ইটালি ফেরত ১৪২ জনকে আশককোনা হজ ক্যাম্পে না রেখে বাড়ি পাঠানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক ডা. মাহমুদুর রহমান মনে করেন তাদের বাড়ি পাঠাতে বাধ্য হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷
বিজ্ঞাপন
শনিবার ইটালি থিকে ফিরে আসা ১৪২ জনকে আশকোনো হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনের জন্য আনার পরও কেন বাড়িতে পাঠানো হল তা নিয়ে বিতর্ক চলছে সামাজিক মাধ্যমে৷ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে থাকাদের ওপর নজরদারি না থাকা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন৷ ডা. মাহমুদুর রহমান মনে করেন এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার সংকট রয়েছে৷ আশকোনো হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনের পরিবেশ ও প্রস্তুতি ছিলো না৷ এমনকি যাদের নেয়া হয়েছিলো তাদের পানি খাওয়ারও ব্যবস্থা ছিলো না৷ ফলে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন৷ শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের বাড়ি পাঠাতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷ তিনি আরো মনে করেন, ব্যবস্থাপনার এমন সংকট এবং প্রস্তুতিহীনতা পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে৷
তবে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, ওই ১৪২ জনকে প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে তাদের শারীরে করোনা আক্রান্ত হওয়ার কোনো উপসর্গ না পাওয়ায় বাড়ি পাঠানো হয়েছে৷ আগামী ১৪ দিন তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে৷ কারো করেনার উপসর্গ দেখা দিলেই তাদের যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে৷
ডা. এ এস এম আলমগীর
শনিবার ইটালি ফেরত ১৪২ জনকে বাড়ি পাঠানো হলেও পরে ইটালি এবং অন্যদেশ থেকে আসা আরো ২৭২ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে৷ ৪৮ জনকে রাখা হয়েছে গাজীপুরের একটি নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে, বাকিদের আশাকোনা হজ ক্যাম্পে৷ আইইডিসিআর জানিয়েছে, তাদেরও স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচেছ৷ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কোনো লক্ষণ পাওয়া না গেলে তাদেরকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দেয়া হবে৷
আইইডিসিআর-প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা আসলে পরীক্ষা নিরীক্ষা বলতে তাপমাত্রা পরীক্ষা করি৷ আর তাদের আগের কেস হিস্ট্রি দেখি৷ ওই ১৪২ জনের মধ্যে কোনো লক্ষণ পাইনি৷ আশকোনায় এখন যারা আছেন তাদেরও আমরা পরীক্ষা করে পর্যায়ক্রমে ছেড়ে দিচ্ছি৷ গাজীপুরে যারা আছেন তাদেরও পরীক্ষা হচ্ছে৷ যাদের কোনো লক্ষণ পাওয়া না যাবে তাদের ছেড়ে দিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হবে৷’’
আইইডিসিআর জানায় করোনায় আক্রান্ত পাঁচ জনের মধ্যে তিনজন সুস্থ হয়েছেন৷ দুইজন চিকিৎসা নিচ্ছেন৷ এছাড়া চারজন নিবিড় কোয়ারেন্টাইনে এবং ১০ জন আছেন আইসোলেশনে৷ সারাদেশে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন দুই হাজার হাজার ৩১৪ জন৷
ডা. মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘‘যাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে তারা আদৌ থাকেন কিনা সেটাই দেখার বিষয়৷ তারা যদি নিয়ম না মানেন তাহলেতো আর হলো না৷ এজন্য তাদের মনিটরিং-এর আওতায় রাখতে হবে৷ তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরিস্থিতি জানতে হবে৷ এজন্য স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিতে হবে৷ আর যারা কোয়ারেন্টাইনে আছেন তাদের বিষয়টি বোঝাতে হবে৷’’
প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘‘আসলে এখন ব্যাপক অব্যবস্থাপনা চলছে৷ ওই ১৪২ জনকে কোনোভাবেই বাড়িতে যেতে দেয়া ঠিক হয়নি৷ তাদের নিবিড় কোয়ারেন্টাইনেই রাখা উচিত ছিলো৷ আইন প্রয়োগে এখানে শিথিলতা দেখানো হয়েছে৷ এটা হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে৷’’
ডা. মাহমুদুর রহমান
তিনি বলেন, ‘‘৮ মার্চ যাদের করোনা রোগী হিসেবে প্রথম শনাক্ত করা হলো তারা কিন্তু নিজেরা রিপোর্ট করেছে৷ এর আগে আসলে কোয়ারেন্টাইন বিষয়টি আমলেই নেয়া হয়নি৷’’
তিনি জানান, ‘‘এখন যাদের সেল্ফ কোয়ারেন্টাইনে বাড়ি পাঠানো হয়েছে, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি তাদের ওপর নজরদারি নেই৷ এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীরাও তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে যান না ভয়ে৷’’
তবে ডা. এ এস এম আলমগীর বলছেন, ‘‘যাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে তাদের কার্ড দিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ তাদের সব ধরনের তথ্য রাখা হচ্ছে৷ যোগাযোগের নাম্বার দিয়ে তাদেরকে কী করতে হবে তাও বলে দেয়া হচ্ছে৷ আমরা হোম কোয়ান্টোইনে যাদের পাঠাই তাদের কাউন্সেলিং করি৷ আর সারাদেশে আমাদের যে স্বাস্থ্যকর্মীরা আছেন তাদের মাধ্যমে মনিটর করি৷’’
তবে এখনো বিদেশ থেকে আসা অনেকে কোনো ধরনের কোয়ারেন্টাইনেই যাননি৷ এদিকে আইইডিসিআর জানিয়েছে, শনিবার প্রতিষ্ঠানটির কাছে সরাসরি ৬৩ জন এসেছেন করোনা পরীক্ষা করাতে৷ ব্রিফিং-এ পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সরাসরি আইইডিসিআরে না আসার জন্য অনুরোধ করেছেন৷ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘বাড়ি থেকে আইইডিসিআরে আসার পথে তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়াতে পারে৷ তাই হটলাইনে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের টিম বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করবে৷ আইইডিসিআরে আনার প্রয়োজন হলে তারাই নিয়ে আসবে৷’’
করোনা: গুজব ও বাস্তবতা
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া তথ্য, মিথ্যা সংবাদ৷ ডয়চে ভেলে চেষ্টা করছে বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে আপনাদের সঠিক তথ্য জানানোর৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xiao Yijiu
শিশুদের আশঙ্কা কি বেশি?
