মহামারি মোকাবিলা করতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সে খরচ তুলতে কোটিপতিদের ওপর এককালীন কর আরোপের পরিকল্পনা করছে আর্জেন্টিনা সরকার৷ ধনীরা এতে আপত্তি জানালেও অনেকেই বলছেন এভাবেই বৈষম্য দূর করা সম্ভব৷
বিজ্ঞাপন
করোনার কারণে লকডাউন ও অর্থনৈতিক সংকট চলছে প্রায় এক বছর ধরে৷ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আর্জেন্টিনার সরকারও হিমশিম খাচ্ছে পরিস্থিতি সামলাতে৷ এমন পরিস্থিতিতে দেশটির পার্লামেন্টের দুই কক্ষই ধনীদের ওপর এককালীন কর আরোপের পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছে৷
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী যেসব নাগরিকের ব্যক্তিগত সম্পদের আর্থিক মূল্য অন্তত বিশ কোটি পেসো (বাংলাদেশি মুদ্রাতেও প্রায় ২০ কোটি টাকা) এমন ১১ হাজার ৮৬৫ জন আর্জেন্টাইনকে চিহ্নিত করা হয়েছে৷
আপোর্তে সলিদারিও ই এক্সত্রাওর্দিনারিও বা অসাধারণ সংহতি সহায়তা নামের একটি তহবিল গড়ে তোলা হয়েছে৷ আর্জেন্টিনার মধ্যে ২০ কোটি থেকে ২৯ কোটি পেসোর সম্পদ থাকলে এর শতকরা দুই ভাগ, ৩০ কোটির ওপরে সম্পদের জন্য সম্পদের তিন দশমিক পাঁচ ভাগ অর্থ এই তহবিলে দিয়ে দিতে হবে৷ অন্যদিকে বিদেশে সম্পদ থাকলে সেটির তিন থেকে পাঁচ দশমিক দুই পাঁচ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে৷
করোনার ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং দরিদ্রআর্জেন্টাইনদের অবস্থা আরো করুণ হয়েছে৷ তাদেরসহায়তার জন্যই গড়ে তোলা হচ্ছে এই তহবিল৷
সিনেটের বাজেট কমিটির প্রেসিডেন্ট কার্লোস কাসেরিও বলেন, "জনসংখ্যার কেবল শুন্য দশমিক শুন্য দুই শতাংশ মানুষ এই অবদান রাখবে৷ কেউ বিভ্রান্ত হবেন না, আমরা ধনীদের বিরুদ্ধে কোনো আলাদা ব্যবস্থা নিচ্ছি না৷” সরকার করোনার মধ্যে ধনী ও গরীবের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই এই তহবিল গঠন করছে বলেও জানান তিনি৷
করোনায় দেউলিয়া যারা
করোনা মহামারির ধাক্কায় বিপর্যস্ত বিশ্ব বাণিজ্য৷ নিরবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট কোম্পানিগুলো৷ এমনকি অনেক বড় প্রতিষ্ঠানও নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করছে৷
ছবি: DW/I. Banos-Ruiz
কারা টিকে থাকছে?
অনেক জায়গাতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দুয়ার এখনও বন্ধ৷ এমন পরিস্থিতিতে কত প্রতিষ্ঠানে চিরতরে হারিয়ে যাবে আর কতগুলো শেষ পর্যন্ত ফিরবে তা অনিশ্চিত৷ এই মুহূর্তে দেউলিয়া ঘোষণা করার আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছে না অনেকেই৷ বলা হচ্ছে বিশ্ব এখনও এই সংকট পরিস্থিতির মাঝামাঝিতে অবস্থান করছে৷ পুরো পরিস্থিতি অনুধাবন আর আসল ধাক্কাটি সম্ভবত টের পাওয়া যাবে আগামী বছরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Gateau
ছোটরা বেশি বিপদে
করোনার কারণে সবচেয়ে বড় লোকসান পড়েছে খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলো৷ যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাশন পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জে ক্রু নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে৷ হংকং এবং জার্মান ভিত্তিক ফ্যাশন পণ্য বিক্রেতা এসপ্রি বলেছে, এশিয়া থেকে সব স্টোর তারা গুটিয়ে নিবে৷ অনলাইন বেচাকেনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় কোভিড-১৯ এর ধাক্কা লাগার আগে থেকেই অবশ্য এই কোম্পানিগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছিল৷ মহামারি তা আরো ত্বরান্বিত করছে মাত্র৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/L. Ying
নড়বড়ে বড়রাও
দেউলিয়া আইনে সুরক্ষা পেতে আবেদন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্যান মার্কাসের মতো বৃহৎ ডিপার্টমেন্ট স্টোর৷ মে মাসেই ‘চাপটার ইলেভেন ফাইল’ করেছে জেসি পেনি৷ ১১৮ বছর বয়সী প্রতিষ্ঠানটির স্টোর আছে ৮০০ টি৷ বিশেষজ্ঞদের ধারণা এই তালিকায় এমন নামীদামি কোম্পানির নাম সামনের দিনে যোগ হবে আরো৷ এমনকি জার্মানির সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর গ্যালারিয়া কার্স্টার্ড কাউফহফ এর মত প্রতিষ্ঠানও সেই পথে হাঁটছে বলে গুঞ্জন রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে কে বাঁচাবে?
