1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নমুনা সংগ্রহকারীরা ছুটি পান শুধু আক্রান্ত হলে

৯ জুন ২০২০

করোনাকালে ফ্রন্ট লাইনে কাজ করছেন মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা৷ তাদের এক অংশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্দেহজনক করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করছেন৷ কিন্তু তারাই আছেন ঝুঁকির মধ্যে৷ মুখোমখি হচ্ছেন নানা নেতিবাচক অভিজ্ঞতার৷ আক্রান্তও হচ্ছেন৷

ছবি: bdnews24

একজন আকলিমা আক্তার ৷ ফেব্রুয়ারি থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ করছেন ঢাকা শহরে৷ কাজ করেন আইইডিসিআরের পক্ষ হয়ে৷ কিন্তু এখন তিনি যেখানে সাবলেট থাকেন তারা জানেন না তিনি কী করেন৷ তাকে এই পেশার পরিচয় গোপন রাখতে হলো কেন?

তিনি জানালেন, ‘‘এক দুই মাস আগে আমি আমার আগের বাসাটি ছাড়তে বাধ্য হই৷ কারণ বাড়িওয়ালা যখন জানলেন আমি করোনার নমুনা সংগ্রহ করি তখন তিনি আর বাসায় থাকতে দিতে রাজি হলেন না৷ অনেক অনুরোধ করার পরও না৷ শেষ পর্যন্ত বাসাটি ছাড়তে বাধ্য হই৷ এখন যেখানে থাকি তারা জানেন না আমি কি কাজ করি৷ তবে আমি সব ধরনের স্বাস্থ্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিই যাতে আমার কারণে কারুর ক্ষতি না হয়৷’’

মোস্তফা কামাল কাজ শুরু করেন মার্চে৷ স্ত্রী এবং সাড়ে চার বছরের এক পুত্র সন্তান নিয়ে তার সংসার৷ তিনি শুরু থেকেই একটি রুমে বিচ্ছিন্ন থেকে এই কাজ শুরু করেন৷ কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি তিনি নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন৷ এখন আবার সুস্থ হয়ে কাজে ফিরে এসেছেন৷ করোনায় তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন৷ সুস্থ হওয়ার পরও নানা জটিলতায় ভুগছেন৷ শরীর দুর্বল৷ ঠাণ্ডাটা মনে হয় বসে গেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো এখনো জানি না এর দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব কি হতে পারে৷ শরীর এখনো দুর্বল৷ ঠাণ্ডাটা লেগেই আছে৷ হয়তো আবারো করোনায় আক্রান্ত হতে পারি৷’’

বাড়িওয়ালা যখন জানলেন আমি নমুনা সংগ্রহ করি তখন আর বাসায় থাকতে দিতে রাজি হলেন না: আকলিমা আক্তার

This browser does not support the audio element.

প্রথম প্রথম ভয় পেলেও এখন আর তিনি ভয় পান না৷ তার কথা, ‘‘কাজ যখন নিয়েছি, দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে৷ আমার বাচ্চাটাও এখন বুঝে গেছে৷ সে আমার কাছে আসে না৷ বলে, তোমার গায়ে পোকা৷ সে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে৷ ভিডিও কল দেয়৷ অডিও মেসেজ পাঠাতেও শিখে গেছে৷’’

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে মানুষের সন্দেহ৷ যখন নমুনা সংগ্রহের নামে ডাকাতির কথা ছড়িয়ে পড়লো তখন তারা বেশ বিপাকে পড়ে যান৷ অনেকেই সন্দেহ করেন ৷ বাড়ি ঢুকতে দিতে চান না৷ পরিচয় পত্র দেখিয়েও কাজ হয় না৷ অনেক জায়গা থেকে ফিরে আসতে হয়৷ ‘‘মাইনুল ইসলাম আমাদের এক সহকর্মীকে তো ডাকাত সন্দেহে পুলিশে দেয়ার উপক্রম হয়েছিলো৷ শুধু মাইনুল নয় আরো অনেকেই এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখো মুখি হয়েছেন,’’ জানালেন আরেকজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রশীদ আহমেদ৷

আর যাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয় তারাও অনেক সময় বিপদে পড়েন৷ কারণ তখন বাড়িওয়ালা বা আশাপাশের লোকজন জানতে পারেন তিনি করোনা রোগী (যদিও তখনো টেস্ট রেজাল্ট হয় না)৷ কাউকে কাউকে এরপর বাড়িওয়ালা বাসা থেকে বের করে দেন বা বের করে দিতে চান৷ তখন তারা আবার এই টেকনোলজিস্টদেরই ফোন করেন৷ কিন্তু তাদের কিছু করার থাকেনা৷ আকলিমা বলেন, ‘‘একবার এক নারী আমরা স্যাম্পেল নিয়ে আসার পর আমাদের ফোন করে কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ তাকে তার বাড়িওয়ালা বাড়ি থেকে বের করে দেয়৷ কিন্তু আমরা তাকে কোনো সহায়তা করতে পারিনি৷ এটা আমাদের কষ্ট দেয়৷’’

কাজ যখন নিয়েছি, দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে: মোস্তফা কামাল

This browser does not support the audio element.

