চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান ও সিঙ্গাপুরের পর ইটালিতেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় আতঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাও বাড়ছে৷ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে চীনে যে সব কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তার ফলে কলকারখানা থেকে শুরু করে পুঁজিবাজার স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকেও বাধ্য হয়ে সেই পথেই অগ্রসর হতে হচ্ছে৷ ইটালির উত্তরে মিলান শহরকে ঘিরে প্রধান শিল্প-বাণিজ্য কেন্দ্রে অচলাবস্থা দেখা দেওয়ায় সে দেশের দুর্বল অর্থনীতির উন্নতির সম্ভাবনা বড় ধাক্কা খাচ্ছে৷ মোটকথা বিশাল পরিমাণ আমদানি-রপ্তানির উপর নির্ভরশীল বিশ্ব অর্থনীতির ছন্দ অনেকটাই বিঘ্নিত হয়েছে৷
এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পুঁজিবাজারে সোমবার ধস নেমেছে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানি, ইটালি ইত্যাদি কিছু দেশে সূচক আচমকা নেমে গেছে৷ বিনিয়োগকারীরা বর্তমান পরিস্থিতিতে মুনাফার আশা দেখছেন না৷ শিল্পক্ষেত্রে মন্দার পাশাপাশি বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে৷ ফলে জার্মানির বিমান সংস্থা লুফটহানসার মতো বিমান সংস্থার শেয়ারের মূল্য কমে গেছে৷ বোয়িং কোম্পানি আরও লোকসানের আশঙ্কা করছে৷ এমনকি পেট্রোলিয়ামের মূল্যের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে৷ গাড়ি বা স্মার্টফোনের মতো পণ্যের উৎপাদনের ক্ষেত্রে একাদিক দেশের মধ্যে যন্ত্রাংশের আদানপ্রদানের যে প্রণালী রয়েছে, সেই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বিঘ্ন দেখা যাচ্ছে৷
এর মধ্যে সোমবার চীন জানিয়েছে, যে গত দুই সপ্তাহ পর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এই প্রথম কমতে শুরু করেছে৷ সে দেশের এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পূর্ববাণী করে বলেছেন, সম্ভবত এপ্রিল মাসের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে৷ তবে এমন ইতিবাচক প্রত্যাশা নিয়ে চীনের মধ্যেই যথেষ্ট সংশয় রয়েছে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো মহামারির আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে না৷ এমনকি করোনা ভাইরাসের প্রসারকে সন্ত্রাসবাদের হুমকির সঙ্গে তুলনা করেছে ডাব্লিউএইচও৷ ভাইরাসের প্রসারের গতি বর্তমানে কিছুটা কমে গেলেও যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছে জাতিসংঘের এই সংস্থা৷ সব দেশ এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত কিনা, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছে ডাব্লিউএইচও৷ করোনা ভাইরাসের প্রসার রুখতে গবেষণা ও উদ্ভাবন সংক্রান্ত দুই দিনের আলোচনার পর এই সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে উদ্যোগ আরও জোরালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ তবে চটজলদি কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কারের আশা দেখা যাচ্ছে না৷
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নভেল করোনা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়৷ শুরুতে এর নাম দেয়া হয় ২০১৯-এনসিওভি, পরে কোভাড-১৯৷ বিশ্বজুড়ে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ চীনে এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন সহস্রাধিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/SOPA Images/A. Marzo২০১৯ সালের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে নতুন এক রোগের কথা জানায়৷ এক কোটিরও বেশি মানুষের উহান শহরে অনেকেই শ্বাসতন্ত্রের অজানা সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে৷ রোগের কারণ ও ধরন অজানা৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞরা তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন৷ শহরের সামুদ্রিক খাবারের বাজার দ্রুত বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ শুরুতে কেবল ৪০ জনের মতো আক্রান্তের খবর এসেছিল৷
ছবি: Imago Images/UPI Photo/S. Shaver২০০২ সালে চীন থেকেই ছড়িয়েছিল আরেক করোনা ভাইরাস- সার্স৷ সার্সে বিশ্বজুড়ে আট শতাধিক মানুষ মারা যান৷ শুরুতে এই ভাইরাসকে সার্স মনে করলেও পরে ৭ জানুয়ারি তারা ঘোষণা করেন, এটি মানুষের অজানা সম্পূর্ণ নতুন এক ভাইরাস৷ সার্স এবং সাধারণ ঠান্ডা-কাশির মতো এটিও করোনা ভাইরাস পরিবারেরই সদস্য৷ এর লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়া৷
ছবি: picture-alliance/BSIP/J. Cavallini১১ জানুয়ারি করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর খবর ঘোষণা করে চীন৷ উহানের সামুদ্রিক খাবারের দোকানে এক নিয়মিত ক্রেতা ছিলেন এই ৬১ বছর বয়সি ব্যক্তি৷ শেষের দিকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি৷
ছবি: Reuters/Strপরের কয়েক দিনেই থাইল্যান্ড ও জাপানে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়৷ এসব আক্রান্তও উহানের সেই বাজারে গিয়েছিলেন৷ উহানে দ্বিতীয় মৃত্যুর খবর আসে৷ জানুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হয়, ২০০ মানুষ আক্রান্ত হন ভাইরাসে৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoonনতুন ভাইরাস কিভাবে একজনের শরীর থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়াচ্ছে, তা বের করতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা৷ করোনা ভাইরাস জুনোটিক, অর্থাৎ, পশু থেকে মানুষে ছড়িয়েছে৷ কিছু করোনা ভাইরাস কাশি বা হাঁচির মাধ্যমেও ছড়াতে পারে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীন থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে পরীক্ষা শুরু হয়৷ জানুয়ারির ২০ তারিখে কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, নতুন এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/YONHAPNEWS AGENCYজানুয়ারির ২৩ তারিখে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুরো উহানকে কার্যত বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে চীন৷ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়৷ শ্রমিকরা দ্রুত হাসপাতাল তৈরি করা শুরু করেন৷ জানুয়ারির ২৪ তারিখের মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু হয়, আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮৩০ জনে৷ উহানের পাশাপাশি আরো ১২টি শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলে চীন৷ এর প্রভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সাড়ে তিন কোটি মানুষ৷
