বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে জার্মানির মোট দেশজ আয় বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয় দশমিক সাত ভাগ কমেছে৷ ১৯৭০ সালে থেকে জিডিপির হিসাব চালুর পর এটি সর্বনিম্ন পতনের রেকর্ড৷
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ৷ করোনার কারণে দেশটির ভোক্তা ব্যয়, বিনিয়োগ আর রপ্তানি তলানিতে ঠেকেছে৷ জুন পর্যন্ত তিন মাসে তাই জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে নয় দশমিক সাত ভাগ৷
এটি রেকর্ড হলেও অর্থনীতিবিদেরা এর চেয়েও খারাপ আশঙ্কা করেছিলেন৷ কারণ ফেডারেল স্ট্যাটিসটিকস অফিস এর প্রাথমিক হিসাবে এই সময়ে প্রবৃদ্ধি দশভাগের বেশি কমার প্রাক্কলন করা হয়েছিল৷
এর আগে ২০০৭-০৮ সালেও বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল জার্মান অর্থনীতি৷ এর প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের প্রথম তিন মাসে জিডিপি চার দশমিক সাত ভাগ কমেছিল৷ কিন্তু এখনকার মতো এতটা কমেনি আর কখনোই৷
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মে-জুলাই মাসে ভোক্তা ব্যয় প্রায় ১১ ভাগ, মূলধনী বিনিয়োগ ১৯.৬ ভাগ আর রপ্তানি কমেছে ২০.৩ ভাগ৷ নির্মাণ খাতের কার্যক্রমের পরিসংখ্যানে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরছে৷ সেখানে প্রবৃদ্ধি চার দশমিক দুই ভাগ হ্রাস পেয়েছে৷
করোনা-কালে বেহাল জার্মান অর্থনীতি
করোনা-কালে জার্মান অর্থনীতির অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার আভাস মিলেছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Welz
টোল সংগ্রহ কমছে
রাস্তায় পণ্যবাহী ট্রাকের পরিমাণ বুঝিয়ে দেয় দেশের অর্থনীতি কোন পথে চলছে। পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা কম মানে, জিনিসের চাহিদা কমছে। প্রতি বছর পণ্যবাহী ট্রাকের থেকে টোল আদায় করে সরকার। এর থেকে সরকার ভালো পরিমাণ অর্থ আয় করে। করোনা কালে জার্মানিতে টোল সংগ্রহ চোখে পড়ার মতো কমেছে।
ছবি: Imago Images/M. Stein
উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ
মার্চ মাসের শেষ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে জার্মানিতে লকডাউন ছিল। ফলে ওই সময় জার্মান কারখানাগুলিতেও কাজ কম হয়েছে। করোনাকালে জার্মানিতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে সাত দশমিক পাঁচ শতাংশ কম বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, জার্মানিতে ২০২০ সালের শেষে বিদ্যুতের চাহিদা ২০১৯ এর তুলনায় ১০ শতাংশ কম হবে। তবে শিল্প উত্পাদন আস্তে আস্তে পুনরুদ্ধার হচ্ছে।
ছবি: MEHR
ম্যাপ অ্যাপের ব্যবহার কমেছে
অ্যাপল এবং গুগলের মতো সংস্থাগুলি গুগল ম্যাপের মতো অ্যাপ ব্যবহারের সুবিধা দেয়। এই অ্যাপগুলি থেকে মানুষের জীবনযাপনের গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সংগ্রহ করা হয়। এ বছরের ডেটা বলছে, মার্চে লকডাউন হওয়ার পর থেকে ৬০ শতাংশেরও বেশি জার্মান ম্যাপ অ্যাপ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা বাড়ির বাইরে খুব বেশি বেরচ্ছেন না। এর থেকে প্রমাণ হয়, করোনার কারণে জার্মানদের গতিশীলতা আগের চেয়ে অনেকটা কমে গিয়েছে।
ছবি: picture alliance/dpa/U.Zucchi
রেস্তোঁরা বুকিং
মার্চ মাসে অনলাইন সার্ভিস সংস্থা 'ওপেন টেবিল' একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছিল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, মার্চের গোড়ায় অনলাইনে রেস্তোরাঁ বুকিং চোখে পড়ার মতো কমেনি। কিন্তু করোনার প্রকোপ বাড়ার পরে এবং লকডাউন হওয়ার পরে বুকিং কার্যত শূন্যে পৌঁছে গিয়েছিল। প্রায় সমস্ত রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জুলাই থেকে অবশ্য রেস্তোরাঁ আবার খুলতে শুরু করেছে। তবে এখনও বুকিং আগের মতো হচ্ছে না।
