হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গেছে ঢাকার দৃশ্যপট৷ যানজট, ধূলিময় বাতাস, রাস্তায় গিজগিজে মানুষ- এসবই আগের মতো আছে৷ পাল্টে গেছে মানুষের মুখ৷
বিজ্ঞাপন
প্রায় সকলের মুখে এখন মাস্ক৷ এ মাস্ক চেহারা ঢাকার মুখোশ নয়, করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সার্জিক্যাল মাস্ক৷ মাস্কে ঢাকা পড়েছে মুখ, এ মুখগুলো ভিন্ন ভিন্ন৷ কিন্তু প্রতিটা মুখে লটকে থাকা যে আতঙ্ক- সেখানে কোন ভিন্নতা নেই৷
পাল্টে গেছে মিডিয়া৷ সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ভয় দেখানো ভঙ্গিতে করোনার শিরোনাম৷ টেলিভিশনে দুনিয়াজুড়ে কোথায় কত আক্রান্ত হলো, কত মারা গেল তার আপডেট৷ আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা প্রকাশে এরা যতটা আগ্রহী, ততটা যেন নয় রোগমুক্তি আর সচেতনতা বিষয়ক তথ্য প্রচারে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন এ রোগ নিয়ে আজগুবি সব গুজব৷ সেদিন দেখলাম আসামের কোন বিধায়ক নাকি বলেছেন- গোমূত্রে ভালো হয় কোভিড-১৯৷ একজন একটা ছবি শেয়ার করেছেন, ফুটপাতে এক লোক বসে আছে, তার পিছনে ব্যানারে লেখা- হোমিও পদ্ধতিতে তিনি দিয়ে থাকেন করোনা ভাইরাসের ওষুধ!
অধিকাংশ ওষুধের দোকানের কাউন্টারে বা দৃশ্যমান কোন জায়গায় নোটিশ টাঙানো- ‘মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার নেই'৷ ফুটপাতে অবশ্য মাস্ক পাওয়া যায়, তবে সেগুলো খুবই নিম্নমানের, এবং দামও বেশি৷ আগে যেটা দশ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটা ত্রিশ টাকা৷ তাহলে ফার্মেসিতে নেই কেন? এক ফার্মেসি মালিক বললেন- ভাই, আমাদের তো বিক্রি করলেই লাভ৷ মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা এখন খুবই বেশি৷ কিন্তু তারপরও আমরা ইচ্ছা করেই রাখছি না৷ চাহিদা বেশি বলে আমাদেরকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, অথচ বিক্রির সময় দাম একটু বেশি চাইলেই ঝামেলায় পড়তে হয়৷ অনেক জায়গায় র্যাব অভিযান চালিয়েছে৷ রীতিমত বেইজ্জতি ব্যাপার৷
র্যাবের অভিযানের বিষয়টাও কিন্তু অমূলক নয়৷ রীতিমত ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে নিয়ে র্যাব বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়েছে৷ কেবল রাজধানী ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও চলেছে এ অভিযান৷ হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা মাস্কের দাম বেশি চাওয়ার কারণে একাধিক ওষুধের দোকানকে জরিমানা করা হয়েছে৷ সেসব আবার টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে প্রচারও হয়েছে৷ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে খুব কাজকর্ম করছে, করোনা নিয়ে যে তারাও বেশ উদ্বিগ্ন- সেটা টের পাওয়া গেছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে মাস্ক নিয়ে এত হইচই, কেনা এবং পরার জন্য দারুন হুজুগ, তার কি সত্যই কোন দরকার আছে এখন বাংলাদেশে?
