করোনাকালে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চলছে অর্থনৈতিক সংকট৷ স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তাও পড়েছে সংকটে৷ বাড়ছে ক্ষুধার্তের সংখ্যা৷
বিজ্ঞাপন
রেকর্ড বলছে, ২০২০ সাল আগের সব বছরের তুলনায় অনেক বেশি উষ্ণ ছিল৷ তবে বছরের সবচেয়ে বড় সংকট নিঃসন্দেহে করোনার প্রকোপ৷এ সময়ে বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্যনিরাপত্তা আরো সংকটে পড়েছে৷ বেড়েছে অপুষ্টিজনিত রোগ৷
খাদ্যসংকট ২০২০ সালের আগেও ছিল৷ ২০১৯ সালে বিশ্বে কমপক্ষে ৬৯ কোটি মানুষ ক্ষুধার জ্বালা সয়েছে৷ জাতিসংঘের ধারণা, ২০২০ সালে ক্ষুধায় কষ্ট পাওয়া মানুষের সংখ্যা ৮২ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা৷
২০২০ সালে প্রতি দশজনে একজন মানুষ অন্তত পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য পায়নি৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং সাব সাহারান আফ্রিকার যেসব অঞ্চলে পানির সংকট রয়েছে, কিংবা যেসব জায়গায় আঞ্চলিক সংঘাত চলছে, সেসব জায়গার মানুষ খাদ্যসংকটে বেশি ভুগেছে৷
বেশি ক্ষুধার্ত মানুষ যে ১০ দেশে
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবারের বিশ্ব ক্ষুধা সূচক প্রকাশ করেছে৷ সেখানে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম৷ কোন কোন দেশে বেশি ক্ষুধার্ত মানুষ বাস করছে দেখুন ছবিঘরে৷
কীভাবে এই সূচক?
অপুষ্টির হার এবং পাঁচ বছরের কম বয়সিদের মধ্যে কম ওজন, কম উচ্চতা ও মৃত্যুর হার বিবেচনায় নিয়ে ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে প্রতিটি দেশের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স করা হয়েছে৷ এই সূচকে সবচেয়ে ভালো স্কোর হল শূন্য৷ স্কোর বাড়লে বুঝতে হবে, ক্ষুধার সূচকে সেই দেশের পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ আর স্কোর কমা মানে, সেই দেশের খাদ্য ও পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে৷
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র (৫৩.৬)
এখানকার ৬৩ শতাংশ মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন৷ ২০১২ সাল থেকে জাতিগত সহিংসতা আর সংঘাতে এখানকার খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে৷ একশর মধ্যে ৫৩.৬ স্কোর পেয়ে ক্ষুধার রাজ্যে এদের পরিস্থিতি সবথেকে বেশি খারাপ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Delay
ইয়েমেন (৪৫.৯)
সংঘাতে জর্জরিত দেশটিতে মানবিক সংকট চলছে৷ দিন দিন খাদ্য নিরাপত্তহীনতা বেড়েই চলছে৷ দেশটির ১০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধায় কষ্ট করেন আর শিশুসহ প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ চরম অপুষ্টিতে ভুগছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Mohammed
চাদ (৪২.২)
ক্রমাগত খরা আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে দেশটির মানুষ খাবার সংকটে পড়েন৷ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব দেশটিতে মারত্মকভাবে নানান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে৷
ছবি: Reuters/Emmanuel Braun
মাদাগাস্কার (৪১.৫)
দেশটিতে বছরে গড়ে দেড়টি করে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে৷ এছাড়া তীব্র খরার সঙ্গে প্রকট বন্যা দেশটির অর্ধেক অঞ্চলকে গ্রাস করে৷ জাতিসংঘের ধারণা, দেশটির সাত লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তহীনতায় রয়েছে৷
ছবি: AP
জাম্বিয়া (৩৮.১)
দেশটির বেশিরভাগ কৃষক ফসল উৎপাদনে বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এখানকার ফসল উৎপাদন মারত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে৷ বৃষ্টি, বন্যা আর জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷
ছবি: Imago Images/Zumapress
লাইবেরিয়া (৩৪.৯)
গত দুই বছরে চলমান বৃষ্টিপাতের কারণে দেশটির খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে৷ এই দেশের ১.৮ মিলিয়ন মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন, আর ২.৯ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Jallanzo
