গত সপ্তাহ থেকে হোম অফিস, তারপর থেকে বাড়িতেই আছি৷ বলা যায় স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারান্টিন৷ তবে আশেপাশের অবস্থা নিজ চোখে দেখার আগ্রহ থাকায়, কিছুক্ষণের জন্য বের হতে হলো৷ জার্মানদের আতঙ্কিত চেহারা দেখে আবারো আমি হোম কোয়ারান্টিনে৷
বিজ্ঞাপন
বহু বছর বিদেশে থাকার কারণেই কিনা জানি না, সারাটা শীতকাল অপেক্ষা করে থাকি বসন্তের ঝলমলে রোদ, সদ্য গজানো গাছের কচি সবুজ পাতা আর রঙিন ফুলের সুবাস উপভোগ করার জন্য, আর সেইসাথে চলতে থাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর নানা প্ল্যান৷ হ্যাঁ, এবারো বসন্ত এসেছে এবং গত বছরের বসন্তের চেয়েও সুন্দর আবহাওয়া নিয়ে৷ তবে এবার কিন্তু সে একা আসেনি, মিষ্টি রোদের পাশাপাশি সাথে নিয়ে এসেছে করোনার কঠিন জীবাণুও৷
এই ভয়াবহ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা জার্মানিতে এখন প্রায় ২৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে আর মৃতের সংখ্যাও কম নয়, ১০০ এর কাছাকাছি৷ নর্থরাইন ওয়েস্টফেলিয়া জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য, যেখানে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় সবচেয়ে বেশি আর এ রাজ্যেই আমার বাস৷ কাজেই ভয় তো কিছুটা আছেই৷
এক নাগাড়ে কদিন বাসায় থাকায় মন খানিকটা বিক্ষিপ্ত, তাকে শান্ত করতেই রাইন নদীর পাড়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠলাম, বাসা থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের পথ৷ সেখানে লোকজন কম থাকবে, ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু তাই বলে মাত্র তিন চার জন!
অথচ শীত-গ্রীষ্ম সারা বছরই সেখানে ছোট-বড় নবীন-প্রবীণের ভিড় থাকে৷ দূর থেকে অনেকেই গাড়ি করে এসে নদীর ধারে হাঁটেন৷ মাঝেমধ্যে তো সেখানে গাড়ি পার্কিং এর জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যায় না৷
করোনা আতঙ্কে অতি পরিচিত রাইনকেও এবার কেমন যেন নিস্তেজ আর অসহায় বলে মনে হচ্ছিলো৷ আমরা হাঁটতে প্রচণ্ড ভালোবাসি কিন্তু মাথায় সার্বক্ষণিক করোনা নিয়ে কি আর হেঁটে মজা পাওয়া যায়?
করোনা আতঙ্ক: কীভাবে কোয়ারান্টিন উপভোগ করবেন
করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে৷ ছোঁয়াচে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে আক্রান্তদের ‘আইসোলেশনে’, রাখা হচ্ছে৷ সন্দেহভাজনদেরও ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টিনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে৷ বুদ্ধি খাটালে কোয়ারান্টিনও হতে পারে উপভোগ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/SvenSimon
বই পড়ে
