অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে করোনা টিকাদান শুরু হয়েছে৷ বিভিন্ন দেশে থাকা অনেক বাঙালিও এরই মধ্যে টিকা নিয়েছেন৷ তাদেরই কয়েকজনের কথা নিয়ে এই লেখা৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের অনেক দেশের মত জার্মনিতে করোনার টিকাদান শুরু হয়েছে গত ডিসেম্বরের একেবারে শেষ দিকে৷ এদেশে প্রথম টিকা নিয়েছেন ১০১ বছর বয়সী একজন নারী৷ অনেক দেশের মত জার্মানিতেও ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াব টিকা দেওয়া প্রথম শুরু হয়েছে বয়স যাদের ৮০ ওপরে তাদের৷
তবে অ্যামেরিকায় করোনার প্রকোপের হার যেসব রাজ্যে বেশি সেখানে ৫০, ৫৫ বছর বয়সিদেরও করোনা ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে৷ তাদেরই একজন ডালাসের বাসিন্দা নিশাত নাজনীন চকোরী৷ তিন চারদিন আগে ভ্যাকসিন নেয়ার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি ৷ চকোরীর মা ৭৫ বয়সি হাসিনা বেগম টিকা নিয়েছেন তিন চার সপ্তাহ আগেই৷ ওনার এমনিতে একটু ঠান্ডা লাগার ভাব থাকলেও টিকা নেওয়ার পরে তিনি তেমন কিছু ফিল করেন নি৷
এদিকে লন্ডনে ডাক্তারি করেন ইফ্ফাত আযিম পিয়াল, তিনি দুটো ভ্যাকসিনই নিয়েছেন৷ তার ডাক্তার স্বামীও নিয়েছেন দুটোই৷ কর্মরত ডাক্তার বলে টিকা নিতে হয়েছে তাদের৷ তিনি বললেন বাঙালি ডাক্তার বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মী যারা টিকা নিয়েছেন তারা সবাই খুব ভাল আছেন এবং তাদের কারো শরীরেই কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি৷
অবশ্য ৫৫ বছর বয়সি ডাক্তার পিয়াল অন্যরকম একটি খবর জানালেন, লন্ডনে বয়স্কদের কেউ কেউ টিকা দিতে রাজি না হওয়ায় সে মহামূল্যবান টিকাগুলোকে নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে সেখানকার আগ্রহী বাঙালি শিক্ষার্থীদের শরীরে পুশ করা হয়েছে৷
করোনা ভ্যাকসিনের যত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
বিশ্বের অনেক দেশে শুরু হয়েছে করোনার টিকাদান৷ তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী সেটি নিয়ে এখনও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে৷ ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
সাধারণ প্রতিক্রিয়া
যেকোন টিকারই সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে৷ যেমন, শরীরে ইনজেকশন দেয়ার স্থানটি লাল হয় বা ফুলে যায়৷ তিনদিনের মধ্যে অবসাদ, জ্বর, মাথা ব্যাথা, শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ব্যাথা হতে পারে৷ তবে এর কোনটিই দীর্ঘস্থায়ী নয়৷ শরীরে টিকার কার্যকারিতা শুরু হলে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়ায় এমন প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক৷ অনুমোদন পাওয়া করোনা ভ্যাকসিনগুলোর ক্ষেত্রেও এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে৷
ছবি: Mark Lenninhan/AFP/Getty Images
গুরুতর প্রতিক্রিয়া
বিরল হলেও কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা থাকে৷ যেমন, যুক্তরাজ্যে টিকা কর্মসূচি চালুর পর ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুইজনের অ্যালার্জি দেখা দেয়৷ দেশটির কর্তৃপক্ষ এ ধরনের সমস্যা যাদের আছে তাদেরকে সতর্ক করেছে৷ তবে সার্বিকভাবে নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণেই করোনার বিভিন্ন টিকার অনুমোদন দিয়েছে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি, যুক্তরাজ্যের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Robin Utrecht/picture alliance
টিকার উপাদান
সাধারণত টিকায় দুর্বল বা মৃত ভাইরাস থাকে৷ যার মাধ্যমে শরীর সেই ভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে৷ তবে করোনার টিকাগুলোর মধ্যে কয়েকটি প্রথমবারের মতো এমআরএনএ প্রযুক্তিতে তৈরি৷ এতে কোন ভাইরাস থাকে না৷ তার বদলে কোভিড-১৯ এর জীবাণুর ব্লুপ্রিন্ট বা প্রতিরূপ থাকে৷ তাই দুই ধরনের টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দুই রকম হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/J. Cairns
বায়োনটেক-ফাইজার
অনুমোদন পর্যায়ে বায়োনটেক-ফাইজার উদ্ভাবিত টিকার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি৷ কোন কোন ক্ষেত্রে টিকা গ্রহীতা সাময়িক অবসাদ আর মাথা ব্যাথায় ভুগেছেন৷ এমআরএনএ ভ্যাকসিনটির ব্যবহার শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে একজন ও ব্রিটিনে দুইজনের ত্বক লাল হওয়া এবং শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল৷ যাদের অ্যালার্জি সমস্যা রয়েছে তাদেরকে সতর্ক করেছে বিট্রিশ মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি৷
ছবি: Jacob King/REUTERS
মডার্না
