প্রণোদনা প্যাকেজে শুধু তৈরি পোশাক খাতই ভালো অবস্থানে আছে৷ অন্যান্য খাতের ঋণ বিতরণ শুরু হলেও এ পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে৷ বিশেষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিও স্থগিত আছে বলে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
সরকার এ পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে এক লাখ কোটি টাকারও বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে৷ তার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা, শিল্প খাতে ৩০ হাজার কোটি, ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার কোটি, কৃষি খাতে পাঁচ হাজার কোটি, রপ্তানি উন্নয়ন খাতে ১২ হাজার ৫০০ কোটি উল্লেখযোগ্য৷
পোশাক খাতে প্রণোদনা ঋণ দেয়া হয় শতকরা চার ভাগ হারের সুদে৷ অন্যান্য খাতে শতকরা ৯ ভাগ সুদ হলেও তার অর্ধেক সরকার ব্যাংকগুলোকে ভর্তুকি দেয়ার কথা বলছে৷
পোশাক খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পর আরো দুই হাজার ৫০০ কেটি টাকা প্রণোদনা ঋণ দেয়া হয়েছে৷ এই ঋণ পোশাক শ্রমিকদের বেতন হিসেবেই দেয়া হয়৷ বিজিএমই’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, পোশাক শিল্পে পুরো সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ঋণই বিতরণ করা হয়েছে৷ কিন্তু পোশাক খাত আরো ঋণ চাচ্ছে৷ তাদের যুক্তি হলো, সরকার যে ঋণ দিয়েছে তা বেতন-ভাতায় শেষ হয়ে গেছে৷ সামনে আরো তিন মাস বেতন-ভাতা দিতে ঋণ প্রয়োজন৷ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘পোশাক খাতে প্রতি মাসেই বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা৷ ঋণের সঙ্গে আমরাও ৪০ ভাগ দিচ্ছি৷ তাই আরো ঋণ না পেলে আমাদের পক্ষে সামনের তিন মাস বেতন দেয়া কঠিন হবে৷’’
সিদ্দিকুর রহমান
কয়েকটি তফসিলি ব্যাংকের কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কৃষি প্রভৃতি খাতে ঋণ দেয়ার জন্য এরইমধ্যে ব্যাংকগুলোকে একটি গাইডলাইন পাঠিয়েছে৷ তাতে আসলে শর্তে বিশেষ কোনো ছাড় দেয়া হয়নি৷ শুধুমাত্র সুদের একটি অংশ ভর্তুকি হিসেবে সরকার দেবে৷ ওই কর্মকর্তারা জানান, এই ঋণ দেয়া হচ্ছে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে৷ অনেকেই আবেদন করছেন, কিন্তু শর্ত পূরণ করতে পারছেন না৷ সবচেয়ে সমস্যায় আছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মালিকরা৷ ফলে এখানে তেমন ঋণ বিতরণ হচ্ছে না৷ শিল্পখাতে এ পর্যন্ত মাত্র তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান সিপিডির অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান৷
তিনি বলেন,‘‘তৈরি পোশাক খাত তো প্রণোদনার ঋণ পেয়ে গেছে৷ কিন্তু অন্যান্য খাতের ঋণ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে৷ ব্যাংকগুলো নন-পারফর্মিং লোনে জর্জরিত৷ তাই তারা এই লোন দেয়ার ব্যাপারে খুবই সতর্ক৷ ফলে যথা সময়ে এই লোন পাওয়া যাচ্ছে না৷ করোনায় যে সহায়তার জন্য এই লোনের কথা বলা হয়েছে তা কতটা কাজে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ আর এই লোনের মাধ্যমে শুধু শিল্প প্রতিষ্ঠানই ঘুরে দাঁড়াবে তা নয়, এখানে কর্মসংস্থানেরও প্রশ্ন আছে৷’’
ব্যাংকগুলো তাদের চাহিদা অনুযায়ী ‘কোলেটারাল না পেলে ঋণ দিচ্ছে না৷ তাই এখন দাবি উঠেছে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টার হওয়ার৷ এসএমএমই এবং কৃষি খাতে মোট ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি৷ কারণ, তাদের সাথে ব্যাংকের যোগাযোগ তেমন নেই৷ ফলে ব্যাংক যে ধরনের কাগজপত্র চায়, তা তাদের কাছে নেই৷ আর ব্যাংকগুলোর আশঙ্কা, তাদের ‘মন্দ ঋণ’ বেড়ে যায় কিনা৷
মোস্তাফিজুর রহমান
খাদ্য সহায়তা
করোনার সময় সরকারের নেয়া বিশেষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচী এখন বন্ধ আছে৷ এখন চলছে প্রচলিত ভিজিএফ, ভিডিজিসহ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি৷ গত ঈদে সরকার ৫০ লাখ মানুষকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা এখনো শেষ হয়নি৷ অনিয়মের কারণে মোবাইল ফোন নাম্বার আপডেটের কাজ এখনো চলছে৷ কারণ, একাধিক ব্যক্তির নামে একই মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হয়েছিল৷ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানান,‘‘করোনায় যে বিশেষ খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল তা ১১ জুন থেকে বন্ধ আছে৷ এখন শুধু ভিজিএফ কর্মসূচি চালু আছে৷ সামনে ঈদ উপলক্ষে এক কোটি ৬ লাখ পরিবারকে ভিজিএফ-এর আওতায় খাদ্য সহায়তা দিয়েছি৷’’ এর বাইরে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এগুলো বাড়ানো হয়েছে৷ বিশেষ খাদ্য সহায়তার আওতায় ১১ জুনের আগ পর্যন্ত সাড়ে ছয় কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে প্রতিমন্ত্রী জানান৷ মোবাইল ফোন নাম্বার আপডেট হলে নগদ সহায়তা দেয়াও শুরু হবে৷
তবে এই বিশেষ খাদ্য কর্মসূচিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে৷ অনিয়মের অভিযোগে দেশের ভিভিন্ন এলাকায় ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্যরা গ্রেপ্তারও হয়েছেন৷
মে মাসের ছবিঘরটি দেখুন...