শিশুদের নিয়ে আলাদা করে কোনো আশঙ্কা নাই৷ যে কোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন৷ আক্রান্তদের পাঁচ জনের চারজনের ওপর এই ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের মতোই প্রভাব ফেলবে৷ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শিশু ও তরুণ বয়সিরা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে পারেন৷ মধ্যবয়সিরা এতে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত সেবা ও চিকিৎসায় তাদেরও সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
কী খেলে ঠেকানো যাবে করোনা?
কোনো কিছু খেয়েই করোনা ঠেকানো যাবে না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য সুষম খাবার এমনিতেই প্রয়োজন৷ অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে৷ কেউ রসুন খাওয়ার কথা বলছেন, কেউ ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক দ্রব্যের কথা বলছেন৷ রসুনে নানা উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য ভালো৷ রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে তা ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক শরীরে গেলে তা করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
ছবি: AFP/C. De Souza
গরম বা ঠান্ডা পানি পান করা উচিত?
নিয়মিত পানি পান করলে শরীরের জন্য ভালো৷ কিন্তু ১৫ মিনিট পর পর গরম পানি পান করলে ভাইরাস মারা যাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷ মুখে বা শরীরে একবার ভাইরাস প্রবেশ করলে কোনো খাবার বা পানীয় দিয়েই তা আটকানো যাবে না৷ শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো ওষুধে কাজ হবে?
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য কার্যকর, ভাইরাসের জন্য নয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুস্থ শরীরে ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে৷ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখনো নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি৷ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিগগিরই হয়তো আসবে সুখবর৷
ছবি: imago/Science Photo Library
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে?
এ বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ পরীক্ষাগারে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়৷ কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রা কোনো দেশেই থাকে না৷ অনেকে মনে করছেন গরম পানি দিয়ে স্নান করলে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সবসময় জরুরি৷ কিন্তু প্রচণ্ড গরম পানি দিয়ে স্নান করলেই তা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Lipinski
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কি করোনা ভাইরাস শনাক্ত সম্ভব?
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরে তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব, ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করা সম্ভব না৷ সেক্ষেত্রে কারো শরীরে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি বোঝা যাবে না৷ সাধারণত ভাইরাস শরীরে ঢোকার ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যেই তা টের পাওয়া যায়৷ তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিনের পরও ভাইরাস শরীরে কর্মক্ষম থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Mikheyev
টাকার মাধ্যমে কী করোনা ছড়ায়?
শরীরের বাইরে করোনা ভাইরাস কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে৷ ফলে আমদানি করা কোনো পণ্য বা চিঠির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷ ময়লা টাকা থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷ ফলে টাকা লেনদেনের পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত৷ যত বেশি সম্ভব হাত-মুখ-নাক-কানে হাত নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ছবি: DW
মশা বা অন্য পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে?
সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল এক ধরনের বেড়াল থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ালো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে অন্য কোনো মাধ্যম হয়ে মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়েছে৷ তবে মশা বা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে এটি আপনার মধ্যে ছড়াবে না৷ সতর্কতা হিসেবে মাছ-মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে রান্না করতে হবে৷ অর্ধেক সিদ্ধ মাছ-মাংস বা পোচ করা ডিম থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Rose
কিভাবে থাকবো নিরাপদ?
সবচেয়ে জরুরি হাত পরিষ্কার রাখা৷ সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ২০ সেকেন্ড পরিষ্কার করতে হবে৷ যদি সাবান না থাকে, ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷ হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলুন, হাত ধুয়ে নিন৷ অথবা হাতের কনুইয়ে মুখ ঢাকুন৷ হাতের তালুতে হাঁচি-কাশি দিলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে আক্রান্ত হতে পারেন অন্য়রা৷ হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানো ও কোলাকুলি থেকেও বিরত থাকুন৷
ছবি: AFP/N. Almeida
আমি কী মারা যাবো?
করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন, এমন আশঙ্কা একেবারেই কম৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন৷ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন৷ অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন৷ সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে জমিয়ে রাখবেন না৷ আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশেপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস৷ ফলে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন৷