করোনার কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেরত আসা প্রবাসীর সংখ্যা হতে পারে সাত লাখ৷ এরা প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যসহ আরো কয়েকটি দেশে কাজ করেন৷ আর তাদের নিয়ে যে সংকট হতে পারে তার জন্য কী প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ?
ছবি: picture-alliance/Pressefoto Markus Ulmer
বিজ্ঞাপন
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ২৯ হাজার প্রবাসীকে ফেরত পাঠানো হবে৷ করোনার ঠিক আগে এবং করোনার মধ্যে আরো দুই লাখের বেশি বাংলাদেশি ফেরত এসেছেন৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আরো প্রায় চার-পাঁচ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশিকে ফেরত আসতে হতে পারে৷ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন এনজিওর সাথে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে৷
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে তাদের ধাপে ধাপে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হচেছ৷
কুয়েত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে ৷ যারা এর আওতায় নিবন্ধন করেছে তাদের সাড়ে চার হাজার বাংলাদেশিকে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে৷ তাদের ফেরত পাঠানো হবে৷ সৌদি আরব থেকে চার হাজার ২৬২ জন, ওমান থেকে এক হাজার, মালদ্বীপ থেকে চারশ' প্রবাসীকে ফেরত পাঠানো হবে৷ এছাড়া জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকেও ফেরত পাঠানো হবে৷
করোনার মাঝেও শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে দেশে ফিরেছেন এক হাজার ৫০৩ জন বাংলাদেশি৷ আর চলতি মাসের ১১ মে পর্যন্ত ফিরেছেন ৬৭৩ বাংলাদেশি৷
আর এপর্যন্ত বিশ্বের ১৭ টি দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২৩ হাজারের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি৷ মারা গেছেন ৫৮৬ জন৷ তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ২৫০ জন, যুক্তরাজ্যে ২০০ , সৌদি আরবে ৭৬ , কুয়েতে ১৭, ইটালিতে আট, কানাডায় সাত, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ছয়, ফ্রান্স ও স্পেনে পাঁচ জন করে, কাতারে চার , সুইডেনে দুই, মালদ্বীপ, পর্তুগাল, কেনিয়া, লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও গাম্বিয়ায় এক জন করে বাংলাদেশি মারা গেছেন৷
মধ্যপ্রাচ্যে অনেক প্রবাসী খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে আছেন: শরীফুল হাসান
This browser does not support the audio element.
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরীফুল হাসান জানান জানান,‘‘আমাদের যে এক কোটি প্রবাসী আছেন তাদের ৭৫ ভাগই আছেন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে৷ আর তারা মূলত শ্রমজীবী মানুষ৷ সেখানে শতকরা দুই ভাগের মত প্রবাসীর স্থায়ী কোনো কাজ আছে৷ বাকিদের কোনো স্থায়ী কাজ নেই৷ শুধুমাত্র সৌদি আরবেই তিন লাখ প্রবাসী আছেন ফ্রি ভিসায়৷ আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তাতে এখন তাদের অধিকাংই কাজ হারিয়েছেন৷ তারা খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে আছেন৷’’
তিনি এই করেনার কারণে বাংলাদের সামনে তিনটি সংকট দেখতে পাচ্ছেন৷ সেগুলো হলো বিপূল সংখক প্রবাসীর চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসা, তাদের কর্মসংস্থান এবং প্রবাসী আয় কমে অর্থনীতির ওপর চাপ৷
তিনি জানান, ‘‘প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় গড়ে ৫০ হাজার লোক বিদেশে কাজ নিয়ে যেতেন৷ গত তিন মাস ধরে তা বন্ধ আছে৷ করোনা যদি আরো তিন মাস থাকে তাহলে তিন লাখ লোকের কর্মস্থান বন্ধ হয়ে যাবে৷ করোনা শুরুর আগেই দুই লাখ প্রবাসী ছুটিতে এসেছেন৷ তারা যেতে পারেননি৷ আর কখনো যেতে পারবেন কিনা তাও অনিশ্চিত৷ করোনার মধ্যেও প্রবাসীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে৷ আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর আরো তিন-চার লাখ প্রবাসীকে ফেরত পাঠানো হতে পারে৷ শেষ পর্যন্ত মোট সংখ্যাটি সাত লাখ হতে পারে৷’’
তিনি জানান, ‘‘প্রবাসী আয় কমতে শুরু করেছে৷ প্রবাসীরা গড়ে ১৫০-১৬০ কোটি ডলার দেশে পাঠান ৷ কিন্তু মার্চে তা ১২৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে৷ এপ্রিলে ১০৮ কোটি ডলার যা গত তিন বছরে সর্বনিম্ন৷’’
প্রবাসীদের খাদ্য সহায়তার জন্য ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে: মো. শামসুল আলম
This browser does not support the audio element.