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব
এরইমধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে৷ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমেছে ব্যাপকভাবে৷ দেখা দিয়েছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব বাড়ার শঙ্কা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
রপ্তানি ধস
লকডাউনের কারণে ইউরোপ ও অ্যামেরিকায় ব্যবসা বাণিজ্য, মানুষের কেনাকাটা কার্যত বন্ধ৷ এসব দেশের ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো তাই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে, কয়েকশো কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল করেছে৷ এর প্রভাবে এপ্রিলে রপ্তানি আয় নেমে এসেছে মাত্র ৫২ কোটি ডলারে, যা আগের বছরে একই মাসের চেয়ে ৮২.৮৫% কম৷ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসেব বলছে চলতি বছর সারা বিশ্বেই আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ৩২% পর্যন্ত কমতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Yu Fangping
প্রবাসী আয়ে টান
এপ্রিলে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ ভাগ কমেছে৷ প্রবাসী আয়ের সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে৷ জ্বালানি তেলের দাম কমায় তাদের অর্থনীতি বিপর্যয়ে পড়েছে৷ সেইসব দেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা৷ এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছর বাংলাদেশের রেমিট্যান্স গত বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ কমে যাবে, বলছে বিশ্বব্যাংক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/R. Abd
চাকুরির অনিশ্চয়তা
দেশের ভিতরে যে লকডাউন পরিস্থিতি চলছে তার কারণেও বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও সেবাখাতগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ৷ এসব প্রতিষ্ঠানে যারা চাকুরি করছেন, যেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছেন তাদের কর্মসংস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকছে৷ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক চীনে করোনার প্রকোপ শুরুর পর বলেছিল, বাংলাদেশের প্রায় নয় লাখ মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে৷ তবে এখন তৈরি পোশাক খাতেই অনেক শ্রমিকের চাকুরি হারানোর শঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
খাদ্য নিরাপত্তা
গত বছরের মে থেকে চলতি বছরের এপ্রিল, এই সময়ে বাংলাদেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩.৫৩ লাখ মেট্রিক টন৷ নতুন বছরে তা ১০ লাখ মেট্রিক টন বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসডিএ৷ সরকারের খাদ্য গুদামে ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে৷ বোরো মৌসুমে আরো ২০ লাখ মেট্রিক টন ধান-চাল সংগ্রহ করবে সরকার৷ সেক্ষেত্রে খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার আশংকা তেমন নেই৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের হাতে খাদ্য কেনার টাকা থাকবে কিনা৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
দারিদ্র্য বাড়ছে
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সোয়া তিন কোটির বেশি৷ এর বাইরে গত দেড় যুগে আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন৷ উপার্জন না থাকলে দ্রুতই তারা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেন৷ ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক জরিপেও দেখা গেছে করোনার প্রভাবে দেশের নিম্নবিত্তের আয় ৭৫ ভাগ কমে গেছে, হতদরিদ্র বা যাদের দৈনিক আয় ১৬০ টাকার কম এমন মানুষের সংখ্যা ৬০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷
ছবি: DW/Harun Ur Rashid Swapan
সরকারের প্রণোদনা
অর্থনীতি বাঁচাতে বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের সরকারও আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যার আকার ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এর বড় একটি অংশ দেয়া হবে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প আর কৃষি খাতে ঋণ হিসেবে৷ পাশাপাশি লক-ডাউনের কারণে যারা কাজ হারিয়েছেন তাদের ব্যাংক হিসাব তৈরি করে এককালীন নগদ অর্থ প্রদানের কথা বলা হয়েছে৷ প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোরও৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
টাকার সন্ধান
বাজেটের ঘাটতি মেটাতে এরিমধ্যে ব্যাংক থেকে সারাবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করে ফেলেছে সরকার৷ নতুন ঋণ নেয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কাছ থেকে৷ বিভিন্ন খাতের ব্যয় কমিয়েও অর্থ সংস্থানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ সবশেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা ছাপিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেতে পারে৷ তবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে, এমন আশঙ্কায় টাকা ছাপানোর পক্ষে নন কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ৷
ছবি: DW
মন্দার শঙ্কা
বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে মহামন্দার আশংকা করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও৷ এরইমধ্যে চলতি বছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার পূর্বভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি৷ মন্দার ধাক্কা বাংলাদেশ কতটা সামলাতে পারবে তা বৈশ্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নির্ভর করছে সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপরে৷