চরম ব্যস্ত এ পৃথিবীতে সারা বিশ্বেই বই পড়ুয়াদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ কোয়ারান্টিনের সময়ে বই হয়ে উঠতে পারে আপনার প্রিয় সঙ্গী৷ এত দিন ‘পড়ব, পড়ব’ করেও সময়ের কারণে যে বইগুলো পড়ে উঠতে পারছিলেন না, সেগুলো নিয়ে বসে যেতে পারেন৷
কোয়ারান্টিনে থাকার সময় আপনি নতুন নতুন রেসিপিতে রান্নার চেষ্টা করতে পারেন৷ এমন সব খাবার রান্না করতে পারেন যা খেলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে৷
ছবি: Miguel Medina/AFP/Getty Images
শরীরচর্চা
দৈনন্দিন কাজের চাপে অনেকেই শরীরচর্চার সময় পান না৷ কোয়ারান্টিনে থাকার সময় আপনি অনায়াসেই শরীরচর্চা করতে পারেন৷ তবে বাইরের কোনো জিমে যেতে পারবেন না৷ ঘরে ব্যায়ামের যন্ত্র না থাকলেও চিন্তা নেই৷ করতে পারেন ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা যোগব্যায়াম৷ এটা একইসঙ্গে আপনার শরীরকে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সক্ষম করে তুলবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.-D. Gabbert
ঘরদোর পরিষ্কার করা
কোয়ারান্টিনে থাকার সময় আপনি বাড়িঘর ঝকঝকে তকতকে করে মনের মতো সাজিয়ে নিতে পারেন৷
করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বেই মেলা, কনসার্ট, সম্মেলনসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ হয়ে গেছে৷ খেলা হচ্ছে দর্শকহীন মাঠে৷ এ নিয়ে মন খারাপ না করে আপনি সহজেই অনলাইনে নানা সরাসরি অনুষ্ঠানের দর্শক হতে পারেন৷
ছবি: DW/R. Akbar Putra
দেখতে পারেন টেলিভিশন
এখন কত নাটক, সিনেমা, টিভি সিরিজ বা ওয়েব সিরিজ হচ্ছে৷ টেলিভিশনে সেগুলো দেখে নিতে পারেন৷
১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে থাকলে আপনার হাতে তখন অফুরন্ত সময়৷ এই সময়ে নানা ধরনের বোর্ড গেম খেলে মস্তিষ্ক ঝালিয়ে নিতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Stache
আয়করের হিসাব-নিকাশ
হাস্যকর শোনালেও এই সময়ে ঠান্ডা মাথায় বসে আপনি নিজের আয়করের হিসাবনিকাশ করে ফেলতে পারেন৷ তবে খুব বেশি চাপের হয়ে গেলে হাল ছেড়ে দেওয়াই ভালো৷
ছবি: Colourbox
দক্ষতা বাড়াতে নতুন কিছু শেখা
কোয়ারান্টিনে থাকার দিনগুলোতে অনলাইন থেকে আপনি নতুন কিছু শিখতে পারেন৷ শিখতে পারেন নতুন কোনো ভাষা৷ অনলাইনে সহজেই এটা করা যায়, কোথাও কোথাও বিনামূল্যেই পাবেন৷ তাই কোয়ারেন্টাইনে সময় কিভাবে কাটাবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই৷
ছবি: Colourbox
স্মৃতি রোমন্থন
কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন, দারুণ সময় কাটিয়েছেন৷ তুলেছেন অসংখ্য ছবি৷ কোয়ারান্টিনের সময় খুলে বসতে পারেন সেসব ছবির অ্যালবাম৷ মনে মনে চলে যেতে পারেন সেই সময়ে৷ কিংবা বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কাটানো আনন্দের স্মৃতি রোমন্থন করেও কাটিয়ে দিতে পারেন বন্দি থাকার সময়টা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Schickert