ছবি: AFP/STRচীনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং তাইওয়ানেও ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া যেতে থাকে৷ আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে৷ কিন্তু জানুয়ারির ২৩ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ‘এখনই’ জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারির সময় হয়নি৷
ছবি: Getty Images/X. Chuজানুয়ারির ২৪ তারিখ ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইউরোপে প্রথম করোনা ভাইরাসে একজন আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ করে৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অস্ট্রিয়ায় চার জন আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Mortagneজানুয়ারির ২৫ তারিখ চীনা নববর্ষ শুরু হয়৷ তবে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে বড় বড় সব অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ৷ জানুয়ারির শেষের দিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা শহরের সংখ্যা পৌঁছায় ১৭-তে, অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন পাঁচ কোটি মানুষ৷ মানুষের যাতায়াত কমাতে নববর্ষের ছুটি বাড়ানো হয় আরো তিন দিন৷
ছবি: Reuters/C. Garcia Rawlinsকম্বোডিয়ায় প্রথম ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ চীন সীমান্তে গাড়ি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে মঙ্গোলিয়া৷ রাশিয়া পূর্বাঞ্চলের তিনটি সীমান্ত বন্ধ করে দেয়৷ বিশ্বজুড়ে পর্যটন ব্যবসা ও তেলের দামে ধস নামে৷ বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩০০-তে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪১৷ গবেষকরা তিন মাসের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের আশা প্রকাশ করেন৷
ছবি: Reuters/C. G. Rawlins২৭ জানুয়ারি জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস উহান থেকে জার্মান নাগরিকদের ফেরত আনার ঘোষণা দেন৷ চিকিৎসকরা এর জন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানানো হয়৷ জার্মানির মারবুর্গে গবেষকরা এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert২৭ জানুয়ারিতেই জার্মানিতে প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ জার্মানি সফররত চীনা সহকর্মীদের কাছ থেকে বাভারিয়া অঞ্চলের ৩৩ বছর বয়সি এ নাগরিকএ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়৷ মিউনিখের হাসপাতালে তাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়৷ পরের দিনই তার আরো তিন সহকর্মীর আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়৷ চীনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩২-এ৷
ছবি: Reuters/A. Uyanik২৮ জানুয়ারি জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উহান থেকে নিজেদের নাগরিক সরিয়ে আনে৷ চার নাগরিককে জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেয়৷ ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় নতুন এ ভাইরাস, বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হন ৬০০০ মানুষ৷
ছবি: imago images/Kyodo Newsজানুয়ারির ৩০ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশেষে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে৷ তবে সংস্থার মহাসচিব তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস বাণিজ্য ও পর্যটন সীমিত না করতে দেশগুলোকে আহ্বান জানান৷
ছবি: picture-alliance/KEYSTONE/J.-C. Bottপয়লা ফেব্রুয়ারি ১০২ জন জার্মান নাগরিকসহ ১,১২৪ জনকে উহান থেকে বিমানবাহিনীর বিমানে ফ্রাঙ্কফুর্টে নিয়ে আসা হয়৷ গেরমেরশাইমে সেনা ব্যারেক তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তাদের মধ্যে অন্তত দুই জনের ভাইরাস সংক্রমণের খবর মিলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorstউহানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদেরও ফেরত নিয়ে আসা হয় ১ ফেব্রুয়ারি৷ বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ৩১২ জনকে আনা হয় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে৷ সেখান থেকে তাদের সরাসরি আশকোনার হাজি ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ১৪ দিন পরও তাদের কারো মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ মেলেনি৷
ছবি: A. Goni২ ফেব্রুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ফিলিপাইন্সে৷ তবে ৪৪ বছর বয়সি এ ব্যক্তিও চীনা নাগরিক৷ উহান থেকে ম্যানিলা যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি৷ নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হয় তার৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Aljibeনতুন করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় উহানে মাত্র ১০ দিনে নতুন হাসপাতাল তৈরি করে তাক লাগায় চীন৷ ৩ ফেব্রুয়ারি চালু হয় দ্য হোশেনশান হাসপাতাল৷ আক্রান্তদের সারিয়ে তুলতে পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি ঐতিহ্যগত চীনা ওষুধও ব্যবহারের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Imago/L. He৩ ফেব্রুয়ারি জাপান উপকূলে ইয়োকোহামায় প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেস-এ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখের মধ্যে প্রমোদতরীর ৪৫০ জন ভাইরাসে আক্রান্ত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/kyodo১৩ ফেব্রুয়ারি একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানায় চীন৷ অবশ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা সংক্রমণের তথ্য জানতে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে৷ আগে কেবল নিউক্লিইক অ্যাসিড পরীক্ষা করা হলেও এখন ফুসফুসের সিটি স্ক্যানও করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP এসবি/কেএম (ডিপিএ, রয়টার্স)