বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, করোনাকালে শিশুমৃত্যু বেড়েছে৷ তবে মৃত্যুর কারণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি৷ গবেষকরা বলছেন, সারা বিশ্বে অন্তত দু লাখ ৬৭ লাখ শিশুর মৃত্যুতে ভূমিকা রেখেছে মা-বাবার অর্থনৈতিক দুরবস্থ৷
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে৷ সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্ব ব্যাংকের গবেষকরা দেখতে চেয়েছিলেন শিশুদের দেহে করোনার সরাসরি প্রভাব কম হলেও করোনাকালে শিশুমৃত্যু কমেছে কিনা৷ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই জানা গেছে, জনগণকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দূরে রাখতে কঠোর লকডাউন দিলেও অনেক দেশ নাগরিকদের পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা দিতে পারেনি, আর সেরকম দেশগুলোতেই শিশুমৃত্যু বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে৷
বিশ্বব্যাংকের গবেষকদল ১২৮টি দেশের তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছেন সেসব দেশে ২০২০ সালে শিশুমৃত্যু যেমনটি অনুমান করা হয়েছিল তার চেয়ে অন্তত সাত ভাগ বেড়েছে৷ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশে৷ সেই সাত দেশের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারতে৷ এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন গবেষকরা৷ তাদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ ভারত জনসংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম, সে কারণে ২০২০ সালে তাদের অর্থনীতি ১৭.৩ ভাগ সংকুচিত হয়েছে৷ এর প্রভাব নিম্ন আয়ের মানুষদের ওপর বেশি পড়েছে বলে সেই শ্রেণির মানুষদের পরিবারে শিশুদের জীবনপ্রদীপও এত তাড়াতাড়ি নিভে গেছে বলে মনে করেন তারা৷
জলবায়ু পরিবর্তন: গর্ভেই শিশুমৃত্যু
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন ঝুঁকি দেখতে পেয়েছেন গবেষকরা৷ মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে নারীদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ কমছে মাটির উর্বরতা, গ্রাম ছাড়ছেন অবস্থাপন্নরা৷
ছবি: Mortuza Rashed
জানেন না নারীরা
চট্টগ্রামের চকরিয়া উপজেলার ফাইলাপাড়া গ্রামের নারীরা তাদের গর্ভের সন্তান নষ্ট হবার বিষয়টি স্বীকার করলেও কেউই জানেন না কেন এমন হচ্ছে৷ মাটি ও পানিতে অতিরিক্ত লবণের উপস্থিতি এবং তার প্রভাবের বিষয়টি জানার পর অনেকেই অবাক হয়ে যান৷
ছবি: Mortuza Rashed
পুনরায় গর্ভধারণ
৩২ বছর বয়সী সেনোয়ারা বেগমের আড়াই মাস বয়সী গর্ভের শিশু নষ্ট হয় এক বছর আগে৷ সাত মাস হলো তিনি পুনরায় গর্ভধারণ করেছেন৷ এখন পর্যন্ত গর্ভের বাচ্চা সুস্থ থাকলেও অজানা আশঙ্কা কাজ করছে বলে তিনি প্রতিবেদককে জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed
মৃত্যু ভ্রুণের ছয় মাস আগেই
ফাইলাপাড়া গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অধিকাংশ নারীরই গর্ভের বাচ্চা মারা যায় ভ্রূণের বয়স ৬ মাস হবার আগেই৷ তবে এ বিষয়ে কেউ কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না৷
ছবি: Mortuza Rashed
এরকম হয়েছে সাতবার
দুই কন্যা সন্তানের মা রাজিয়া বেগমের গর্ভের বাচ্চা মারা গেছে সাতবার৷ আক্ষেপ করে তিনি বলেন, স্বামী ক্যানসারের রোগী, এতবার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়া এবং বারবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছাড়া কিছুই না৷
ছবি: Mortuza Rashed
স্বাস্থ্যকর্মীদের তৎপরতা