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শামসুল আলম জানান, নানা ধরনের সংকট তো তৈরি হচ্ছে৷ প্রতিদিন কমপক্ষে তিন হাজার বাংলাদেশি বিদেশে যেতেন কাজ করতে৷ তারা যেতে পারছেন না৷ আবার যাদের কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে তারাও আসতে পারছেন না৷ যারা ছুটিতে এসেছেন করোনার আগে তারাও যেতে পারেননি৷
সেই কর্মকর্তা জানান, ‘‘অবশ্য কত প্রবাসী এখন বিপদে আছেন এবং কতজন চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন তা বলা কঠিন৷ কারণ সমস্যাটা পুরো দুনিয়ার৷ যারা সৌদি আরবসহ বিভন্ন দেশে ছোট খাট ব্যবসা, দোকানপাট চালাতেন বা অস্থায়ী কাজ করতেন তাদের এখন আর কোনো কাজ নেই৷৷ দূতাবাসের মাধ্যমে প্রবাসী যারা অসহায় অবস্থায় আছেন তাদের সহায়তা কর হচ্ছে যতদূর সম্ভব৷ আর এরইমধ্যে মোট ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যারা চাকরি হারিয়েছেন, যাদের কাজ নেই তাদের খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য৷ আর আমরা ওইসব দেশকেও অনুরোধ জানিয়েছি যে তারা যেন আমাদের নাগরিকদের দেখেন৷’’
পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং যারা ফিরে আসবেন তারা যাতে দেশে কিছু করে খেতে পারেন এজন্য প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ তারা শতকরা চার ভাগ সুদে এই ঋণ পাবেন৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এর আগে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যেসব দেশে আমাদের প্রবাসীরা আছেন তাদের সহায়তার জন্য ওইসব দেশকে আমরা অনুরোধ করেছি৷ তাদের সহায়তায় তারা কোনো উদ্যোগ নিলে আমরা পাশে থাকব৷’’
গত সেপ্টেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...
যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি
প্রতি বছরই বাংলাদেশিরা কাজ নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বিশ্বের কোনো না কোনো দেশে৷ বৈধপথে বিদেশে যাওয়া এসব প্রবাসীর হিসাব রাখে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বা বিএমইটি৷
ছবি: DW
এক কোটি প্রবাসী
বাংলাদেশের ঠিক কতজন নাগরিক প্রবাসে আছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ বিএমইটি-র হিসাবে ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছেন৷ তবে কতজন ফিরে এসেছেন সেই পরিসংখ্যান নেই সেখানে৷
ছবি: Positive light
১৪ লাখ কোটি টাকা
দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীদের আয়৷ এর কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভের অঙ্কটাও এখন বেশ শক্তিশালী৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে মাত্র ২৪ লাখ ডলার বা প্রায় ৩৬ কোটি টাকার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে৷ সেই তুলনায় রেমিটেন্স অনেক বেড়েছে৷ শুধু গত বছরই এসেছে ১৮৩৫ কোটি ডলার বা এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা৷ সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭০৫ কোটি ডলার বা ১৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷
ছবি: AFP
এক তৃতীয়াংশ সৌদি আরবে
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি প্রবাসীর গন্তব্য সৌদি আরব, যেখানে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ৪১ লাখ ৮৪ হাজার বাংলাদেশি পাড়ি জমিয়েছেন৷ ১৯৭৬ সালে মাত্র ২১৭ জন দিয়ে এই শ্রমবাজারের যাত্রা শুরু৷ ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ ৫ লাখ ৫১ হাজার কাজ নিয়ে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে৷ আর চলতি মে পর্যন্ত পাড়ি জমিয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার জন৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
আরব আমিরাতের মন্দা বাজার