ছবি: Reuters/A. Gebert
বিমান চলাচলে সমস্যা
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জার্মানি থেকে প্রায় দেড় কোটি যাত্রী দেশে এবং বিদেশে যাতায়াত করেছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা কার্যত শূন্য হয়ে যায়। ফ্লাইট ট্র্যাকার ফ্লাইটারাডার ২৪ নামক একটি সংস্থা সমীক্ষা করে দেখিয়েছে, বিভিন্ন দেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পরে বিশ্বজুড়ে কী পরিমাণ বিমান হ্যাঙারে ঢুকে গিয়েছে। তাদের সমীক্ষা বলছে, গত বছরের তুলনায় করোনাকালে গোটা বিশ্বে অন্তত ৭৫ হাজার বিমান কম উড়েছে।
ছবি: picture-alliance/M. Mainka
বেকারত্বের সমস্যা
অর্থনৈতিক সংকটের আরও বড় একটি সূচক হলো বেকারত্ব। জার্মানিতে বেকারের সংখ্যা ছিল চার লাখ ১৫ হাজার। এপ্রিলে তা এক লাফে ২৫ লাখে পৌঁছে যায়। কারণ, বহু ছোট সংস্থা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তবে জার্মান সরকার বেকার ভাতা দিয়ে এই সমস্যাকে অনেকটাই হাতের মধ্যে রাখতে পেরেছে। অন্য বহু দেশের মতো জার্মান বেকারদের সমস্যায় পড়তে হয়নি।
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন
করোনাকালে গাড়ি কেনা বেচাও চোখে পড়ার মতো কমেছে জার্মানিতে। মার্চ মাসে গাড়ি বিক্রি ৩৭ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এপ্রিল মাসে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর এপ্রিলের তুলনায় এ বছর ৬১ শতাংশ গাড়ি কম বিক্রি হয়েছে। মনে রাখা দরকার, গাড়ি শিল্পে জার্মানি পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এসজি/জিএইচ (ডিডাব্লিউ)
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Welz
7 ছবি1 | 7
করোনা সংকটের শুরুতেই আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকার বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল৷ বছরের প্রথম ছয় মাসেই ভোক্তা আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে খরচ করা হয়েছে ছয় হাজার ১০০ কোটি ডলার৷ তা সত্ত্বেও অর্থনীতিতে বড় ধরনের পতন ঠেকানো যায় নি৷
অন্যদের তুলনায় ভালো
শুধু জার্মানি নয়, করোনায় বিশ্বের উন্নত সব অর্থনীতিই সংকটে আছে৷ এই ধরনের দেশগুলোর জোট জি সেভেন-এ জাপান ছাড়া বাকি সদস্যদের অবস্থা জার্মানির চেয়েও খারাপ৷ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ২০.৪ ভাগ কমেছে ব্রিটেনের৷
এরপরই আছে ফ্রান্স৷ ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩.৮ ভাগ জিডিপি হারিয়েছে, যেখানে প্রথম তিন মাসে কমেছিল প্রায় ছয় ভাগ৷
করোনার কারণে ইটালির ১২.৪ ভাগ, ক্যানাডার ১২ ভাগ আর জাপানের প্রবৃদ্ধি কমেছে সাত দশমিক আট ভাগ৷ অন্যদিক অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা ওইসিডি এর ৩৭টি অর্থনীতির মোট জিডিপি প্রায় ১১ ভাগ পড়েছে৷
সামনে আশার আলো
অর্থনীতির এই নিম্নগতির পরিসংখ্যানেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে জার্মানিতে৷ বিধিনিষেধ শিথিলের পর আগস্টে ব্যবসা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে৷ যা কোম্পানিগুলোর প্রত্যাশার চেয়েও ভালো বলে ইফো ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চ এর এক জরিপে উঠে এসেছে৷ জুলাইতে ব্যবসা পরিবেশ সূচকের যেখানে ৯০.৪ পয়েন্ট ছিল তা বেড়ে ৯২.৬ হয়েছে৷ ইফোর প্রেসিডেন্ট ক্লেমেন ফোস্ট বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘জার্মানির অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে’’৷
বিশেষ করে সেবাখাতে ব্যবসার সূচকের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে৷ তাদের জরিপে আগামী ছয় মাসের চিত্রেও ইতিবাচক সম্ভবনারই আভাস মিলছে৷
তারপরও সরকারের পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি বছর দেশটির অর্থনীতি ছয় দশমিক তিন ভাগ কমতে পারে৷