করোনায় করণীয়
করোনা প্রতিরোধে কী করতে হবে তা নিয়ে একটি নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআর৷ ছবিঘরে দেখুন বিস্তারিত৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ZUMA Wire/Cdc
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস
আট মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাস আক্রান্ত তিন রোগী শনাক্তের ঘোষণা দিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর৷ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, আক্রান্তদের মধ্যে দুজন সম্প্রতি ইটালি থেকে ফিরেছেন৷ পরবর্তীতে তাদের একজনের সংস্পর্শে পরিবারের আরেক সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন৷ তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে৷
ছবি: Privat
করোনা যেভাবে ছড়ায়
মোট সাতটি প্রজাতির করোনা ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে৷ তার একটি ২০১৯ এন করোনা ভাইরাস৷ এই ভাইরাসটি প্রথমে প্রাণী থেকে মানুষে এবং এখন তা মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে৷ এটি ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়৷ হাঁচি, কাশি, কফ, থুথু বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শেও এই রোগ ছড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/ZUMA Wire/Cdc
যেসব লক্ষণ দেখা যায়
শরীরে নভেল করোনা ভাইরাস প্রবেশের পর দুই থেকে ১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথমে জ্বর হয়৷ এছাড়াও শুকনো কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া হতে পারে৷ কারো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, ক্যান্সার থাকলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/XinHua/Xiong Qi
কী করবেন?
প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সচেতনতাই একমাত্র উপায়৷ ঘন ঘন সাবান ও পানি দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড সময় ধরে হাত ধুতে হবে৷ অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক, মুখ স্পর্শ করা যাবে না৷ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে৷ হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় বাহু, টিস্যু বা কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখতে হবে৷ অসুস্থ পশু-পাখির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন৷ মাছ-মাংস ভালোভাবে রান্না করে খান৷
ছবি: Reuters/R. Patrasso
চিকিৎসা কী?
এন করোনা ভাইরাস নতুন হওয়ায় এর কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনও আবিষ্কার হয়নি৷ চিকিৎসা লক্ষণভিত্তিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/XinHua/C. Min
অসুস্থ হলে করণীয়
অসুস্থ হলে ঘরে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে আইইডিসিআর৷ তবে মারাত্মক অসুস্থ হলে নিকটস্থ সদর হাসপাতালে যেতে হবে৷ রোগীকে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
সরকারের নির্দেশনা
কেউ যদি চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, ইতালি, ইরান এসব দেশে ভ্রমণ করে থাকেন এবং ফিরে আসার ১৪ দিনের মধ্যে যদি জ্বর-কাশি-গলা-ব্যথা-শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তাহলে অতি দ্রুত আইইডিসিআর-এর হটলাইন নাম্বারে যোগাযোগ করুন এবং কুয়েত-মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের পরামর্শ নিন৷
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত নতুন এই ভাইরাসটি সম্পর্কে যতটুকু যা তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এতটুকু বলা যায়- মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির৷ যার দেহে এই ভাইরাস ঢুকেছে, সে যাতে হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে সেটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারে, সে জন্যই এই মাস্ক৷ কিন্তু বাংলাদেশে কি এরই মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছে? এখন (১২ মার্চ) পর্যন্ত মাত্র তিনজন আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে৷ এরা আবার ভালোও হয়ে গেছে৷ এটা অবশ্য সরকারি হিসাব৷ তবে বেসরকারি হিসাব এরচেয়ে বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না৷ কারণ কেউ আক্রান্ত হলে কিংবা কেউ মরে গেলে, দেশে রোগটি নিয়ে এখন যে আতঙ্ক, তাতে খুব সহজে তা গোপন করা যাবে বলে মনে হয় না৷
রোগী নেই, তাহলে মাস্ক পরার এই হুজুগটা কেন? এর একটাই কারণ, আর সেটা হচ্ছে অজ্ঞতা৷ দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো জানেই না, এই রোগটা আসলে কি? কেন হয়, কিভাবে হয়, হলে কি করতে হয়? তবে মুখে মুখে যে বিষয়টা খুবই ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা হচ্ছে- এ রোগের কোন প্রতিষেধক নেই, এ রোগের কোন চিকিৎসাও নেই৷ আর এ কারণেই প্রবল আতঙ্ক৷ আতঙ্কটা হয়তো অমূলক নয়, কিন্তু তাই বলে কি এর কারণে আমাদের জীবনযাত্রাই পাল্টে যাবে? মানুষ কি তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহত করে ঘরে বসে থাকবে? তাতো আর সম্ভব নয়৷ গরীব দেশের ততোধিক গরীব মানুষ আমরা৷ দিন আনি, দিন খাই৷ একদিন বের না হলে সংসার চলবে কি করে৷ আতঙ্কের কারণে ক্ষুধা তো আর থেমে থাকবে না৷ তখন কি সরকার এই গরীব মানুষদের রুটি-রুজিতে কোন সাহায্য করবে? নাকি কিভাবে কনুই তুলে হাঁচি কাশি দিতে হবে, তা দেখানোর মাধ্যমেই মন্ত্রীগণ তাদের দায়িত্ব সারবেন?
করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ নতুন রোগ৷ আবার এমনও নয়, এটা কোন মৌসুমী রোগ, দিন কতক পরেই চলে যাবে৷ একবার যখন এসেছে, হয়তো থেকেই যাবে৷ মানুষ চেষ্টা করছে, হয়তো একে নিয়ন্ত্রণের উপায়ও খুঁজে পাবে৷ কিন্তু রোগটি শিগগিরই চলে যাবে বলে মনে হয় না৷ এইচআইভি, সার্স, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু- এই সব ভাইরাসের মতো এটিও হয়তো থেকে যাবে৷ আবার কে জানে, হয়তো স্মলপক্স ভাইরাসের মতো এটিকেও নির্মূল করা সম্ভব হবে৷ এ সবই ভবিষ্যতের কথা৷ কিন্তু বর্তমানের আতঙ্ককে দূর করবেন কি করে? আসলে আতঙ্ক একেবারে দূর হওয়ার নয়, সে চেষ্টাতে যাওয়ারও কোন দরকার নেই৷ বরং চেষ্টা থাকা দরকার আতঙ্ককে নিয়ন্ত্রণের, অপ্রয়োজনীয় আতংককে পরিহারের৷ বাড়তি আতঙ্ক কোন কাজের বিষয় নয়, তা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে৷ আর সে জন্যই দরকার সচেতনতার৷ জানা থাকা দরকার- কাকে আমরা ভয় পাচ্ছি, এ থেকে বাঁচতে কি আমরা করতে পারি৷ অথবা নতুন এই শত্রুকে আসলে কতটা ভয় পাওয়া দরকার৷
করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার ১০ কারণ
করোনাকে মহামারি ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ ফলে এই ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ থাকতেই পারে৷ তবে আতঙ্কিত সম্ভবত না হলেও চলবে, অন্তত ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামকে তাই বলেছেন নাভারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইগ্নাসিও লোপেজ গনি৷
ছবি: DW/S. Hossain
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমরা জানি
প্রথম এইডস রোগী ধরা পড়েছিল ১৯৮১ সালের জুন মাসে৷ তবে, সেই রোগের কারণ যে এইচআইভি ভাইরাস সেটা বুঝতে দুই বছরের বেশি সময় লেগেছিল৷ আর মানবদেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর, চীনে৷ আর সেই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাসটি শনাক্ত সম্ভব হয়৷ শুধু তাই নয়, প্রথম সংক্রমণের দশদিনের মাথায় ভাইরাসটির ধরন, উৎপত্তিসহ প্রায় সব তথ্য জানা সম্ভব হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Soeder
ভাইরাসটি শনাক্তের উপায় জানি আমরা
১৩ জানুয়ারি থেকে ভাইরাসটি শনাক্তের জন্য প্রয়োজনীয় টেস্ট সহজলভ্য হয়৷
ছবি: AFP/T. Kienzle
চীনে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে
চীনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে কড়াকড়ি এবং বিচ্ছিন্ন রাখার নীতি কাজ করেছে৷ দেশটিতে প্রতিদিনই নতুন সংক্রমণের হার কমছে৷ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে যেটা পরিষ্কার তা হচ্ছে ভাইরাসটি ছড়ালে তা নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকছে৷ ফলে সেটির সংক্রমণের পরিধি সীমিত রাখা সহজ৷
ছবি: Getty Images/AFP/Str
আশি শতাংশ সংক্রমণই হালকা ধরনের
৮১ শতাংশক্ষেত্রেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ টের পাওয়া যায়না বা খুব হালকা কিছু লক্ষণ টের পাওয়া যায়৷ তবে, ১৪ শতাংশ ক্ষেত্রে সংক্রমণের লক্ষণগুলো প্রবলভাবে ফুটে ওঠে এবং পাঁচ শতাংশক্ষেত্রে সেটি খুবই জটিল আকার বা প্রাণঘাতি হতে পারে৷ তবে, ভাইরাসটিতে মৃত্যুর সঠিক হার এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ এখন পর্যন্ত মৃত্যুর যে হারের কথা শোনা যাচ্ছে, প্রকৃত হার তারচেয়ে কম হতে পারে৷