হাইতি (৩৪.৭)
দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেশি৷ ২০১০ সালের ভূমিকম্প এবং হারিকেন ম্যাথিউর চলমান প্রভাবসহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধ্বংসাত্মক সংমিশ্রণে ভুগছে দ্বীপ দেশটি৷
ছবি: Roberto Schmidt/AFP/Getty Images
পূর্ব তিমুর (৩৪.৫)
ছোট এই দ্বীপ দেশটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম দরিদ্র৷ এই দেশের ১.২ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য নিরাপত্তাহনীতায় ভুগছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জিম্বাবুয়ে (৩৪.৪)
চলমান খরা আর কয়েকটি প্রদেশে ঘূর্ণঝড়ের বিরূপ প্রভাবে দেশটিতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়ছে৷ খরা, ঘুর্ণিঝড় আর বন্যায় দেশটিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়৷ দেশটির ৩.৬ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
আফগানিস্তান (৩৩.৮)
কয়েক দশকের মধ্যে সম্প্রতি ভয়ঙ্কর খরার মুখে পড়ে দেশটি৷ গতবার প্রবল বৃষ্টি এবং তুষারপাত হওয়ায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়৷ দেশটির পাঁচ মিলিয়ন অর্থাৎ, ১৪ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে৷
ছবি: Gemeinfrei
বাংলাদেশের অবস্থান (২৫.৮)
১১৭টি দেশের মধ্যে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম৷ ২০১৮, ২০১৭ ও ২০১৬ সালে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল যথাক্রমে ৮৬, ৮৮ ও ৯০ নম্বরে৷ এবার বৈশ্বিক অবস্থানে বাংলাদেশের দুই ধাপ পেছানোর কারণ হলো অন্য দেশের দ্রুত গতিতে উন্নতি৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
12 ছবি1 | 12
সম্প্রতি গ্লোবাল ফোরাম ফর ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার (জিএফএফএ)-র এক সভায় করোনাকালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার সংকটের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়৷ ‘অতিমারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের এ সময়ে সারা বিশ্বের মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার উপায়' শীর্ষক এ আয়োজনে বক্তারা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গৃহপালিত পশু খামারের বিস্তারের গুরুত্বের ওপর জোর দেন৷
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চের ডেপুটি ডিরেক্টর ক্লাউডিয়া রিংলার বলেন, উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে যেমন মাংস বেশি খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে তার ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে৷সেখানে অনেকেই সামান্য মাংসও খেতে পায় না৷সেসব অঞ্চলে অপুষ্টিজনিত রোগ এবং সেরকম রোগে শিশুমৃত্যুর হার খুব বেশি৷
‘প্যানডেমিক প্রিভেনশন, ওয়ান হেল্থ, অ্যানিমেল হেল্থ, বায়োডাইভার্সিটি'র উপ-প্রধান বিয়র্ন নিয়েরে মনে করেন, একযোগে মানুষ, প্রাণিকুল এবং পরিবেশের ‘সুস্বাস্থ্য' নিশ্চিত করতে হলে, অর্থাৎ ‘‘সার্বিকভাবে ওয়ান হেল্থ অ্যাপ্রোচ নিয়ে কাজ করতে চাইলে গৃহপালিত পশু যে কৃষির গুরুত্বপূর্ণ অংশ তা ভুলে গেলে চলবে না৷'' তাই গৃহপালিত পশুসহ টেকসই খামারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি৷
করোনাকালেযখন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই অর্থনৈতিক সংকটে, তখনও চলছে খাদ্যের ব্যাপক অপচয়৷ এই বিষয়টিও উঠে আসে বক্তাদের আলোচনায়৷
আফ্রিকান রিসার্চ ইউনিভার্সিটিজ অ্যালায়েন্স সেন্টার অব এক্সেলেন্স ইন সাসটেইনেবল ফুড সিস্টেম (এআরইউএ)-র লিন্ডি মাজেলে সিবান্দা জানান, বিশ্বে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাদ্যের অপচয় হয়, তার প্রায় ৬০ ভাগই হয় খামার থেকে বাজারে পৌঁছানোর আগে৷এমন অপচয় রোধের জন্য বিশ্বের প্রধান ২০টি খাদ্যপণ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদকের সঙ্গে মিলে কাজ করার জন্য তারা চাপ দিচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি৷