10 ছবি1 | 10
একটু দূরেই তো সুপার মার্কেট, মন টানলো সেদিকে৷ উদ্দেশ্য ক্রেতা-বিক্রেতাদের দেখা৷ এক সপ্তাহ বাইরে বের হইনি, তাই নিজ চোখে বর্তমান অবস্থা দেখা, মানুষের ভাব খানিকটা বোঝা৷ যাই হোক, হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ওয়ানটাইম ইউজের গ্লাভস দুটো হাতে পড়ে নিয়ে ঢুকে পড়লাম দোকানে৷ যদিও বাসায় দরকারি সবই আছে, আর বাঙালি বাড়িতে চাল, ডাল, নুন, তেল থাকবারই তো কথা! তাছাড়া জার্মান চ্যান্সেলার ম্যার্কেল বেশ জোর দিয়েই বলেছেন অতিরিক্ত খাবার কিনে বাড়িতে মজুদ করার দরকার নেই৷ বাজারে প্রয়োজনীয় সবকিছুই যথেষ্টই থাকবে৷
হ্যাঁ, আমিও তেমনটাই দেখলাম৷ দোকানের প্রতিটি তাক ভর্তি, কোনো কিছুরই কমতি নেই৷ যদিও বন বা অন্যান্য শহরের দোকানের চেহারা কিছুটা ভিন্ন বলে শুনেছি৷ দোকানের ভেতরে ক্রেতার সংখ্যাও হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন৷
আমি দেরি না করে ঝটপট হাতে তুলে নিলাম ভিটামিন সি, এ, সমৃদ্ধ কিছু তাজা ফল৷ করোনার প্রতিষেধক যখন বের হয়নি, করোনাকে প্রতিরোধ করতে তো শরীরে চাই যথেষ্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি৷ যাই হোক সামান্য সদাইটুকু নিয়ে ক্যাশের লাইনে দুই মিটার দূরত্বে দাড়িয়ে গেলাম৷ সবার মাঝে দূরত্বটা ঠিক থাকছে কিনা সেদিকে ক্যাশের মেয়েটি একটু পরপরই নজর রাখছে৷ লাইনে দাড়ানো ক্রেতাদের চেহারায় কেমন এক থমথমে ভাব৷ জার্মানরা এমনিতেই তেমন হাসিখুশি নয়, আর এখন তো চোখেমুখে কেবলই বিরক্তি, যেন একেকজনের ভেতরে চলছে এক ধরনের স্নায়ু যুদ্ধ৷
গ্রোসারি শপ থেকে বেরিয়ে পাশেই ফার্মেসির সামনে বিশাল এক সাইন বোর্ড দেখে থমকে দাড়ালাম৷ যাতে স্পষ্ট করে লেখা, দুজনের বেশি ভেতরে ঢুকবেন না, দূরত্ব রেখে চলুন৷ আর হ্যাঁ, কারো গায়ে জ্বর থাকলে বাসায় চলে যান৷ সেখান থেকে আমাদের ফোন করুন অথবা জ্বর নেই এমন কাউকে আমাদের এখানে পাঠান৷
সাইন বোর্ডের ছবিটি তুলে ফার্মেসির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার চোখ আটকে গেলো পাশেই মেয়েদের চুলকাটা বা সেলুনের গ্লাসের জানালায়৷ ঠিক দেখছি তো ? হ্যাঁ, সেলুনের ভেতরে তিন সুন্দরী তরুণী খদ্দের, তাদের মধ্যে দুজনের চুল কাটা হচ্ছে আর একজনের সোনালি চুল স্ট্রেট করছে আরেক সোনালী চুলওয়ালী একেবারে গা ঘেঁষে বসে৷ এই দৃশ্য দেখে আমি বিষ্মিত না হয়ে পারিনি৷ সুপার মার্কেট আর ফার্মেসির দৃশ্যের সাথে সেলুনের দৃশ্য ঠিক মেলাতে পারছিলাম না৷ কে জানে, করোনা হয়তো সুন্দরীদের কাছে যেতে ভয় পায়!