ছবি: DW/S. Hossain
মানুষ সুস্থ হয়
এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে মূলত সনাক্তকৃত করোনা ভাইরাস রোগী এবং করোনা সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা থাকে৷ এসব সংখ্যা পর্যালোচনা করলে দেয়া যাচ্ছে আক্রান্ত যত মানুষ মারা যাচ্ছেন তারচেয়ে ১৩ গুণ বেশি মানুষ সুস্থ হচ্ছেন৷ আর আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যার মধ্যকার আনুপাতিক হার ক্রমশ বাড়ছে৷
ছবি: Getty Images/Afp/S. Supinsky
শিশুদের হালকা সংক্রমণ
এখন পর্যন্ত করোনা আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র তিন শতাংশের বয়স বিশ বছরের নীচে৷ আর ৪০ বছরের নীচে বয়সিদের মধ্যে মৃত্যুর হার মাত্র শুন্য দশমিক দুই শতাংশ৷ শিশুদের ক্ষেত্রে এই সংক্রমণের লক্ষণগুলো এতই হালকা হতে পারে যে তা হয়ত অনেকের নজরেই পড়বে না৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
সহজেই নিষ্কৃয় করা যায় এই ভাইরাস
এলকোহলযুক্ত জীবানুনাশক ব্যবহার করে মাত্র একমিনিটেই সার্ফেসে থাকা করোনা ভাইরাস নিষ্কৃয় করা যায়৷ পাশাপাশি সাবান এবং পানি ব্যবহার করে কিছুক্ষণ পরপর হাত ধুয়ে করোনা ভাইরাস থেকে অনেকটাই নিরাপদে থাকা যায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Khalil
বিশ্বব্যাপী তৎপর বিজ্ঞানীরা
করোনা ভাইরাস ছড়ানোর একমাসের মধ্যেই বিশ্বের নানা দেশে অবস্থানরত বিজ্ঞানী, গবেষকরা এই বিষয়ে শতাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন৷ আরো অনেক নিবন্ধ রিভিউয়ের অপেক্ষায় রয়েছে৷ অতীতে এধরনের মহামারী ছড়ানোর পর সাধারণত সেটা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য পেতে আরো অনেক বেশি সময় লাগতো৷
ছবি: picture-alliance/Pressebildagentur Ulmer
ভ্যাকসিনের প্রটোটাইপ প্রস্তুত
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য অন্তত আটটি প্রকল্প কাজ করছে৷ অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক এই ভাইরাস প্রতিরোধে সক্ষম ভ্যাকসিনের একটি প্রোটোটাইপও তৈরি করে ফেলেছে৷ এধরনের প্রোটোটাইপ শীঘ্রই মানবদেহে পরীক্ষা করা হবে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. McAvoy
এন্টিভাইরালও পরীক্ষা করা হচ্ছে
ভ্যাকসিন দীর্ঘমেয়াদে ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে যারা আক্রান্ত তাদের চিকিৎসা প্রদান জরুরী৷ করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহারের উপযোগী হতে পারে এমন আশিটির বেশি এন্টিভাইরালের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে৷ লেখক: নাভারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানী ইগ্নাসিও লোপেজ গনি
ছবি: picture-alliance/AP/Chinatopix
10 ছবি1 | 10
