করোনা ভাইরাস ঠেকাতে এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছে জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটির জনগণ যেগুলোর মুখোমুখি হয়নি৷ আর এতে মানুষের জীবনযাত্রাও বদলে গেছে রাতারাতি৷
বিজ্ঞাপন
একটিও পাতা নেই, অথচ ফুলে-ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো গাছ৷ ঘাসের বুকে ঝাড়বাতির মতো যেন জ্বলছে সাদা ফুল৷ পঞ্জিকার পাতা অনুযায়ী জার্মানিতে আজ, অর্থাৎ শুক্রবার থেকে শুরু হলো বসন্তের দিন গণনা৷ অবশ্য প্রকৃতি তার জানান দিচ্ছিল সপ্তাহ খানেক ধরেই৷ মেঘের আস্তরণ সরে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আলো ছড়াচ্ছে সূর্য৷ দিনের দৈর্ঘ্যও বাড়ছে ক্রমশ৷ গুমোট শীতের শেষে সময়টা এখন জার্মানদের জন্য উপভোগের, আড্ডা আর ভ্রমণের, সারা বছর চুপচাপ থাকা মানুষগুলোর কিছুটা হৈ হুল্লোড় প্রকাশের৷ অথচ বাইরে তাদের দেখা নেই৷
অফিস ধরার যেই ট্রামে সকাল বেলা বসার আসন পাওয়া যেতো না প্রায়ই, সেটি এখন যাতায়াত করছে হাতে গোণা কয়েকজনকে নিয়ে৷ তারা বসছেন একে অন্যের থেকে বেশ দুরত্ব বজায় রেখে৷
এরই মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেশিরভাগ কাজ করছেন বাসা থেকে৷ বন্ধ থিয়েটার, সিনেমা হল, পাব, বার, নাইট ক্লাব, জিম, খেলাধুলার আয়োজন থেকে শুরু করে বিনোদনের সব কিছু৷ মার্কেটে জরুরি প্রয়োজনীয় দোকান ছাড়া খুলছে না বাকিগুলো৷ বেঁধে দেয়া হয়েছে রেস্টুরেন্ট খোলা রাখার সময়সীমাও৷ বিকেল বা সন্ধ্যার চেনা বন শহরটি দেখতে কেমন যেন ভূতুড়ে হয়ে উঠেছে৷ শহরের প্রাণকেন্দ্রে বেটোফেনের ভাস্কর্যই শুধু একা দাঁড়িয়ে৷ এমন চেহারা আমার মতো প্রবাসী তো বটেই, জার্মানদের কাছেও নিশ্চয়ই অচেনা৷
করোনা আতঙ্ক: জার্মানিও বন্ধ করেছে দুয়ার
করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টার এখন ইউরোপ৷ বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নেওয়া করোনার বিস্তার ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মঙ্গলবার ৩০ দিনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের দেশের নাগরিকদের বুধবার সকাল থেকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
একদিনেই ১২০ ফ্লাইট
ইইউর এ সিদ্ধান্তের কারণে একদিনেই শুধু ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে ১২০টি ফ্লাইটের প্রায় নয় হাজার যাত্রীকে বাড়তি পর্যবেক্ষণের মধ্যদিয়ে যেতে হবে৷
ছবি: Reuters/R. Orlowski
ঢুকতে না পারা যাত্রীদের দায়িত্ব নিচ্ছে এয়ারলাইন
নতুন নিষেধাজ্ঞার কারণে যারা ফ্রাঙ্কফুর্টে আটকে গেছেন তাদের যেখান থেকে যাত্রা করেছেন সেই বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে নিজ নিজ এয়ারলাইন৷
ছবি: picture-alliance/empics/The Canadian Press/D. Dyck
কারা ঢুকতে পারছেন?
জার্মান নাগরিক ও তাদের পরিবার এখনো বিনাবাধায় দেশে ফিরতে পারবেন৷ এছাড়া জার্মানিতে যাদের বসবাসের অনুমতি (রেসিডেন্স পারমিট) আছে তারা ছাড়াও ইইউ সদস্যরাষ্ট্রের নাগরিক, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, লিশটেনস্টাইন ও সুইজারল্যান্ডের নাগরিক ও তাদের পরিবার৷ যাদের দীর্ঘমেয়াদী জার্মান ভিসা আছে (যেমন ছাত্ররা) তারাও ঢুকতে পারবেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
কারা পারছেন না?
