প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মৃত্যু মানুষের হবে৷ সেই ভয়ে ভীত না হয়ে করোনা মোকাবিলায় সবাইকে লড়তে হবে৷ প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যুভয় কি অমূলক?
বিজ্ঞাপন
সোমবার সকালে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) এর ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘আমি চাই আমাদের মানুষের ভেতরে যেন একটা আস্থা থাকে, বিশ্বাস থাকে৷ সেই বিশ্বাস, আস্থাটা ধরে রাখতে হবে৷ কারণ, আমরা হার মানবো না৷ মৃত্যু তো হবে, মৃত্যু যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কারণেই হতে পারে৷’’
প্রধানমন্ত্রীর এ কথার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত৷ মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে গেলে কেমন করে হবে? শুধু করোনা নয়, যে কোনো কারণেই তো মৃত্যু হতে পারে৷ তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো, যখন মানুষ সান্ত্বনা দেবার ভাষা খোঁজেন, তখনই কেবল এমন কথা বলেন৷ কারণ, সাধারণভাবে মানুষের মৃত্যুভয় আছে, থাকবে৷ আর তা বড় করে দেখা দেয়, চারপাশে তারা যখন অন্য মানুষদের অসহায় অবস্থায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেন এবং বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, এমন মৃত্যু তারও হতে পারে৷
প্রতিদিন খবরের কাগজে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থা চোখে পড়ছে৷ হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন৷ হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে শেষতক অ্যাম্বুলেন্সেও প্রাণ দিতে হয়েছে৷ ব্যাপারটা ঘটছে কমবেশি সব রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্ম,বর্ণ, শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রেই৷ এ অবস্থায় মৃত্যুভয়ে ভীত হবেন না মানুষ তা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় আমার কাছে৷
প্রধানমন্ত্রী মানুষকে উৎসাহ দেবার জন্য বা সাহস ধরের রাখতে প্রেরণা জোগানোর জন্যও কথাগুলো বলে থাকতে পারেন৷ অর্থাৎ, সবাই যেন তাদের মনোবল ফিরে পান সেজন্যও বলতে পারেন৷ এর অর্থও কিন্তু সেই একই যে, মানুষ আসলে মনোবল হারিয়েছেন৷ চিকিৎসা সেবার ওপর আস্থা হারিয়েছেন৷ বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্যখাত ভঙ্গুর অবস্থায় চলে গেছে৷ এমনকি বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেবার মতো সক্ষম প্রকল্প কিংবা তা বাস্তবায়নের সক্ষমতাও দেখা যায়নি৷ কী অসহায় আমরা!
উলটোদিকে, রোববার সংসদে প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে অনুরোধ করলেন৷ বললেন, অন্তত স্বাস্থ্যবিধিটা মেনে চলতে৷ আমরা দেখেছি, সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে৷ এ এক ‘সারকাজম’৷ অনেক মানুষ ভয় পাবেন৷ আবার অনেকে কোনোকিছুর তোয়াক্কা করবেন না, হোক সে অর্থনৈতিক কারণে অথবা সচেতনতার অভাবে৷ কিন্তু এই সচেতনতা তৈরিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে? মানুষের ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার কাজ কতটা সুচারুরূপে করা হচ্ছে? আসল কথা হলো, করোনা নামের এক অদৃশ্য শত্রু আমাদের সবার দুর্বলতার জায়গাগুলো দেখিয়ে দিয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রীর কথা ঠিক৷ আপাতত লড়াইটা করোনার বিরুদ্ধে৷ এরপরের লড়াইটা কিন্তু আমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই লড়তে হবে৷
করোনার বিরুদ্ধে কারা জেতে, কারা জেতে না
ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমানে সমানে লড়ে, কিন্তু এই লড়াইয়ে ব্রাজিল পাত্তাই পায় না৷ ৪৫ বছর আগের এক যুদ্ধের মতো পুঁচকে ভিয়েতনামের কাছে আবার লজ্জা পায় যুক্তরাষ্ট্র৷ করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আরো কিছু বিষয় থাকছে ছবিঘরে..