এই যে প্রত্যাশিত সচেতনতা, সেটা কিন্তু ততটা নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে৷ নেই কেন? নেই এ কারণে যে, সঠিক তথ্যগুলো মানুষের মধ্যে সেভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি৷ দায়িত্বটা প্রধানত সরকারের৷ সরকার সে কাজটি সেভাবে করতে পারেনি৷ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের একটা শাখা অবশ্য প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন করেছে৷ সে খবর পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিতও হয়েছে৷ কিন্তু দেশের কতজন মানুষ এখন নিয়মিত পত্রিকা পড়েন? টেলিভিশনেও টুকটাক দেখাচ্ছে৷ কিন্তু বিশ্বাসহীনতার কারণে টিভি সংবাদের প্রতিও তো মানুষের ততটা আগ্রহ আর নেই৷ এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ সম্পৃক্ত থাকেন সোশ্যাল মিডিয়াতে৷ এখানে সরকারী উদ্যোগে নিয়মিত সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন থাকতে পারতো৷ অথবা প্রতিদিন মোবাইলে করোনা ভাইরাস বিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দেয়া যেত৷ প্রচলিত পদ্ধতির প্রচারের চেয়ে অনেক কম খরচেই এটা করা সম্ভব হতো৷ ডিজিটাল বাংলাদেশের এনালগ আমলাতন্ত্র এসব পদ্ধতির কথা ভাবছে না৷
সরকার হটলাইন অবশ্য চালু করেছে৷ কিন্তু সেটা কোন শর্টকোডের মাধ্যমে হয়নি৷ বাংললিংকের গোটা কয়েক প্রচলিত নাম্বার দেওয়া হয়েছে৷ প্রথমে ছিল মাত্র চারটা নাম্বার, পরে নাকি আরও গোটা বার নাম্বার দেওয়া হয়েছে৷ ষোল কোটি মানুষের জন্য ১৬টি নাম্বার! একটা বেশিই কম হয়ে গেল না কি? ফলে কেউ ফোন করলে বেশিরভাগ সময়ই এনগেজড পাচ্ছেন৷ গণমানুষের মধ্যে প্রত্যাশিত সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারি এমন উদ্যোগকে অপ্রতুল বলাই যায়৷ অথচ এই মুহূর্তে সরকারের তো এটাই প্রধানতম দায়িত্ব ছিল৷ কোভিড-১৯ এর কোন প্রতিষেধক নেই, তাই আগে থেকে যে নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেয়া হবে- সে সুযোগ নেই৷ এর কোন চিকিৎসা জানা নেই, তাই রোগটির প্রকোপ শুরু হলে যে চিকিৎসা দেওয়া হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখারও কোন প্রশ্ন ওঠছে না৷ তাহলে এই মুহূর্তে করণীয় কি? করণীয় একটাই, তা হচ্ছে- সকল স্তরের মানুষের মধ্যে নতুন এই রোগটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি করা৷ মানুষ যেন জানতে পারে তাকে কি করতে হবে, আর কি করা যাবে না৷ সেটা কি হচ্ছে? না, হচ্ছে না৷ যদি হতো তাহলে আর সব মানুষ পাগলের মতো মাস্কের পিছনে দৌড়াতো না৷ সাবান দিয়ে হাত ধুলেই যেখানে চলে, সেখানে তিনচারগুণ দাম দিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনার জন্য মারামারি করতো না৷
লেখার শুরতে বলছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ার কথা৷ এটা ঘটনা বলি৷ এর মধ্যে একটা মেসেজ পেলাম, একজন একটা পরিসংখ্যান পাঠিয়েছে৷ সেখানে দেখানো হয়েছে ২০২০ সালের প্রথম দুই মাসে পৃথিবীতে কোন রোগে কত মানুষ মারা গেছে৷ হিসাবটা এরকম: ক্যান্সারে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪১ জন, ধূমপানে ৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৯৮ জন, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭১ জন, এইচআইভি'র কারণে ২ লাখ ৪০ হাজার ৯৫০ জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৯ জন, আত্মহত্যায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯৬ জন, ম্যালেরিয়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৮৪ জন, ফ্লু বা সাধারণ ঠান্ডায় ৬৯ হাজার ৬০২ জন এবং করোনা ভাইরাসে ২ হাজার ৩৬০ জন মারা গেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ার সব তথ্য নাকি বিশ্বাস করতে নেই, যাচাই