মূলত পর্যটক বা ব্যবসার কাজে স্বল্প সময়ের ভিসা নিয়ে আসা ব্যক্তিদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না৷ তবে ট্রানজিট যাত্রীদের বিমানবন্দরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে৷ তবে নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করতে হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Y. Schreiber
জরুরি প্রমাণে বিশেষ ছাড়
সব কিছুর পরও যদি কেউ জরুরি প্রয়োজন প্রমাণ করতে পারেন তাকে বিশেষ বিবেচনায় প্রবেশ করে দেওয়া হতে পারে৷ সেক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Silz
6 ছবি1 | 6
এরই মধ্যে জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে৷ ৪৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন৷
পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা জনগণকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে সরকার৷ জাতির উদ্দেশে দেয়া বিরল ভাষণে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলও বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়নি এ দেশ৷ চীন বা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সরকারের মতো জনগণের চলাচলের উপর বাধা আরোপের পূর্ব অভিজ্ঞতা তাদের নেই৷ কিন্তু এখন সেটি করতে হচ্ছে৷ এ নিয়ে যেন সরকারের মধ্যেও কিছুটা অস্বস্তি কাজ করছে৷ তাই বিনয়ের সঙ্গে বেঁধে দেয়া নিয়ম মেনে চলতে জনগণের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন ম্যার্কেল তার ভাষণে৷
সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রবার্ট কখ ইনস্টিটিউট এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, মহামারির এই পরিস্থিতিতে দুই বছর পর্যন্ত ভোগার সম্ভাবনা রয়েছে৷ সংকট মোকাবেলায় প্রস্তুত করা হচ্ছে সেনাবাহিনীকে৷
এমন পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষেত্রে অবশ্য জার্মানিতে একটি আইন রয়েছে৷ সেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ বিধি ২০০১-এর আওতায় বিভিন্ন জরুরি পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে৷ মানুষ অবাধ চলাফেরাসহ যেসব মৌলিক অধিকার বরাবর ভোগ করেন এই আইনের অধীনে সেগুলো কিছুটা রহিত করা সম্ভব৷ এরইমধ্যে সেসব পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে সরকার৷ গণজমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হিসেবে সন্দেহভাজনকে কোয়ারান্টিনে পাঠানো হচ্ছে৷
করোনা আতঙ্ক: কীভাবে কোয়ারান্টিন উপভোগ করবেন
করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে৷ ছোঁয়াচে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে আক্রান্তদের ‘আইসোলেশনে’, রাখা হচ্ছে৷ সন্দেহভাজনদেরও ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টিনে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে৷ বুদ্ধি খাটালে কোয়ারান্টিনও হতে পারে উপভোগ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/SvenSimon
বই পড়ে
চরম ব্যস্ত এ পৃথিবীতে সারা বিশ্বেই বই পড়ুয়াদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ কোয়ারান্টিনের সময়ে বই হয়ে উঠতে পারে আপনার প্রিয় সঙ্গী৷ এত দিন ‘পড়ব, পড়ব’ করেও সময়ের কারণে যে বইগুলো পড়ে উঠতে পারছিলেন না, সেগুলো নিয়ে বসে যেতে পারেন৷
কোয়ারান্টিনে থাকার সময় আপনি নতুন নতুন রেসিপিতে রান্নার চেষ্টা করতে পারেন৷ এমন সব খাবার রান্না করতে পারেন যা খেলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে৷
ছবি: Miguel Medina/AFP/Getty Images
শরীরচর্চা
দৈনন্দিন কাজের চাপে অনেকেই শরীরচর্চার সময় পান না৷ কোয়ারান্টিনে থাকার সময় আপনি অনায়াসেই শরীরচর্চা করতে পারেন৷ তবে বাইরের কোনো জিমে যেতে পারবেন না৷ ঘরে ব্যায়ামের যন্ত্র না থাকলেও চিন্তা নেই৷ করতে পারেন ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা যোগব্যায়াম৷ এটা একইসঙ্গে আপনার শরীরকে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সক্ষম করে তুলবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.-D. Gabbert