তবে আমার কাছে কিন্তু সেলুনের এই ব্যতিক্রম দৃশ্যটি ছাড়া মনে হচ্ছে, করোনা নিয়ে সাধারণ জার্মানরা বেশ সচেতন এবং বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব সহকারেই নিচ্ছে৷ সে কারণেই হয়তো তাদের চোখে মুখে করোনার ছাপ বেশ স্পষ্ট৷
ফেরার পথে ব্যাগভর্তি বাজার নিয়ে দুজন বৃদ্ধাকে হাঁটতে দেখে বেশ মায়া লাগলো৷ আহারে, এদের বুঝি সাহায্য করার কেউ নেই৷ তবে কোলনের দক্ষিণে, আমাদের পাড়ার চেহারা কিন্তু এদিক দিয়ে অনেকটাই ভিন্ন৷ কয়েকদিন আগেই লেটার বক্সে একটি খোলা চিঠি পেয়েছি৷ যাতে বেশ বড় বড় করে লেখা, যাদের বাড়িতে কুকুর আছে কিন্তু করোনা সংক্রমণের ভয়ে বাইরে যেতে পারছেন না, তাদের সাহায্য করতে আগ্রহী ১৩, ১৪ বছর বয়সী দুটি মেয়ে৷ অনেক জার্মানই বাড়িতে কুকুর পোষেন এবং বলাই বাহুল্য প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দিনে কয়েকবার কুকুরকে নিয়ে বাইরে যেতে হয় তাদের৷ কুকুরকে বাইরে নেওয়ার কাজটি এই মেয়ে দুটি করতে চায়, তাছাড়াও টুকটাক বাজার কিংবা ওষুধ কেনায়ও ওরা সাহায্য করতে আগ্রহী বলে লিখেছে খোলা চিঠিতে৷
আমাদের প্রতিবেশী প্রবীণদের ছেলেমেয়েরা অনেকেই মা-বাবার জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে দিয়ে যাচ্ছে৷ বাড়ির বাইরে এখন প্রতিবেশীদের বলতে গেলে দেখাই যাচ্ছে না৷ প্রবীণদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, বিশেষজ্ঞরা তো এমনটাই বলছেন৷ তবে প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের কাছাকাছি এই মুহূর্তে দেখা না হলেও টেলিফোন আর হোয়াট্স অ্যাপে কুশলাদি বিনিময় হচ্ছে৷
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের গতি কমাতে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জনগণের প্রতি যেমন কিছু নিয়ম মেনে চলার অনুরোধ করেছেন, তেমনি তিনি পাড়া প্রতিবেশী, যাদের সাহায্যের প্রয়োজন তাদের প্রতি সহমর্মিতার হাতও বাড়িয়ে দিতে বলেছেন৷
সত্যিই জার্মানিতে অনেক বছর কেটে গেলো কিন্তু এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হইনি৷ জানিনা আর কতদিন এমন উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হবে, দেখতে হবে পরিচিত-অপরিচিতদের গুরুগম্ভীর আতঙ্কিত মুখ৷ কতদিন চলবে অস্ত্রবিহীন এই যুদ্ধ? যদিও জার্মানিতে করোনা ভাইরাস আসার প্রায় প্রথমদিকেই রবার্ট কখ ইনস্টিটিউট জানিয়ে দিয়েছে, ভাইরাসে প্রায় দুই বছরের মতো ভোগান্তির আশঙ্কার কথা৷
হোম কোয়ারান্টিনের খুঁটিনাটি
সব দেশেই হাসপাতালে কোয়ারান্টিনের পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে নিজের বাসায়ও কোয়ারান্টিনে থাকার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে৷ কিভাবে থাকতে হয় হোম কোয়ারান্টিনে? চলুন জেনে নেই এর খুঁটিনাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
কোয়ারান্টিন কী?
১৪শ শতকে ইউরোপে মহামারি আকার নিয়েছিল প্লেগ, যা ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত৷ প্রায় ২০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল মহামারিতে৷ ভেনিস কর্তৃপক্ষ নিয়ম জারি করে, বন্দরে কোনো জাহাজ ভিড়লে যাত্রীদের নামানোর আগে সমুদ্রে ৪০ দিন নোঙর করে রাখতে হবে। ৪০ সংখ্যাকে ইটালিয়ান ভাষায় বলা হয় কোয়ারানতা, আর অপেক্ষার সময়টিকে কোয়ারানতিনো৷ তখন থেকে সংক্রামক রোগের আশঙ্কায় কাউকে আলাদা করে রাখাকে কোয়ারান্টিন বলা হয়৷
ছবি: London Museum of Archeology
আইসোলেশন কী?