রশীদ আহমেদ বলেন, ‘‘আমরা যখন পিপিই পরে যাই তখন এলাকার লোকজন আমোদের চিনে ফেলেন৷ মনে হয় যেন আমরা চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণি৷ আমাদের নানা প্রশ্ন করেন৷ জানতে চান কার বাসায় এসেছি৷ কেন এসেছি৷ এমন পরিস্থিতি কখনো কখনো হয় যে আমাদের স্যাম্পল না নিয়েই চলে আসতে হয়৷ ‘‘বাড়িওয়ালাদের ভয়ে বা এলাকাবাসীর ভয়ে অনেকে আমাদের ফোনও রিসিভ করেন না৷ কেউ কেউ অনুরোধ করেন বাইরে রাস্তায় কোথাও যেন স্যাম্পল কালেকশন করি৷ কিন্তু সেটাতো আমাদের নীতিমালার মধ্যে পড়ে না৷ এটা করাও সম্ভব নয়৷ তবুও আমরা যতদূর সম্ভব পরিচয় স্থানীয় লোকদের কাছে গোপন করে স্যাম্পল সংগ্রহের চেষ্টা করি৷’’

রশীদ আহমেদ আগে ভাড়া বাসায় থাকতেন৷ স্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই৷ তারপরও ভাড়া বাসায় পরিস্থিতি অনুকুল না হওয়ায় তারা সাত আটজন মিলে আইইডিসিআরে থাকেন৷ সেখানে সব কিছু নিজেদেরই করতে হয়৷

রাকিব হাসান সরাসরি স্যাম্পল কালেকশন করেন না৷ তিনি টেস্টের সাথে জড়িত৷ তিনি জানান, ‘‘যে এলাকায় আমি থাকি সেই এলাকার লোকজন আগে আমাকে ভয়ের চোখে দেখতেন৷ তবে এখন পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে৷ কেউ কেউ সহযোগিতা চান৷ জানতে চান পরিস্থিতি কি৷’’ তিনি এখন একা থাকেন৷ কিন্তু বাড়িতে বাবা-মা তাকে নিয়ে চিন্তা করেন৷ চাকরি ছেড়ে দিতেও বলেছেন কয়েকবার৷ কিন্তু রাকিবের কথা, ‘‘কাউকে না কাকে তো এই কাজ করতেই হবে৷’’

রাকিব জানান, ‘‘প্রথম যখন কোরোনা টেস্ট শুরু হয় তখন পিসিআর ল্যাবে আমি একা ছিলাম৷ এরপর আরো ১০-১২ জন যোগ দেন৷ তাদের মধ্যে কয়েকজন ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলেও গেছেন৷ কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন৷’’

যারা নমুনা সংগ্রহ করেন তারা কেউই তাদের পিপিই এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নন৷ আর বেতনও তেমন নয়৷ এই কাজে নামার আগে তাদের অবশ্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে৷ প্রথম দিকে তাদের নিজস্ব উদ্যোগেই বাড়ি বাড়ি যেতে হতো৷ এখন অবশ্য অফিস থেকে গাড়ি দেয়া হয়৷ তার দুইজন করে একেকটি দলে থাকেন৷ তারা করোনা টেস্টের জন্য নাক ও মুখ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন৷ আর এন্ডিবডি টেস্টের জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন৷ 

আকলিমা আক্তার বলেন, ‘‘আমাদের প্রথম দিকে খুবই নিম্নমানের পিপিই দেয়া হতো৷ এখনো এন-৯৫ মাস্ক সবাইকে দেয়া হয় না৷’’ রশীদ আহমেদ বলেন, ‘‘আমাদের সহকর্মীরা যারা কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হন তাদের অনেকটা নিজেদের উদ্যোগেই চিকিৎসা নিতে হয়৷ আমরা যে ঝুঁকি নিই তার জন্য আলাদা কোনো ঝুঁকি বা চিকিৎসা ভাতা পাই না৷ আর বেতন গড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ অন্য কোনো সুবিধা বা ভাতা নাই৷’’

তবুও তারা মনে করেন মানুষের জন্য কাজ করছেন, এটাই তাদের বড় পাওয়া৷ আকলিমা আক্তার বলেন, ‘‘দিন দিন রোগী বাড়ছে৷ মানুষ মারা যাচ্ছেন৷ গ্রামের বাড়িতে আমার মা আমাকে নিয়ে চিন্তা করেন৷ আমার বাবা এক বছর আগে মারা গেছেন৷ তিনি চাইতেন আমি মানুষের জন্য কাজ করি৷ বাবার সেই চাওয়াই আমাকে সাহস দেয়৷’’

তারা সরাসরি কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে গিয়ে কাজ করেন৷ এই করোনায় তাদের জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ আর মানুষের মধ্যেও ভয়৷ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে ভয় আগের চেয়ে কমছে৷ কারণ অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন৷ আমার ভালো লাগে যখন দেখি যে আমার শিশু সন্তানও এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে৷ সেও জানে বাবার কাছে যাওয়া যাবে না৷ তবে যারা আক্রান্ত নন তাদের মানসিকতার খুব একটা পরিবর্তন আসেনি৷ তাদের কেউ কেউ নানা ধরনের প্রতিকূলতার সৃষ্টি করেন৷’’

এই মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা একেকজন প্রতিদিন গড়ে ২০-২৫টি স্যাম্পল কালেকশন করেন৷ তারা অনেক সময় সাপ্তাহিক ছুটিও পান না৷ আর টানা কাজ করলেও তারা চিকিৎসকদের মতো আইসোলেশন সুবিধা পান না৷ তাদের আলাদা থাকার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাও নাই৷ আর পরিবারের সাথে আলাদা সময় কাটানোর জন্য ছুটি তো দূরের কথা৷ কেবল মাত্র আক্রান্ত হলেই ছুটি মেলে!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