নিজেদের উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট শতভাগ কার্যকরী হবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী৷ উৎপাদনের পর কার্যকারিতা দেখে এর বাজারজাতের অনুমোদন নেয়া হবে বলে জানান তিনি৷
বিজ্ঞাপন
আক্রান্ত ব্যক্তির এক ফোঁটা রক্ত দিয়ে ১৫ মিনিটেই করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা যাবে৷ তাই গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত করোনা টেস্ট কিটের নাম রাখা হয়েছে ‘গণস্বাস্থ্য র্যাপিড ডট ব্লট'৷ এর দাম রাখা হবে ২০০ টাকা৷
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনি বাজারে নতুন এই কিট সরবরাহ করতে পারবেন৷ সেগুলো সাধারণ মানুষের সংগ্রহের সুযোগ থাকবে না৷ শুধু হাতপাতাল ও ক্লিনিকগুলোই কিনতে পারবে৷ প্রাথমিকভাবে এক লাখ কিট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা তাদের৷
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি বলেন, প্রচলিত পিসিআর পদ্ধতির কারণে পরীক্ষায় কমপক্ষে পাঁচ দিন লাগে যা, তুলনামূলক ব্যয় সাপেক্ষ৷ কিন্তু র্যাপিড কিটে সময় এবং অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে৷
এই কিটের উদ্ভাবক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান গবেষক ডা. বিজন কুমার শীল৷ ২০০৩ সালে তিনি সার্স ভাইরাস পরীক্ষার কিট উদ্ভাবন করেছিলেন বলে জানান জাফরুল্লাহ৷ তখন তিনি সিংগাপুরে গবেষণার কাজ করতেন৷
করোনা পরীক্ষার নতুন এই কিটের কার্যকারিতা হার কতভাগ এমন প্রশ্নের জবাবে, জাফরুল্লাহ বলেন সার্সের ক্ষেত্রে এটি শতভাগ ফলাফল দিয়েছে৷ করোনার ক্ষেত্রেও তা শতভাগ না হওয়ার কোনো কারণ নেই৷ ‘‘এখনও আমরা যে পরীক্ষা করেছি তার নমুনা সংখ্যা ছোট৷ তৈরি করার পর যখন আমরা এক হাজার স্যাম্পল করব তখন বলতে পারব এর ব্যর্থতার হার কতভাগ হতে পারে৷ তবে সেটা খুব কম হবে,’’ বলেন তিনি৷
করোনা ভাইরাস শনাক্ত হবে ১৫ মিনিটে
11:49
ওষুধ প্রশাসন এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, গণস্বাস্থ্যকে উৎপাদনের নয়, কাঁচামাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ এর জবাবে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘‘কাঁচামাল এনে কি আমি বসে বসে চেহারা দেখব? আমি কি পূজা করবো না ভারতে পাঠাবো? আমি উৎপাদন করব৷ তাদের বোঝার ভুল আছে৷ তবে বাজারজাত করতে আমার অনুমতি লাগবে৷ উৎপাদনের পর এর কার্যকারিতা দেখে তারপর সেই অনুমতি দেয়া হবে৷’’
এই কিটের কাঁচামাল আনা হচ্ছে যুক্তরাজ্য থেকে৷ শনিবার ছুটির দিনেও এনবিআর এলসির প্রয়োজনীয় কাজ করে দিয়েছে৷ বিশেষ ব্যবস্থায় বুধবারের মধ্যে কাঁচামাল বাংলাদেশে আসবে৷ জাফরুল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহের মধ্যে এটা উৎপাদন করে বাজারে দিতে পারবো৷’’
তার মতে করোনা শনাক্ত করা না গেলে এর প্রতিরোধ সম্ভব নয়৷ আর সেক্ষেত্রে দ্রুত এবং সহজে শনাক্তের জন্য তাদের কিটটি ভূমিকা রাখবে৷
করোনা নিয়ে এখন যা করা প্রয়োজন
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমানা আগেই বন্ধ করে দেয়া উচিত ছিলো৷ সেটি করা না হলেও যত দ্রুত সম্ভব এখন ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সিল করে দেয়া উচিত৷ আক্রান্ত ১৭০ টি দেশে ভারতীয় নাগরিক আছে৷ অন্যদিকে দেশটির সবচেয়ে বড় সীমান্তই বাংলাদেশের সঙ্গে৷
তার দৃষ্টিতে দেশের কারাগারগুলো করোনার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে৷ সেখানে যারা আছেন তাদের মধ্যে দাগি দণ্ডপ্রাপ্ত ও ফাঁসির আসামি ছাড়া আর সবাইকে প্যারোল বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে ছেড়ে দেয়া উচিত৷ আদালতে আইনজীবী, আসামি, বাদী-বিবাদীর উপস্থিতিও বন্ধ করার পক্ষে তিনি৷
এছাড়া মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডাসহ ধর্মীয় উপাসানালয় এখনই বন্ধ না করলেও সেখানে স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি৷
করোনা: গুজব ও বাস্তবতা
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া তথ্য, মিথ্যা সংবাদ৷ ডয়চে ভেলে চেষ্টা করছে বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে আপনাদের সঠিক তথ্য জানানোর৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xiao Yijiu
শিশুদের আশঙ্কা কি বেশি?