ঘরদোর পরিষ্কার করা
কোয়ারান্টিনে থাকার সময় আপনি বাড়িঘর ঝকঝকে তকতকে করে মনের মতো সাজিয়ে নিতে পারেন৷
করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বেই মেলা, কনসার্ট, সম্মেলনসহ নানা অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ হয়ে গেছে৷ খেলা হচ্ছে দর্শকহীন মাঠে৷ এ নিয়ে মন খারাপ না করে আপনি সহজেই অনলাইনে নানা সরাসরি অনুষ্ঠানের দর্শক হতে পারেন৷
ছবি: DW/R. Akbar Putra
দেখতে পারেন টেলিভিশন
এখন কত নাটক, সিনেমা, টিভি সিরিজ বা ওয়েব সিরিজ হচ্ছে৷ টেলিভিশনে সেগুলো দেখে নিতে পারেন৷
১৪ দিনের কোয়ারান্টিনে থাকলে আপনার হাতে তখন অফুরন্ত সময়৷ এই সময়ে নানা ধরনের বোর্ড গেম খেলে মস্তিষ্ক ঝালিয়ে নিতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Stache
আয়করের হিসাব-নিকাশ
হাস্যকর শোনালেও এই সময়ে ঠান্ডা মাথায় বসে আপনি নিজের আয়করের হিসাবনিকাশ করে ফেলতে পারেন৷ তবে খুব বেশি চাপের হয়ে গেলে হাল ছেড়ে দেওয়াই ভালো৷
ছবি: Colourbox
দক্ষতা বাড়াতে নতুন কিছু শেখা
কোয়ারান্টিনে থাকার দিনগুলোতে অনলাইন থেকে আপনি নতুন কিছু শিখতে পারেন৷ শিখতে পারেন নতুন কোনো ভাষা৷ অনলাইনে সহজেই এটা করা যায়, কোথাও কোথাও বিনামূল্যেই পাবেন৷ তাই কোয়ারেন্টাইনে সময় কিভাবে কাটাবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই৷
ছবি: Colourbox
স্মৃতি রোমন্থন
কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলেন, দারুণ সময় কাটিয়েছেন৷ তুলেছেন অসংখ্য ছবি৷ কোয়ারান্টিনের সময় খুলে বসতে পারেন সেসব ছবির অ্যালবাম৷ মনে মনে চলে যেতে পারেন সেই সময়ে৷ কিংবা বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে কাটানো আনন্দের স্মৃতি রোমন্থন করেও কাটিয়ে দিতে পারেন বন্দি থাকার সময়টা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Schickert
10 ছবি1 | 10
জার্মানিতে এখন পর্যন্ত একমাত্র বাভারিয়া রাজ্যই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে৷ এর মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপক ও বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে নিজেদের অধীনে নিলো রাজ্য সরকার, যা সাধারণত স্থানীয় প্রশাসন বা শহর কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকে৷ বাভারিয়ার সব হাসপাতালও এখন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷ সেখানকার প্রশাসন চাইলে অবসরপ্রাপ্ত ও সরকারের অধীনে না থাকা ডাক্তারদেরও দায়িত্ব পালনে তালিকাভুক্ত করতে পারবে৷
তবে এখন পর্যন্ত জার্মানির কোনো রাজ্যে কার্ফিউ ঘোষণা করা হয়নি৷ সামনের দিনে সেই আশঙ্কা অবশ্য একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না৷ এরই মধ্যে ফ্রাইবুর্গ ও লেভারকুজেনে দুই সপ্তাহের ‘লকডাউন' ঘোষণা করা হয়েছে৷
জার্মানির আইন অনুযায়ী অভ্যন্তরীন বা বাইরের হুমকি মোকাবিলায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায়৷ সেটি মহামারি পরিস্থিতিতেও কার্যকর হতে পারে৷ ১৯৬৮ সালে পাস হওয়া আইনটি নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে৷ ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে আবারও নাৎসি একনায়কতন্ত্রের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কা করেন কেউ কেউ৷ এবার যদি সেটি কার্যকর হয়, তাহলে এতদিন ধরে মুক্ত আর স্বাধীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত জার্মানদের অপরিচিত এক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি হতে হবে৷ গত ৭০ বছরের ইতিহাসে যে ব্যবস্থা কখনো জারি হয়নি ফেডারেল রিপাবলিকটিতে৷