কেউ খেয়াল করে না৷ তবে এক্ষেত্রে তদন্তের একেবারে শুরুর দিকেই কমিটির এক সদস্যের একটা মন্তব্য আমার নজরে এসেছে৷ তিনি মন্তব্য করেছেন, প্রাথমিকভাবে নাকি তার কাছে মনে হয়েছে জনগণের অসাবধানতাই এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী৷ তো দায়ী চিহ্নিত হয়েই গেছে! তাহলে আর তদন্তের নামে সময়ক্ষেপন কেন? কেন সময় বাড়িয়ে নেওয়া?

এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর, দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. ইমরান উদ্দিনের একটা বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, দেশে নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পেছনে সরকারের নজরদারির ঘাটতি একটা বড় কারণ৷ তার এমন মন্তব্যটির বিষয়ে পত্রিকাটি পাঠকদের মতামত জরিপ করেছে৷ সেখানে দেখা গেছে ৯২ শতাংশ মানুষ তার মন্তব্যকে সমর্থন করেছে৷ আসলে এটাই সাধারণের অভিমত৷ কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা, বিশেষ করে সরকার ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা কি এভাবেই ভাবেন? আমার তা মনে হয় না৷ তারা যদি এরকমই ভাবতেন, তাহলে তদন্তের শুরুতেই সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করে মন্তব্য করতে পারতেন না৷ আমি নিশ্চিত প্রশাসনের ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত ওই তদন্তকমিটির রিপোর্ট যখন পাওয়া যাবে, তখনও ওই সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা ও অসচতেনতাকেই দায়ী করা হবে৷ প্রশাসনের কোনো কর্তা ব্যক্তির দোষ খুঁজে পাওয়া যাবে না৷

প্রশাসনের দায়মুক্তির পক্ষে কী কী যুক্তি দেওয়া হবে, সেসবও আমরা বুঝি৷ বলা হবে- সতর্কতা এড়াতে ঘাটে আগে থেকেই পুলিশ, গ্রাম পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছিল৷ কেবল তাই নয়, নৌকায় যখন লোকজন উঠছিল, তখন বারবার সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছিল যে লোক বেশি হয়ে গেছে৷ এমনকি হ্যান্ড মাইকে পর্যন্ত বলা হয়েছি, আর লোক না উঠতে৷ তারপরও যদি লোকজন কথা না শুনে, তাহলে আর কি করার থাকে?

কি অসাধারণ যুক্তি! আসলেই কি মাইকিং আর মৌখিক অনুরোধের পর আর কিছু করার থাকে না? পুলিশের কাজ কি তাহলে কেবল মৌখিক অনুরোধ করা? কোনো বিরোধীদলের সমাবেশ যখন তারা ভন্ডুল করে দেয়, তখন কি ওই মৌখিক অনুরোধের মাধ্যমেই করা হয়? 

সড়ক দুর্ঘটনার সঙ্গে নৌ দুর্ঘটনার একটা মৌলিক পার্থক্য রয়েছে৷ নৌ দুর্ঘটনা হয় পানিতে, সাঁতার না জানলে সমূহ আশঙ্কা মৃত্যুর৷ এমনকি সাঁতার জানলেও অনেক সময় বাঁচা যায় না৷ করতোয়ার নৌকাডুবিতেও এরকম ঘটেছে, নিহতদের অনেকেই সাঁতার জানতেন, কিন্তু মানুষের উপর মানুষ পড়াতে, তারা আর বাঁচতে পারেননি৷ পানিতে যাতায়াত যখন এতোটাই ঝুঁকিপূর্ণ, তখন কি সরকারের দায়িত্ব নয়- লঞ্চ নৌকা এবং এর চালকদের যোগ্যতা পরীক্ষা করা? সরকারের একটা নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয় রয়েছে৷ তারা কি এটি করেন? করেন যে না, তার প্রমাণ খুঁজতে দূরবীন হাতে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না৷ যে কোন নদী চলাচলকারি নৌকা মালিককের কাছে জানতে চাইলেই উপলব্ধি করা যাবে৷ কিছু লঞ্চের হয়তো লাইসেন্স আছে, কালেভদ্রে ফিটনেসও পরীক্ষা করা হয়৷ কিন্তু নৌকার? খেয়া নৌকার? সরকার খেয়াঘাটগুলোকে ইজারা দেয়, সেখান থেকে অর্থ পায়৷ কিন্তু ইজারাদার যে নৌকাটি দিয়ে মানুষজনকে পারাপার করে, সেটি চলাচলের উপযোগী কিনা, অথবা উপযোগী হলে তার ধারনক্ষমতা কত, সেটা কি কখনো পরীক্ষা করে? এসব প্রশ্নের উত্তর আসলে সবাই জানে৷ যেটা জানে না, সেই প্রশ্নটি হচ্ছে- তাহলে নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়টি আছে কেন? তাদের কাজটা কি? দেশের সিংহভাগ মানুষ যে সকল নৌযানে চলাচল করে, সেগুলো মানুষের জন্য নিরাপদ কি-না, সেটা তাহলে কে দেখভাল করবে?

মাসুদ কামাল, সাংবাদিকছবি: Hashibur Reza Kallol

তাহলে দায়িত্বটা আসলে কার? যাদের দায়িত্ব পালনের কথা, তারা আসলে কি করছেন? তারা যদি দায়িত্বটি পালন না করেন, তাহলে তাদেরকে কি বিচারের আওতায় আনা যাবে না?

‘অল অফ আস আর ডেড’ সিরিজটি এখনো চলমান, আগামী পর্বগুলোতে হয়ত জানা যাবে দায়িত্বহীন ‘দায়িত্ববান’ কি সাজা দেওয়া হবে৷ তবে ফেরি দুর্ঘটনার দায়িত্বহীনদের কিন্তু ঠিকই বিচারের আওতায় আনা হয়েছে৷ ফেরির ক্যাপ্টেনসহ ১৪জন ক্রুকে বিচার করা হয়েছিল৷ এদের মধ্যে ক্যাপ্টেনসহ চারজনের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল হত্যার অভিযোগ৷ ক্যাপ্টেনকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন বা ৩৬ বছরের কারাদণ্ড৷ দক্ষিণ কোরিয়াতে সেই সময় যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি প্রকাশ্যে এই ঘটনার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন৷

আচ্ছা, দেশের প্রেসিডেন্ট কি সেই সময়ে ফেরিটি চালাচ্ছিলেন? তিনি বলতেই পারতেন, আমি তো চালাচ্ছিলাম না, আমি তো ওই ফেরি চলাচলের কোন পর্যায়েই জড়িত ছিলাম না, তাহলে আমি কেন ক্ষমা চাইব? কিন্তু ওই দেশে, ওইরকম সভ্যতায় এসব অজুহাত স্বাভাবিক নয়৷ আমাদের দেশ কোরিয়া নয়, বাংলাদেশ৷ এখানে বোধকরি সবই সম্ভব৷ এখানে অপরাধবোধ তো দূরের কথা, সৌজন্যতাবোধ পর্যন্ত দেখতে পাওয়াটা বিরল বিষয়৷

শেষ করার আগে একটা বিষয় খুব জানতে ইচ্ছা করছে৷ করতোয়ার এই মর্মান্তিক দূর্ঘটনার পর, নৌ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর কোনো প্রতিক্রিয়া বা দুঃখপ্রকাশ কি কেউ দেখেছেন? আমার চোখে পড়েনি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