করোনায় বাড়ছে নির্যাতন
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০এই করোনায় যে শুধু স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তা নয়, শাশুড়ি বা পরিবারের অন্য পুরষ সদস্যদের হাতেও তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷ এমনকি শ্বশুর বাড়িতে নারী সদস্যদের হাতেও তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন৷
গত ৩ সেপ্টেম্বর পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় এক গৃহবধূ তার শাশুড়ি, শ্বশুর ও চাচা শ্বশুরের নির্মম নির্যাতনে শিকার হয়েছেন৷ পারিবারিক কথা কটাকাটির জের ধরে তাকে নির্যাতন করা হয়৷ তার স্বামী প্রবাসী৷ গৃহবধূর মেয়ে মাকে নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করলে পুলিশ শাশুড়ি আলেয়া বেগমকে গ্রেপ্তার করে৷ বাকি দুই আসামি পলাতক৷
২৩ আগস্ট কক্সবাজারের বেকুয়ায় আরেক গৃহবধূ তার স্বামীর নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে যান৷ স্বামী সাইফুদ্দিন যৌতুকের দাবিতে তাকে লোহার রড দিয়ে নির্যাতন করে বলে অভিযোগ৷ জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে হাসপাতলে ভর্তি করা হয়৷ নির্যাতক স্বামী পালিয়েছে৷
গত ১৩ জুন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার সিলিমপুর ইউনিয়নে যৌতুকের দাবিতে এক গৃহবধূকে খুঁটির সাথে বেঁধে অমানবিক নির্যাতন করে তার স্বামী আশরাফ হোসেন৷ শ্বশুর বাড়ির সদস্যরাও নির্যাতনে অংশ নেয়৷ এ নিয়ে ছয় জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয়েছে৷
করোনায় সময় এভাবে প্রায় প্রতিদিনই সহিংসতার শিকার হচ্ছে নারী৷ একই সঙ্গে বাড়ছে শিশু নির্যাতন৷
‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ গত মে মাসে একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে৷ তারা জানায় দেশের ২৭টি জেলায় এপ্রিল মাসে চার হাজার ২৪৯ জন নারী এবং ৪৫৬ টি শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে৷
জরিপে অংশ নেয়া এক হাজার ৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪টি শিশু আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হয়নি৷ শিশুদের মধ্যে শতকরা ৯২ ভাগ তাদের বাবা-মা ও আত্মীয়দের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে৷ আর নারীরা বেশির ভাগই স্বামীর হাতে৷
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম তখন ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, ‘‘সারা বিশ্বে এই করোনায় নারীর প্রতি সহিংসতা শতকরা ২০ ভাগ বেড়ে গেছে৷ বাংলাদেশও তার বাইরে নয়৷ আর আমরা যে চিত্র পেয়েছি, পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ৷ কারণ, যোগযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে অনেকেই অভিযোগ করতে পারছেন না৷’’
এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে দেখা যায়, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন৷ এই সময়ে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৮৯ জন নারী৷ তাদের মধ্যে স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন ১৬৩ জন৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই সময়ে কাজ হারানো, ঘরে বসে থাকা এই সব কারণে পুরুষ হতাশায় ভুগছে৷ তার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে৷ আর তার ফল নিতে হচ্ছে নারী ও শিশুকে৷’’ আর অর্থনেতিক সংকট কাটাতে পুরুষ নারীর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, ফলে যৌতুকের দাবিতে নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি৷ তার মতে, ‘‘এই করোনার সময় প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্থাও আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে৷’’
করোনার সময়ে প্রথম দিকে অপরাধ কিছুটা কমে গেলেও তা এখন আবার আগের অবস্থায় চলে এসেছে৷ আর প্রতারণাসহ অনলাইনের মাধ্যমে অপরাধ বেড়ে গেছে৷ মানি ট্রান্সফার অ্যাপের মাধ্যমে আর্থিক প্রতারণা বেড়েছে৷ বেড়েছে অনলাইন শপিং প্রতারণা৷ ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল ইসলাম জানান, ‘‘অপরাধের ধরন কিছুটা পাল্টেছে৷ এখন অনলাইনে অপরাধীরা বেশি সক্রিয়৷ আর প্রচলিত ধারার অপরাধ তো আছেই৷’’ তিনি আরো বলেন, এরমধ্যেও তাদের কাছে যত অভিযোগ আসে তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই নারীর প্রতি অপরাধ৷ আর তারমধ্যে ১৪ থেকে ২১ বছর বয়সের নারীরাই বেশি সাইবার ক্রাইম-এর শিকার হচ্ছেন৷ এর সঙ্গে আছে অনলাইনে নানা ধরনের জালিয়াতি ও প্রতারণার অপরাধ৷
অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনার শুরুর দিকে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও সব কিছু থমকে গিয়েছিল৷ ফলে অপরাধীরাও কিছুটা থমকে গিয়েছিল৷ কিন্তু এখন তারা আগের মতোই সক্রিয় হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, নানা কারণে এখন অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘একদিকে আর্থিক সংকট অপরাধ বাড়িয়ে দিচ্ছে৷ অন্যদিকে আছে করোনার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা৷ আর অপরাধের ধরন যে পাল্টাচ্ছে তা ধরতে দক্ষতার অভাবও আছে তাদের৷’’
তিনি বলেন, ‘‘নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বাড়ার নতুন কারণ হলো করোনার কারণে অভিযোগ জানানোর সুযোগ কমে যাওয়া৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হতাশ পুরুষের ব্যর্থতা ঢাকার নির্মম উপায়৷ সব কিছুর জন্য নারী ও শিশু যেহেতু দুর্বল তাই তাদের ওপর সহিংসতা চালাচ্ছে৷’’ তিনি বলেন, ‘‘এই সময়ে জঙ্গিরাও ধীরে ধীরে সক্রিয় হচ্ছে৷ তাই এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পুরো মাত্রায় সক্রিয় হতে হবে৷ বাড়াতে হবে দক্ষতা৷ আর নারীদের অভিযোগ করার সুযোগ এবং সক্ষমতা বাড়াতে হবে৷’’ ডা. তাজুল ইসলাম মনে করেন, এর সঙ্গে প্রয়োজন এখন নানা ধরনের সচেতনতামূলক কর্মসূচি, কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা৷