যুক্তরাজ্যে এক জরিপে দেখা গেছে চলতি বছর প্রতি দশটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের একটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ তাদের সেবার চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে অথচ তহবিল আগের চেয়ে কমে গেছে৷ আর এক্ষেত্রে সামাজিক সহযোগিতা কিংবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে যারা কাজ করে তারাই পড়ছে সবচেয়ে বিপাকে৷ এমনকি ন্যাশনাল ট্রাস্ট এর মত খ্যাতনামা গ্রুপও এই ধাক্কা অনুভব করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Güttler
রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধ্বস
বিভিন্ন জায়গায় রেস্টুরেন্টগুলো তাদের চেয়ার গুটাতে শুরু করেছে৷ বলা হচ্ছে শেষ পর্যন্ত এই ব্যবসায় শুধু দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক চেইনগুলোই হয়তো টিকে থাকবে৷ তবে কিছু বড় চেইনও নড়বড়ে অবস্থানে রয়েছে৷ যেমন ভাপিয়ানোর মত জনপ্রিয় চেইনটি জার্মানিতে দেউলিয়া আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷ মারিদো নামের আরেকটি কোম্পানি তাদের তৃতীয় রেস্টুরেন্ট বন্ধ করেছে৷
ছবি: picture-alliance/SvenSimon/F. Hoermann
পর্যটনে বেঁচে থাকার লড়াই
অ্যামেরিকার গাড়ি ভাড়া দেয়া প্রতিষ্ঠান হার্তজ৷ গতমাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বিদায় নিয়েছেন৷ দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছে তারা৷ উত্তর অ্যামেরিকাজুড়ে ছাঁটাই করেছে ১০ হাজার কর্মী৷ পর্যটন খাতে জড়িত বাকিরাও স্বস্তিতে নেই৷ জার্মানির বিমান প্রতিষ্ঠান লুফটহানসা সরকারের কাছ থেকে ৯০০ কোটি ইউরোর সহায়তা তহবিল নিয়েছে৷ ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া কোন রকমে টিকে আছে ‘ভল্যানটারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ অধীনে৷
ছবি: Imago/R. Peters
পেট্রোলিয়ামের কদর নেই
চাহিদা কমে যাওয়া বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে ঠেকেছে৷ এর সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোর এখন ত্রাহি পরিস্থিতি৷ এপ্রিলে ডায়মন্ড অফশোর ড্রিলিং, হোয়াইটিং পেট্রোলিয়াম, আল্ট্রা পেট্রোলিয়াম ফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের কাছে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন জানিয়েছে৷ তবে তারা যে একেবারে বিদায় নিচ্ছে তা নয়৷ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটলেই এই প্রতিষ্ঠাগুলো ব্যবসায় ফিরবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷
ছবি: Imago-Images/ITAR-TASS
মাঠে যখন দর্শক নেই
দর্শকের বদলে খেলোয়াড়রা, শিল্পীরা নিজেদের নৈপুণ্য দেখাচ্ছেন ক্যামেরার সামনে৷ তাতে কি ক্ষতি পোষাবে? এর সঙ্গে জড়িত ক্লাব, কর্তৃপক্ষ আর বিভিন্ন কোম্পানি বঞ্চিত হচ্ছে টিকিট আর বিজ্ঞাপনের টাকা থেকে৷ জার্মানির পেশাদার ফুটবল দল কাইজার্সলাউটার্ন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই তালিকা সামনের দিনে ক্রমশ লম্বা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Anspach
আসল পরিস্থিতি সামনে
বিরাট অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে উন্নত দেশগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ কিন্তু আসল পরিস্থিতি ধরা দিবে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে৷ কেননা ততদিনে অনেকেরই প্রণোদনার টাকা ফুরাতে শুরু করবে৷ কোম্পনিগুলো দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আদালতপাড়ায় লাইন ধরবে, বাড়বে কর্মহীন মানুষের বহরও৷ এমন আভাসই দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা৷
ছবি: Reuters/D. Ryder
দেউলিয়া হলে কি সব শেষ?
দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কারো কাছে গর্বের, কারো কাছে লজ্জার৷ অনেক ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কোম্পানি বা ব্যক্তি নতুন প্রস্তুতি নিয়ে আরো শক্তিশালী রূপে ফিরে আসতে পারে৷ হেনরি ফোর্ড তার কোম্পানি শুরুর আগে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন৷ ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় জিএম, ক্রাইসলারের মত কোম্পানিও দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছিল৷ করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতেও এমন কিছু খারাপ খবর আসবে যা হয়তো পরবর্তীতে ভাল কিছুর জন্ম দিবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Inderlied
10 ছবি1 | 10
তবে স্বভাবতই এর তীব্র বিরোধিতাও রয়েছে৷ বিরোধী দল র্যাডিকেল সিভিক ইউনিয়ন- ইউসিআরের সিনেটর এক টুইটে বলেছেন, "আমরা এমনিতেই রেকর্ড পরিমাণ কর নেয়া একটি দেশে বাস করি৷ তারপরও আমাদের রেকর্ড পরিমাণ দারিদ্র্য৷ নতুন কর আরোপ না করে কিভাবে ব্যবস্থাপনা ভালো করা যায়, সেটা শিখতে পারি না আমরা?”
একই ধরনের মন্তব্য দেশটির অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ সেসার লিটভিনেরও৷ এক ইমেইলে তিনি বলেন, ‘‘করোনা মোকাবিলায় আমাদের আরো অনেক টাকা দরকার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু আমার ধারণা ধনীদের ওপর এই কর আরোপের মাধ্যমে যা হবে বলে আশা করা হচ্ছে, বাস্তবে হবে তার উলটো৷''
জার্মানিতে সর্বোচ্চ আয়কর ৪৫ শতাংশ, সে তুলনায় আর্জেন্টিনায় সর্বোচ্চ আয়কর ৩৫ শতাংশ৷ কিন্তু আয়কর ছাড়াও দেশটিতে জাতীয়, প্রাদেশিক ও পৌর পর্যায়ে আরো নানা ধরনের কর দিতে হয় নাগরিকদের৷
লিটভিন মনে করেন বিশাল করের বোঝা টানতে টানতে দেশটির জনগণ এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন৷