কোয়ারান্টিন আর আইসোলেশনের তফাত কী? কোয়ারান্টিন সাধারণত হাসপাতালের বাইরে নির্দিষ্ট স্থানে অথবা নিজ বাসাতেও হতে পারে৷ তবে আইসোলেশন সাধারণত সরাসরি চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হাসপাতালেই করা হয়, যাদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া যায়নি, তাদের রাখা হয় কোয়ারান্টিনে, উপসর্গ৷ তেমন প্রকট না হলে তাকেও কোয়ারান্টিনে রাখা হয়৷ কিন্তু কারো মধ্যে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করলে, তখন তাকে রাখা হয় আইসোলেশনে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Photoshot
হোম কোয়ারান্টিন কেন?
সংক্রামক ভাইরাসে আক্রান্ত বা শরীরে ভাইরাস থাকতে পারে এমন সন্দেহ হওয়া ব্যক্তিদের সুস্থ মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে রাখা প্রয়োজন৷ যাদের মধ্যে অস্বাভাবিক জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট বা অন্য লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তাদের হাসপাতালে বিশেষ কোয়ারান্টিন বা আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে৷ সংক্রামক ভাইরাসে আক্রান্ত এত বেশি মানুষকে একসঙ্গে হাসপাতালে রাখা সম্ভব নয়৷ এ কারণে অনেককে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে হোম কোয়ারান্টিনে থাকার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Hoppe
হোম কোয়ারান্টিন কী?
‘হোম’ মানে বাসা, কোয়ারান্টিন মানে পৃথক করা৷ সংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসায় রোগীকে সবার আগে আলাদা করে ফেলা হয়, যাতে রোগ অন্যদের শরীরে না ছড়ায়৷ রোগীকে যেখানে রাখা হয়, সেখানে নেয়া হয় বিশেষ ব্য়বস্থা৷ এই ব্যবস্থাকেই বলে কোয়ারান্টিন৷ করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিজের বাসায় নিজের তত্ত্বাবধানেই কোয়ারান্টিনে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা৷ এটিকেই বলা হচ্ছে হোম কোয়ারান্টিন৷
ছবি: Getty Images/D. Ramos
কী করতে হবে?
হোম কোয়ারেন্টাইনে আপনাকে পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়ে আলাদা থাকতে হবে৷ সবচেয়ে ভালো হয় আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা ঘরে রাখতে পারলে৷ সে ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ আলাদা ঘর সম্ভব না হলে রাখতে হবে আলাদা শোয়ার ব্যবস্থা৷ আক্রান্ত ব্যক্তির অন্তত এক মিটারের মধ্যে অন্য কারো শোয়ার ব্যবস্থা রাখা যাবে না৷ রোগীকে নিয়মিত মেডিক্যাল মাস্ক পরতে হবে এবং সে মাস্ক নিয়মিত পালটাতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS/R. Fouladi
যা যা করবেন না
কোয়ারেন্টাইনে থাকা মানে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা৷ আক্রান্ত ব্যক্তি বাসার বাইরে যেতে পারবেন না, কারো সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না৷ নিজের ব্যবহার্য দ্রব্য ছাড়া অন্য জিনিসপত্র ব্যবহার না করাই ভালো৷ নিজের জন্য নির্ধারিত স্থান ছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যবহার করা স্থান, যেমন রান্নাঘর এমনকি বৈঠকখানাতেও যাওয়া উচিত হবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Duff
যা যা আলাদা করবেন
রোগীর ঘর বা বিছানা তো আলাদা থাকবেই, পাশাপাশি রোগীর ব্যবহার করা টুথব্রাশ, থালা-বাসন, তোয়ালে, গামছা, কাপড়চোপড়, বিছানার চাদর, বালিশ, সবই রাখতে হবে অন্যদের থেকে দূরে৷ বাড়িতে কোনো পোষা প্রাণী থাকলে তাকেও আক্রান্তের সঙ্গে মিশতে দেয়া যাবে না৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Baba Ahmed
নবজাতকের মা কী করবেন?
মা আক্রান্ত হলে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে কোনো বাধা নেই৷ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বুকের দুধ থেকে শিশু আক্রান্ত হওয়ার কোনো প্রমাণ তারা এখনও পাননি৷ তবে শিশুকে স্পর্শ করার আগে মাকে ভালো করে হাত ধুয়ে নিতে হবে৷ মুখে মেডিক্যাল মাস্ক পরে নিতে হবে৷ অন্য সময় শিশু থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Ramirez
বাড়ির অন্য সদস্যরা?
