জার্মানিতে বসবাসরত প্রতিটি মানুষের সম্মানজনক জীবনযাপন নিশ্চিত করাকে দায়িত্ব মনে করে সরকার৷ আর করোনাকালেও সেই দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকেনি রাষ্ট্রটি৷ বরং করোনার প্রভাবে কেউ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করেছে৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের ধনী দেশ জার্মানি৷ কতটা ধনী সেটা বোঝানো যেতে পারে ছোট্ট এক হিসেব দিয়ে৷ করোনা মহামারির শুরুর দিকেই জার্মান সরকার এই ভাইরাসের ক্ষতি মোকাবিলায় এক ট্রিলিয়ন ইউরো বরাদ্দের ঘোষণা দিয়ে দিলো৷ এক ট্রিলিয়ন ইউরো মানে ৯৫ লাখ কোটি টাকা! বাংলাদেশের বেশ কয়েক বছরের বাৎসরিক বাজেটের সমান এই অর্থ জার্মানরা শুধু করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করছে৷
এবার জানাই,সাধারণ মানুষকে কিভাবে রাষ্ট্রটি রক্ষা করছে৷ জার্মান সরকার শুরু থেকেই করোনার কারণে বেকারত্বের হার যাতে না বাড়ে সেদিকটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে৷ এজন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ সহায়তা করা হয়েছে, যাতে সেসব প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই না করে৷ একইসঙ্গে যেসব কাজ ঘরে থেকে করা সম্ভব, সেগুলো যাতে ঘরে বসে করা হয়, সেটাও নানাভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে৷ পাশাপাশি, যারা এই ভাইরাসের কারণে চাকুরি হারিয়েছেন, তাদের দ্রুত রাষ্ট্রীয় সামাজিক সুযোগ-সুবিধার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে৷ ফলে, আয় কমে গেলেও কেউ ‘অসম্মানজনক' পরিস্থিতিতে পড়ে যাননি৷
করোনার কবলে প্রবাসীরা
বিদেশে প্রায় ১৬৮ টি দেশে ছড়িয়ে আছেন বাংলাদেশিরা৷ সেসব দেশের প্রায় সবই এখন করোনায় কম-বেশি আক্রান্ত৷ আক্রান্ত হয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও৷ অনেকে মৃত্যুবরণও করেছেন৷
ছবি: Reuters/E. Su
হাজার পেরিয়ে
ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী, করোনার কারণে বিদেশের মাটিতে মোট ১৯টি দেশে অন্তত ১ হাজার ৩৭৭ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন৷ বিভিন্ন দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ হাজার৷ ৫ জুলাই পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এ পরিসংখ্যান দিয়েছে ব্র্যাক৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Scrobogna
সবচেয়ে বেশি মধ্যপ্রাচ্যে
বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রবাসী রয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে৷ সেখানকার ছয়টি দেশেই এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৭৫৩ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/Stringer
সৌদি আরবে মোট মৃতের ২৫ ভাগই বাংলাদেশি
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে মোট সোয়া দুই লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত৷ ৫ জুলাই পর্যন্ত মারা গেছেন দুই হাজার ১০০৷ এর মধ্যে ৫২১ জনই বাংলাদেশি। অর্থাৎ, সৌদি আরবে করোনায় মৃতদের এক চতুর্থাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি। ব্র্যাকের তথ্য অনুযায়ী সৌদিতে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি সংক্রমিত হয়েছেন। এদের মধ্যে বড় অংশই অবশ্য সুস্থ হয়ে গেছেন।
ছবি: Getty Images/AFP/A. Ghani Bashir
আমিরাতে মোট মৃতের এক তৃতীয়াংশ
সৌদি আরবের পর করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে৷ উপসাগরীয় দেশটিতে করোনায় মৃত্যুবরণকারী ৩২৮ জনের ১২২ জনই বাংলাদেশি৷ দেশটিতে মোট আক্রান্ত সাড়ে চার হাজার৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K. Jebreili
কুয়েতে আক্রান্ত চার হাজার
কুয়েতে চার হাজার বাংলাদেশি আক্রান্ত৷ এর মধ্যে ৫ জুলাই পর্যন্ত ৬০ জন প্রাণ হারিয়েছেন৷ গোটা দেশটিতে ৯ জুলাই পর্যন্ত মোট ৫২ হাজার ৮০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছেন ৩৮২ জন৷
ছবি: picture-alliance/AA/J. Abdulkhaleg
ওমানে কুড়ি
ওমানে করোনায় এ পর্যন্ত ২০ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন৷ দেশটিতে মোট প্রাণহানির সংখ্যা ২৩৬, পজিটিভ হয়েছেন প্রায় ৫২ হাজার৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. alHasani
কাতারেও অনেক আক্রান্ত
কাতারে ১২ হাজার বাংলাদেশি আক্রান্ত৷ এরমধ্যে মারা গেছেন ১৮ জন৷ ৯ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে সর্বমোট এক লাখের উপরে আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ১৪২ জন৷