১০ বছরের বেশি সময় ধরে ইসমত জাহান খুকি এবং কাওসার জান্নাত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি) এর চকরিয়া শাখায় মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেন৷ তারা জানান, গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ব্যাপারে গ্রামের নারীদের প্রতিনিয়ত সচেতন করে আসছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed
মাটিতে লবণের ভাব
ফাইলাপাড়া, মানিকপাড়াসহ চকরিয়া উপজেলার অন্যান্য গ্রামগুলোর বিভিন্ন শুকনো জায়গাতেও সাদা প্রলেপ দেখতে পাওয়া যায়৷ এ সম্পর্কে জানতে চাইলে একজন গ্রামবাসী বলেন, এগুলো লবণের ভাব৷ কোথাও পানি উঠলে তা নেমে যাওয়ার পর এরকম সাদা হয়ে থাকে৷
ছবি: Mortuza Rashed
গ্রাম ছাড়ার উপায় নাই
চকরিয়ার মানিকপাড়া গ্রামের ২২ বছর বয়সী মায়মুনা জান্নাতের এ পর্যন্ত গর্ভের সন্তান মারা গেছে দুইবার৷ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি জানার পর তিনি বলেন, এই এলাকায় তাদের বসত ভিটা৷ এটি ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়ার মতো বিত্তবান তারা নন৷ যত সমস্যাই থাকুক, এখানেই তাদের থাকতে হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed
গবেষকের বক্তব্য
আইসিডিডিআর’বি এর বিজ্ঞানী ড. মানজুর হানিফি এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত৷ তিনি বলেন, সাধারণত একজন সুস্থ মানুষ দিনে ৫ গ্রাম লবণ খেলেও এখানকার মানুষেরা খায় ১৬ গ্রাম৷ সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা থেকে যারা ২০ কিলোমিটার দূরে থাকেন, তাদের চেয়ে এখানে গর্ভের বাচ্চা মারা যাওয়ার হার দেড় গুণ বেশি যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷ দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা খুলনা, সুন্দরবনেও এর ব্যতিক্রম হবার সম্ভাবনা নেই৷
ছবি: Private
আগের মতো জমিতে ফসল হয় না
৪০ বছর বয়সী উম্মে হাবিবার গর্ভের বাচ্চা নষ্ট হয় দুই বছর আগে৷ মাটি এবং পানিতে অতিরিক্ত লবণের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ২৫-৩০ বছর আগেও এখানকার জমিগুলো অনেক উর্বর ছিল৷ কিন্তু এখন আর তেমন কোন ফসল না ফলায় অনেকেই কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়েছেন৷ সামগ্রিক বিষয়ে তিনি সরকারের সুদৃষ্টি আশা করেন৷
ছবি: Mortuza Rashed
‘‘আল্লাহ্র ইশারা’’
চকরিয়ার মানিকপাড়া গ্রামের সানোয়ারা বেগমের দুইটি সন্তানের মধ্যে শেষ সন্তানটি গর্ভে মারা যায় ১১ বছর আগে৷ তিনি বলেন, “অনেকেরই তো শুনি বাচ্চা পেটে মারা যাইতেসে, কিন্তু এর পিছে যে এই কারণ সেটা তো আন্দাজ করতে পারি নাই৷ আমরা ভাবসি, আল্লাহ্র হুকুম হইসে, বাচ্চা পেটেই মারা যাইতেসে৷’’
ছবি: Mortuza Rashed
শুনতে হয় কটু কথা
মানিকপাড়া গ্রামের রোমানা বেগমের প্রথম সন্তানটিই গর্ভে থাকাকালীন মারা যায় তিন বছর আগে৷ আল্ট্রসনোগ্রাম করার মাধ্যমে তিনি বিষয়টি চিকিৎসকের কাছে জানতে পারেন৷ প্রথম সন্তানটি গর্ভে মারা যাওয়ায় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছে কটু কথা শুনতে হয় বলে তিনি জানান৷
ছবি: Mortuza Rashed
লবণকেন্দ্রিক জীবিকা
চকরিয়ার নিকটবর্তী একাধিক গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, এখানকার পুরুষদের অধিকাংশই লবণের ব্যবসার সাথে জড়িত৷ শুকনো মৌসুমে তারা লবণ সংগ্রহ ও বিক্রি করে রাখেন৷ প্রতি মণ অপরিশোধিত লবণ বিক্রি হয় ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে৷ যারা লবণের ব্যবসা করেন না, তাঁরা শহরে গিয়ে অন্য কিছু করেন৷
ছবি: Mortuza Rashed
12 ছবি1 | 12
করোনাকালে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের অর্থনীতিই ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বেশির ভাগ দেশের জিডিপিতে ব্যাপক পতন লক্ষ্য করা গেছে এই সময়ে৷