করে নিতে হয়৷ সে কাজটাও আমি করেছি৷ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে যেয়ে চেক করেছি৷ কোন রোগে বছরে কত মানুষ মারা যায় তার যে হিসাব সেখানে আছে, তাতে সংখ্যার খুব একটা তারতম্য দেখা যায়নি৷ তাহলে দাঁড়ালোটা কি? যে সকল রোগের খুবই ভালো চিকিৎসা আছে, যেমন ম্যালেরিয়া, তাতেও এই দুই মাসে করোনার চেয়ে প্রায় ৬০ গুণ মানুষ বেশি মারা গেছে! সাধারণ যে ফ্লু, যেটা দুনিয়ার সব পরিবারেই কারও না কারও অন্তত একবার করে হয়েছে, সেটিতেও করোনার চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি মানুষ মারা গেছে!
এমন একটা হিসাব জানার পরও কি করোনা নিয়ে মানুষের আতঙ্ক তেমন একটা কমবে? না, কমবে না৷ কারণ ওই একটাই, রোগটি নতুন৷ এর সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত কেউ জানেন না৷ অচেনা আতঙ্ক একটু বেশিই ভীতিকর হয়ে থাকে৷ বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এরই মধ্যে জানিয়েছেন, এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বড়জোর ৩ শতাংশের মত মানুষ মারা যায়৷ তথ্যটি অনেকেই জানেন৷ তারপরও আতঙ্ক কমছে না৷ কমছে না এ কারণে, আক্রান্ত হলে আমি যে ওই তিন শতাংশের মধ্যে থাকব না- সে গ্যারান্টি আমাকে কে দেবে?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
করোনায় বাংলাদেশের উদ্যোগ
করোনা ভাইরাসকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ গত ৮ মার্চ বাংলাদেশেও প্রথম এই ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে৷ করোনা ভাইরাসের প্রভাব এবং পদক্ষেপগুলো দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS/A. I. Damanik
উহান ফেরত
করোনা ভাইরাসের সূত্রপাত হয় চীনের উহান নগরীতে৷ একটা পর্যায়ে শহরটিকে কার্যত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে দেশটির সরকার৷ সেখানে আটকা পড়ে কয়েকশো বাংলাদেশি৷ তার মধ্যে পয়লা ফেব্রুয়ারি বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে ৩১২ জনকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনে সরকার৷
ছবি: A. Goni
কোয়ারেন্টাইনে ১৪ দিন
উহান ফেরতদের বিমানবন্দর থেকে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরা আশকোনা হজ ক্যাম্পে৷ সেখানে তারা কোয়ারেন্টাইনে থাকেন৷ ১৪ দিন পর সবাই সুস্থ অবস্থায়ই বাড়ি ফিরে যান৷ তাদেরকে আরো দশদিন নজরদারিতে রাখে সরকার৷
ছবি: Privat
প্রথম করোনা শনাক্ত
চীনের উহান থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার পর থেকে নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিং করতে থাকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআর৷ এর মধ্যেই আট মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তিনজনকে কোভিড ১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করার ঘোষণা দেন পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা৷
ছবি: Privat
ইটালি থেকে বাংলাদেশে
চীনের বাইরে কোরোনার প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে ইটালি৷ বাংলাদেশে আক্রান্ত তিনজনের দুজনই এসেছেন এই দেশটি থেকে৷ তাদের একজনের সংস্পর্শে এসে পরিবারের আরেক নারী সদস্য আক্রান্ত হন৷ তবে তাদের একজন এরইমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন৷ আরেকজনও করোনামুক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর৷