শুরুর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতই ছিল বাংলাদেশের বড় বাজার৷ ২০০৮ সালে দেশটিতে একবছরে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ১৯ হাজার জন বাংলাদেশি গেছেন৷ তবে ২০১৩ সালের পর থেকে এই বাজারটিতে মন্দা চলছে৷ গতবছর মাত্র তিন হাজার ৩১৮ জন দেশটিতে পাড়ি জমানোর সুযোগ পেয়েছেন৷ ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭২ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্য ছিল আরব আমিরাত, যা মোট জনশক্তি রপ্তানির ১৮ ভাগের কিছু বেশি৷
ছবি: picture-alliance/J. Schwenkenbecher
পড়তিতে ওমান
প্রবাসীদের গন্তব্যের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে আছে পারস্য উপসাগরের দেশ ওমান৷ ১৫ লাখ ১৮ হাজার বাংলাদেশি কাজ নিয়ে গেছেন সেখানে৷ তবে গত ৩ বছর ধরে এই বাজারটিতেও প্রবাসী যাওয়ার সংখ্যা কমছে৷ ২০১৬ সালে যেখানে এক লাখ ৮৮ হাজার জন ওমানে পাড়ি জমিয়েছেন, গেল বছর তা নেমে এসেছে ৭২ হাজার ৬৫৪ জনে৷ আর চলতি বছর মে পর্যন্ত গেছেন মাত্র ১৭ হাজার ৪০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/A. Farnsworth
আকর্ষণীয় মালয়েশিয়া
বাংলাদেশিদের কাছে মালয়েশিয়া আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে শুরু করে মূলত ১৯৯০ সালের পর থেকে৷ ২০০৭ সালে সেখানে সবচেয়ে বেশি ২ লাখ ৭৩ হাজার জনের বেশি শ্রমিক কাজের জন্যে গেছেন এশিয়ার দেশটিতে৷ মাঝে এই প্রবণতা কমলেও সম্প্রতি আবার বেড়েছে৷ ২০১৮ সালে দেশটিতে গেছেন প্রায় এক লাখ ৭৬ হাজার জন আর ২০১৯ এ মাত্র ৫৪৫ জন৷ সব মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ ৫৭ হাজারের বেশি বাংলাদেশি৷
ছবি: picture-alliance/FOTOGRAMMA/M. Alberico
সম্ভাবনার কাতার
২০০৬ সাল পর্যন্তও কাতারের বাজার বাংলাদেশের শ্রমশক্তি রপ্তানিতে ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না৷ তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিও এখন বিদেশ গমনেচ্ছুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে৷ কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন সেখানে অনেক বাংলাদেশির জন্যেই কাজের সুযোগ তৈরি করেছে৷ এখন পর্যন্ত আট লাখ ১১ হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে কাজ নিয়ে গেছেন৷
ছবি: picture-alliance
দক্ষ শ্রমিকের বাজার সিঙ্গাপুর
দেশের দক্ষ শ্রমিকদের জন্য পছন্দের এক গন্তব্য সিঙ্গাপুর৷ এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির দেশটিতে এখন পর্যন্ত চাকরি নিয়ে ৭ লাখ ৯২ হাজার বাংলাদেশি পা রেখেছেন, যা মোট প্রবাসীর ছয় ভাগের কিছু বেশি৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬০ হাজার জন গেছেন ২০১৩ সালে৷
ছবি: picture-alliance/Global Travel Images
কুয়েতে ৫ ভাগ
বাংলাদেশিদের জন্য কুয়েতের মতো গুরুত্বপূর্ণ এক শ্রমবাজার প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলা চলে৷ ২০০৮ থেকে ২০১৩— এই সময়ে মাত্র ৪১৪ জন দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন৷ ২০১৪ সাল থেকে তা বাড়তে শুরু করলেও গত দুই বছর ধরে আবার পড়তির দিকে৷ সব মিলিয়ে ছয় লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশি গেছেন কুয়েতে, যা মোট প্রবাসীর প্রায় ৫ ভাগ৷
ছবি: picture-alliance/robertharding/G. Hellier
পারস্য উপসাগরের দ্বীপে
চার লাখ ১০ হাজার বাংলাদেশির গন্তব্যের দেশ বাহরাইন৷ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ৭২ হাজার মানুষ কাজ নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন পারস্য উপসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে৷ তবে ২০১৯ সালে গেছেন মাত্র ১৩৩ জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.Al-Shaikh
ইউরোপে সর্বোচ্চ ইটালিতে
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি রয়েছে ইটালিতে৷ ২০০২ সাল থেকে সেখানে পাড়ি জমানোর তথ্য আছে বিএমইটির কাছে৷ সে অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সাড়ে ৫৫ হাজার বাংলাদেশি বৈধ পথে গেছেন পশ্চিম ইউরোপের দেশটিতে৷