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
দেশ অপ্রস্তুত আর প্রেসিডেন্ট একগুঁয়ে হলে যা হয়
চীনে করোনা সংকট দেখা দেয়ার দু’মাস পরও যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতি, করোনা টেস্ট শুরু করায় বিলম্ব, ইটালিতে মৃত্যুর মিছিল দেখেও করোনাকে ট্রাম্পের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, মধ্য এপ্রিলেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চাওয়া- ইত্যাদির উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি৷ বিশেষজ্ঞরা যা চান ট্রাম্প তার ঠিক বিপরীত দিকে হাঁটতে চেয়েছেন৷ ফলাফল পরাশক্তি হয়েও করোনার কাছে নাস্তানাবুদ হওয়া৷
শীতল যুদ্ধের যুগ আর নেই৷ তবে এ যুগেও কমিউনিস্ট শাসিত কিউবা আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক মধুর হয়নি ৷ যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃত্যু এক লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে, অথচ কিউবায় মারা গেছে মাত্র ৮৩ জন৷ হোক না মাত্র এক কোটি ১৪ লাখ মানুষের দেশ, করোনাকে এভাবে বোতলবন্দি করলো কিভাবে তা-ই এখন কৌতুহলের কেন্দ্রে৷ গার্ডিয়ান বলছে, শুরু থেকে সপ্তাহের সাতদিন ঘরে ঘরে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তা সম্ভব করেছে কিউবা৷
ছবি: pictrure-alliance/AP Photo/I. Francisco
বিশেষজ্ঞরা স্বেচ্ছাচারিতার কবলে পড়লে যা হয়
লকডাউন প্রশ্নে ট্রাম্পের বিরোধিতা করে কোণঠাসা হয়েছেন জাতীয় অ্যালার্জি ও সংক্রামক রোগ ইনস্টিটিউটের প্রধান ডা, অ্যান্থনি ফাউচি, একই বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর বিরোধিতা করে দায়িত্ব হারিয়েছেন ব্রাজিলের দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রী৷ সামাজিক দূরত্ব মানার সরাসরি বিরোধিতা করা বলসোনারোর দেশও এখন ধুঁকছে৷ গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে কিউবার চেয়ে সত্তর গুন পিছিয়ে আছে ব্রাজিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Lima
ভিয়েতনাম হলে যা হয়
ভিয়েতনামও করোনার বিরুদ্ধে দারুণ সফল৷ দেশ ছোট আর অর্থনীতি দুর্বল হলেও বড় যুদ্ধে ভিয়েতনাম কখনো হারেনি৷ ৩৫ বছর আগে সামরিক যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, এখন ব্যর্থ হচ্ছে করোনা ভাইরাস৷ দ্রুত সীমান্ত বন্ধ করা, অল্প সময়ে বেশি পরীক্ষা করানো, সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন- সব নিয়ম কঠোরভাবে মেনে সফল হয়েছে ভিয়েতনাম৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Hau Dinh
সরকার এবং সরকারপ্রধান অপরিনামদর্শী না হলে যা হয়
জনমনে অসন্তোষ দেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বন্ধ করেছিল ব্রাজিল সরকার৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তা আবার চালু হয়েছে৷ ফুটবলে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে আর্জেন্টিনা ২৬ হাজারের মতো সংক্রমণ আর মাত্র ৭৮৭ জন করোনায় মৃত্যু নিয়ে এখনো অনেক ভালো অবস্থায়৷ আর্জেন্টিনার জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি, বিপরীতে ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটির কাছাকাছি হলেও ব্যবধানটা কিন্তু সেই তুলনায় অনেক বড়!
ছবি: Getty Images
করোনাকে বেশি সময় দিলে যা হয়
করোনা যখন হানা দিলো, তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি, ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের জোগান- সব কিছুরই ঘাটতি ছিল ইউরোপের দেশটিতে৷ লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব মানতে চাননি অনেকে৷ ফলে বিপদ বেড়েছে দ্রুত৷ এখন পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক৷ এ পর্যন্ত ইটালিতে ৩৪ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ ডাক্তার মারা গেছেন একশ’রও বেশি৷ বেশির ভাগ ডাক্তারই মারা গেছেন পিপিই ছাড়া চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/E. Mattia Del Punta
ছোট দেশও ‘গাইডলাইন’ মানলে যা হয়
প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডার্ন জানিয়েছেন, নিউজিল্যান্ডে আর করোনায় সংক্রমিত রোগী নেই৷ বিশ্লেষকরা বলছেন মূলত গাইডলাইন মেনে চলার কারণেই এমন সাফল্য এসেছে৷ ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের স্কুল অব ফার্মাসির শিক্ষক ওকসানা পাইসিক বলেন, ‘‘ প্রথমে খুঁজে বের করা, তারপর টেস্ট করা, আইসোলেট করা, প্রত্যেক রোগীকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা, সংক্রমণ ধরা পড়লে কোয়ারান্টিনে পাঠানো- এসব মেনেই নিউজিল্যান্ড সফল হয়েছে৷’’