বায়োনটেক-ফাইজারের মতোই এমআরএনএ ভিত্তিক মডার্নার টিকাটি৷ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই টিকাগ্রহীতাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি৷ হালকা যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে সেগুলো ছিল সাময়িক৷ তবে ১০ শতাংশ অবসাদে ভুগেছেন বলে জানিয়েছে একটি স্বাধীন পর্যবেক্ষক প্যানেল৷ অল্প কয়েকজন রোগী অ্যালার্জি ও মুখের স্নায়ু নিষ্ক্রিয় হওয়ার মতো জটিলতায় ভুগেছেন৷ তবে কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি৷
ছবি: Dado Ruvic/Reuters
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকা
অক্সফোর্ড-আস্ট্রাজেনেকার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে একজন মেরুদণ্ডের প্রদাহে ভুগেছেন৷ সেপ্টেম্বরে এই ঘটনার পর কিছুদিন ট্রায়াল বন্ধ ছিল৷ কিন্তু পরে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরীক্ষার পর জানিয়েছে সেটির কারণ ভ্যাকসিন নয়৷ এছাড়া টিকাটি নেয়ার পর ইনজেকশনের স্থানে ও পেশিতে ব্যথা, মাথাব্যাথা ও অবসাদগ্রস্ততার মতো সাধারণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে৷ তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে তা তুলনামূলক কম ছিল৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/J. Porzycki
স্পুটনিক ফাইভ
তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল শুরুর আগে গত আগস্টেই নিজেদের টিকা স্পুটনিক ফাইভ এর অনুমোদন দেয় রাশিয়া৷ দুই ধরনের পরিবর্তিত অ্যাডেনোভাইরাস ব্যবহার করা হয়েছে এতে৷ রুশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জ্বর, মাথাব্যাথার মতো টিকাটির কিছু সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে৷ তবে কোন গুরুতর প্রতিক্রিয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি৷ তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য প্রকাশ না করার অভিযোগ রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে৷
ছবি: Sergei Karpukhin/TASS/dpa/picture alliance
দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া
এখন পর্যন্ত যত তথ্য জানা গেছে সেগুলোর কোনটিই আসলে পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরছে না৷ দীর্ঘ মেয়াদে টিকাগুলোর ব্যবহার মানবদেহে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে তা অজানা৷ সেটি হয়ত সামনের মাস বা বছরগুলোতেই পরিস্কার হবে৷
ছবি: Borja Abargues/NurPhoto/Getty Images
8 ছবি1 | 8
টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা মাইনাস ১১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় রাখতে হয়৷ সেভাবে রাখা হলেও নাকি ভ্যাকসিন পাঁচদিনের মতো কার্যকর থাকে৷
কাজেই বর্তমান পরিস্থিতিতে মহামূল্যবান ভ্যাকসিন নষ্ট করা কি ঠিক? আমি বলব প্রবীণদের ফিরিয়ে দেওয়া টিকা যে কয়েকজন শিক্ষার্থী পেয়েছে তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান৷ আসলে কিছুদিন আগে কেউ একজন আমাকে একটি ছোট্ট মজার ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছিল, তাতে অল্প বয়সি এক ছেলের ভ্যাকসিন পেতে নাকি প্রায় সাড়ে তিন বছর সময় লেগে যাবে! একারণে অবশ্যই ওই শিক্ষার্থীরা মহাভাগ্যবান!
ফিরে যাই আবার অ্যামেরিকায়, ডালাসের বাসিন্দা ৬৭ বয়সি জাহেদ হোসেন৷ টিকা নেওয়ার তিন দিন পরে তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন৷ সাথে জ্বর, ডায়রিয়া এবং বমি৷ তবে টিকার সাথে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা যায়নি৷
অ্যামেরিকায় টিকা নেওয়ার পরে করোনায় আক্রান্ত হওয়া জাহেদ হোসেনের মতো একটি ঘটনা লন্ডনেও ঘটেছে বলে জানান, ডাক্তার পিয়ালও৷ লন্ডনে তারই পরিচিত একজন বাঙালি ভ্যাকসিন নেওয়ার ঠিক ১০ দিন পরই কোভিডে আক্রান্ত হন৷ ডাক্তাদের মতে, করোনার জীবাণু তার শরীরে আগে থেকেই ছিলো বলেই নাকি পরে তা বেরিয়ে এসেছে ৷
এদিকে বন শহরের বাসিন্দা বন্যা ফেরদৌস তার টিকা নেওয়ার ছবি শেয়ার করেছেন ফেসবুকে৷ জার্মানিতেডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া ৮০ এর বেশি বয়সিদের টিকা দেওয়া হচ্ছে, বন্যা অবশ্যই এর ব্যতিক্রম৷ একটি নার্সিং হোমে কাজ করার সুবাদেই টিকা নেওয়ার সুযোগটি তিনি পেয়েছেন৷ আমার জানা মতে আশির ওপরে বয়স এমন বাঙালি এখনও জার্মানিতে তেমন নেই বললেই চলে৷ আমার পরিচিত দক্ষিণ জার্মানির এরলাঙ্গেন শহরের সিমেন্স কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত ইন্জিনিয়ার ৮৫ বছর বয়সি আবদুল ওয়াহেদ টিকা নেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন৷ অনেকের মতো তাঁর নাম ওয়েটিং লিস্টে রয়েছে, যে কোনো সময় ডাক আসতে পারে বলে তিনি জানালেন টেলিফোনে৷
তবে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে বাঙালিদের মধ্যে যতটা উচ্ছ্বাস আর আগ্রহ দেখা যায় এদেশিদের মধ্যে কিন্তু তেমনটা লক্ষ্য করিনা বরং এর উল্টোটাই মনে হয়৷