ছবি: Imago Images/M. Gattoni
বাহরাইনে যেমন
বাহরাইনে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার বাংলাদেশি৷ এরমধ্যে মারা গেছেন নয় জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.Al-Shaikh
যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত ১৫ হাজার, মৃত্যুও বাড়ছে
যুক্তরাজ্যে ৩০৫ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি।
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/D. Cliff
সিঙ্গাপুরে সর্বোচ্চ আক্রান্ত, মৃত্যু শূন্য
এখন পর্যন্ত প্রবাসে সবচেয়ে বেশি ২৩ হাজার বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন সিঙ্গাপুরে৷ তাদের বেশিরভাগই শ্রমিক৷ তবে সেখানে তারা সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা পেয়েছেন৷ দেশটিতে বাংলাদেশের কারো প্রাণহানির তথ্যও মিলেনি৷ একইভাবে প্রায় এক হাজার জন্য আক্রান্ত হলেও মালদ্বীপেও কোনো বাংলাদেশি মারা যাননি৷
ছবি: Reuters/E. Su
যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশিরা বিপাকে
সবচেয়ে বেশি করোনায় আক্রান্তের দেশ যুক্তরাষ্ট্র৷ সেখানে বাংলাদেশিরাও ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন৷ মারা গেছেন ২৭২ জন৷ এই দেশটিতেও আক্রান্ত ১৫ হাজারের উপরে৷
ছবি: AFP/J. Eisele
ইটালিতে যথেষ্ট কম
ইউরোপে করোনায় সবচেয়ে বেশি ভুগেছে ইটালি৷ দেশটিতে প্রায় ৩০০ বাংলাদেশি আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন ১৪ জন৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS/M. Scrobogna
অন্যান্য
৫ জুলাই পর্যন্ত ক্যানাডায় নয় জন, সুইডেনে আট জন, ফ্রান্সে সাত জন, স্পেনে পাঁচ জন বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেছেন৷ ভারত, মালদ্বীপ, পর্তুগাল, কেনিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও গাম্বিয়ায় একজন করে বাংলাদেশির করোনায় মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷
ছবি: Mortuza Rashed
13 ছবি1 | 13
মূলত, আর্থিক সহায়তা, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার মাধ্যমে জার্মান সরকার দেশটিতে বসবাসরত প্রতিটি মানুষকে করোনাকালে রক্ষা করে গেছে৷ এবং সেটা একক ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য পরিবারেরক্ষেত্রে৷ খ্রিষ্টানপ্রধান রাষ্ট্রটি পরিবারকে বাড়তি গুরুত্ব দেয় এবং মানুষকে পারিবারিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে উৎসাহী করে৷ তাই করোনাকালে পরিবারগুলো যাতে টিকে থাকতে পারে সেক্ষেত্রেও আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ এক্ষেত্রে শিশুদের স্কুলের বেতন কয়েক মাসের জন্য মওকুফ করা হয়েছে, শিশুদের জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে বাড়তি টাকা দেয়া হয়েছে, যাতে তারা প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে পারে৷ সামগ্রিকভাবে কয়েক মাসের জন্য কেনাকাটার উপর করের হার আগের চেয়ে কমানো হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের অর্থ খরচ কম হয়৷
মোটা দাগে বলা যেতে পারে, জার্মানি করোনাকালে দেশটিতে বসবাসরত প্রতিটি মানুষকে সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট সক্ষম হয়েছে৷ এক্ষেত্রে অভিবাসী বা দেশটির নিজের নাগরিককে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়নি৷ এমনকি দেশটিতে অবস্থানরত বিদেশি শিক্ষার্থীদেরও নানাভাবে সহায়তা করা হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ জার্মানির শিল্পকারাখানাগুলোকেও টিকিয়ে রাখা হয়েছে আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে৷
এতটুকু পড়ে কেউ কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, জার্মানি যে এত অর্থ খরচ করে সেটা আসে কোথা থেকে? ইউরোপের দেশটিতে বসবাসরত সক্ষমদের প্রায় সবাই আসলে চাকুরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ কর প্রদান করা এদেশে বাধ্যতামূলক এবং কর্তৃপক্ষ একেবারে পাই পাই হিসেব করে চাকুরিজীবী বা ব্যবসায়ী - যার ক্ষেত্রে যতটা কর প্রযোজ্য, তা আদায় করে৷ পাশাপাশি শিল্পখাতে জার্মানি অনেক সমৃদ্ধ৷ উঁচু মানের পণ্য রপ্তানিতে দেশটি বিশ্বের একেবারে উপরের সারির দেশগুলোর একটি৷ ফলে জার্মানির অর্থনীতি বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় মজবুত৷ আর সেই মজবুত অর্থনীতি দেশটির সাধারণ মানুষকে করোনার ক্ষতি বুঝতে দেয়নি৷ বরং কেউ কেউ টেরই পায়নি কত বড় এক ঝড় বয়ে গেছে তাদের উপর দিয়ে৷