শিশুদের নিয়ে আলাদা করে কোনো আশঙ্কা নাই৷ যে কোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন৷ আক্রান্তদের পাঁচ জনের চারজনের ওপর এই ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের মতোই প্রভাব ফেলবে৷ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শিশু ও তরুণ বয়সিরা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে পারেন৷ মধ্যবয়সিরা এতে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত সেবা ও চিকিৎসায় তাদেরও সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
কী খেলে ঠেকানো যাবে করোনা?
কোনো কিছু খেয়েই করোনা ঠেকানো যাবে না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য সুষম খাবার এমনিতেই প্রয়োজন৷ অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে৷ কেউ রসুন খাওয়ার কথা বলছেন, কেউ ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক দ্রব্যের কথা বলছেন৷ রসুনে নানা উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য ভালো৷ রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে তা ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক শরীরে গেলে তা করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
ছবি: AFP/C. De Souza
গরম বা ঠান্ডা পানি পান করা উচিত?
নিয়মিত পানি পান করলে শরীরের জন্য ভালো৷ কিন্তু ১৫ মিনিট পর পর গরম পানি পান করলে ভাইরাস মারা যাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷ মুখে বা শরীরে একবার ভাইরাস প্রবেশ করলে কোনো খাবার বা পানীয় দিয়েই তা আটকানো যাবে না৷ শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো ওষুধে কাজ হবে?
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য কার্যকর, ভাইরাসের জন্য নয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুস্থ শরীরে ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে৷ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখনো নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি৷ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিগগিরই হয়তো আসবে সুখবর৷
ছবি: imago/Science Photo Library
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে?
এ বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ পরীক্ষাগারে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়৷ কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রা কোনো দেশেই থাকে না৷ অনেকে মনে করছেন গরম পানি দিয়ে স্নান করলে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সবসময় জরুরি৷ কিন্তু প্রচণ্ড গরম পানি দিয়ে স্নান করলেই তা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Lipinski
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কি করোনা ভাইরাস শনাক্ত সম্ভব?
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরে তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব, ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করা সম্ভব না৷ সেক্ষেত্রে কারো শরীরে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি বোঝা যাবে না৷ সাধারণত ভাইরাস শরীরে ঢোকার ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যেই তা টের পাওয়া যায়৷ তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিনের পরও ভাইরাস শরীরে কর্মক্ষম থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Mikheyev
টাকার মাধ্যমে কী করোনা ছড়ায়?
শরীরের বাইরে করোনা ভাইরাস কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে৷ ফলে আমদানি করা কোনো পণ্য বা চিঠির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷ ময়লা টাকা থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷ ফলে টাকা লেনদেনের পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত৷ যত বেশি সম্ভব হাত-মুখ-নাক-কানে হাত নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ছবি: DW
মশা বা অন্য পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে?
সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল এক ধরনের বেড়াল থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ালো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে অন্য কোনো মাধ্যম হয়ে মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়েছে৷ তবে মশা বা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে এটি আপনার মধ্যে ছড়াবে না৷ সতর্কতা হিসেবে মাছ-মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে রান্না করতে হবে৷ অর্ধেক সিদ্ধ মাছ-মাংস বা পোচ করা ডিম থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Rose
কিভাবে থাকবো নিরাপদ?
সবচেয়ে জরুরি হাত পরিষ্কার রাখা৷ সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ২০ সেকেন্ড পরিষ্কার করতে হবে৷ যদি সাবান না থাকে, ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷ হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলুন, হাত ধুয়ে নিন৷ অথবা হাতের কনুইয়ে মুখ ঢাকুন৷ হাতের তালুতে হাঁচি-কাশি দিলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে আক্রান্ত হতে পারেন অন্য়রা৷ হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানো ও কোলাকুলি থেকেও বিরত থাকুন৷
ছবি: AFP/N. Almeida
আমি কী মারা যাবো?
করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন, এমন আশঙ্কা একেবারেই কম৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন৷ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন৷ অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন৷ সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে জমিয়ে রাখবেন না৷ আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশেপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস৷ ফলে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন৷