ছবি: picture-alliance/S. Gombert
মুজিববর্ষের আয়োজনে কাটছাঁট
করোনা আক্রান্ত তিনজনকে যেদিন শনাক্ত করা হল সেদিনই প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ রাতে আসে মুজিববর্ষের ১৭ মার্চের উদ্বোধনী আয়োজন সীমিত আকারে করার ঘোষণা৷ আসছেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীসহ বিদেশি অতিথিরাও, জানান মুজিববর্ষ উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী৷
ছবি: bdnews24.com/PID
বাজারে প্রভাব
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শণাক্তের পর বাজারে রাতারাতি তার প্রভাব পড়ে৷ মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের অভাব দেখা দেয়৷ বেড়ে যায় দাম৷ পরবর্তীতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান শুরু করে৷ সরকার থেকে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম বেঁধে দেয়া হয়৷
ছবি: DW/S. Hossain
ক্রিকেটে প্রভাব
বাংলাদেশে করোনা শনাক্তের একদিন পরই ছিল জিম্বাবোয়ের বিপক্ষে টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচ৷ এই ম্যাচে একজন দর্শকের জন্য শুধু একটি টিকেট কেনার সুযোগ দেয় বিসিবি৷ মাঠে দর্শকের উপস্থিতিও ছিল কম৷ পরে বিসিবি মুবিজববর্ষ উপলক্ষে বিশ্ব একাদশ বনাম এশিয়া একাদশের মধ্যে দুইটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ও কনসার্টের আয়োজনও স্থগিত করে৷
ছবি: DW/S. Hossain
প্রবাসীদের পরিস্থিতি
সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, ইটালি ছাড়া অন্য কোন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হননি৷ দিল্লিতে উহান থেকে আগত ২৩ জন বাংলাদেশি দিল্লি শহর থেকে ৪০ মাইল দূরে কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন৷ তাদের বিষয়ে যোগাযোগ রাখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
ছবি: A. Goni
যাত্রীদের পরীক্ষা
দেশির তিনটি বিমান বন্দর, দুটি সমুদ্র বন্দর, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ও বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশন দিয়ে আগত যাত্রীদের স্ক্রিনিং বা শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সরকার৷ কোভিড ১৯ আক্রান্ত সন্দেহে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে ভাইরোলজি ল্যাবরেটরিতে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMAPRESS/A. I. Damanik
কী করবেন
যেসব দেশে করোনা সংক্রমণ ঘটেছে সেখান থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসা যাত্রীদের স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ দিয়েছে আইইডিসিআর৷ কারো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে প্রতিষ্ঠানের হটলাইনে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/Belga Mag
হটলাইন নাম্বার
মোট ১৩ টি হটলাইন চালু করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ নাম্বার: ০১৪০১১৮৪৫৫১, ০১৪০১১৮৪৫৫৪, ০১৪০১১৮৪৫৫৫, ০১৪০১১৮৪৫৫৬, ০১৪০১১৮৪৫৫৯, ০১৪০১১৮৪৫৬০, ০১৪০১১৮৪৫৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৬৮, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১, ০১৯৩৭১১০০১১৷