সেবার জন্য নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি থাকলে ভালো হয়৷ একেক দিন একেক জন রোগীর সেবা করলে বাড়ির সবাই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ বাড়ির বয়স্ক সদস্যদের আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে যত দূরে রাখা সম্ভব ভালো৷ সেবাদানকারী সেবা দেয়ার সময় মেডিক্যাল মাস্ক ভালো করে পরে নেবেন৷ ব্যবহার করার সময় মাস্কে আর হাত দেয়া যাবে না৷ রোগীর ঘর থেকে বের হয়েই সে মাস্ক ঢাকনা দেয়া ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে, হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/Xinhua/G. Markowicz
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
ঘর নিয়মিত ব্লিচিং সলিউশন দিয়ে মুছতে হবে৷ তার ব্যবহার করা চেয়ার টেবিল বা অন্য যেকোনো কিছু নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে৷ রোগী যে টয়লেট ব্যবহার করবেন, সেটি যদি অন্য কেউ ব্যবহার করেন তাহলে সাবধানে থাকতে হবে৷ রোগী টয়লেট ব্যবহার করার পর প্রতিবার ভালো করে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে৷ রোগীর কাপড় ৬০ থেকে ৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার পানিতে ডিটারজেন্ট দিয়ে নিয়মিত ধুয়ে দিতে হবে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/C. Ena
দর্শণার্থীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
কেউ অসুস্থ হলে তার খোঁজ নিতে বা সুস্বাস্থ্য কামনা করতে ফলমূল-উপহার নিয়ে আমরা হাজির হই রোগীর বাড়িতে৷ কিন্তু করোনা ভাইরাসের মতো মারাত্মক সংক্রমণে কারো সঙ্গে দেখা করতে না যাওয়াই ভালো৷ এতে করে কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে ভাইরাস নিয়ে আপনি নিজেই তা ছড়িয়ে দিতে পারেন আপনার অন্য প্রিয়জনের শরীরে৷ বরং আক্রান্তের সঙ্গে দেখা না করলেই তাকে সবচেয়ে নিরাপদে রাখতে পারেন আপনি৷
ছবি: Reuters/J. Redmond
ডাক্তারের কাছে যাবেন না
অনেকেই আতঙ্কে বা না জেনে নিজেই চলে যাচ্ছেন চিকিৎসকের কাছে৷ কিন্তু এর ফলে আপনার শরীর থেকে যেমন ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে, আপনি সুস্থ থাকলে অন্যের শরীর থেকে আপনার শরীরেও ভাইরাস চলে আসার ঝুঁকি থাকে৷ আগে স্থানীয় চিকিৎসক বা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে ফোনে যোগাযোগ করুন৷ কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় জ্বর, কাশি, সর্দি, শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ বেশি মাত্রায় অনুভব করলে রোগতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের হটলাইনে যোগাযোগ করুন৷
ছবি: Imago Images/A. Hettrich
কতদিন কোয়ারান্টিন?
সাধারণত চিকিৎসকেরা ১৪ দিন পর্যন্ত বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলবেন৷ এর মধ্যে নানা পরীক্ষার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণে রাখবেন তারা৷ তবে ব্যক্তিবিশেষে এই কোয়ারেন্টাইন কম-বেশিও হতে পারে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস কেমন প্রভাব ফেলবে তা আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে৷ ফলে কেউ ৩-৪ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আবার কারো ১৪ দিনের বেশি সময় লাগলেও শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/I. Wagner
করোনায় করণীয়
আমরা সবাই সচেতন থাকলে, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেই ঠেকানো যাবে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব৷ তাই গুজবে বিশ্বাস না করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করুন৷ ভাইরাসের লক্ষণ শরীরে দেখা দিয়েছে মনে করলে আগেই সরাসরি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে হটলাইনে কল করুন৷ রোগতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করুন৷