করোনা সংক্রমিত হলে তা শরীরে কতটা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে তা নির্ভর করে মানুষের রক্তের ধরনের উপরেও৷ এমন একটি সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন ইউরোপের একদল গবেষক৷ নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল মেডিসিনে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
করোনায় আক্রান্ত হলেও অনেকের শরীরের কোনো লক্ষণই প্রকাশ পায় না৷ আবার কেউ কেউ সাধারণ সর্দি, জ্বরে ভুগেই সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন৷ কারো কারো ক্ষেত্রে মারাত্মক শারীরিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটছে মৃত্যু৷ মানুষের শরীরে একই ভাইরাসের এত ধরনের আচরণ কেন? এর সঙ্গে কি রক্তের ধরনের কোনো সম্পর্ক আছে?
জার্মানি, ইটালি, স্পেন, ডেনমার্ক সহ আরো কয়েকটি দেশের গবেষকরা মিলে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন৷ তারা বিভিন্ন দেশের কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের উপর পরীক্ষা চালিয়েছেন৷ তাদের গবেষণার ফলাফল বলছে আক্রান্তদের শারীরিক ঝুঁকির মাত্রা কেমন হবে তার সঙ্গে রক্তের টাইপ বা ধরনের একটি সম্পর্ক রয়েছে৷ যাদের রক্তের ধরন ‘এ’ তারা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন৷
যেভাবে মানবদেহে আক্রমণ করে করোনা ভাইরাস
শুধু ফুসফুস নয় বরং করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু, মস্তিষ্ক, কিডনি, ধমনি এবং ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ ঘটতে পারে মৃত্যু৷
ছবি: picture-alliance/dpa/imageBROKER
হৃৎপিণ্ড
বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে করোনা ভাইরাসের কারণে হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ হৃদরোগ বা উচ্চ রক্তচাপ থাকা ব্যক্তিদের কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর হার অনেক বেশি৷ কিন্তু যাদের হৃদরোগ নেই তারাও আক্রান্তের পর হৃৎপিণ্ডের পেশির কোষ মারা যায়৷ তবে ভাইরাসের আক্রমণে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাকি ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের তৈরি রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/imageBROKER
ফুসফুস
কোভিড-১৯ এ ফুসফুস সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ ফুসফুস জটিলতাতেই বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ যারা সুস্থ হয়ে উঠেন তাদের ফুসফুসও দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ কারণ, সুস্থদের ফুসফুসে ঘোলাটে সাদা মেঘের মত বস্তু দেখতে পেয়েছেন চীনের গবেষকরা৷ যেটা ফুসফুসের স্থায়ী ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Gollnow
শ্বাসকষ্ট
ফুসফুসের এই অবস্থা হলে রক্তে অক্সিজেন পৌঁছাতে বাধা পাবে৷ ফুসফুস আড়ষ্ট হয়ে পড়বে এবং শ্বাসপ্রশ্বাস ছোট ও দ্রুত গতির হবে৷ ফলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট এবং শুকনো কফ দেখা দেবে৷ ফুসফুসের কোষ একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটা আর ঠিক হয় না৷
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
স্নায়ুতন্ত্র
কোভিড-১৯ আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের স্বাদ এবং ঘ্রাণ শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে৷ সংক্রমণের একেবারে শুরুর দিকেই এ উপসর্গ দেখা দেয়৷ সাধারণ ফ্লুর ক্ষেত্রে যেটা রোগের চূড়ান্ত পর্যায়ে হয়৷ ঘ্রাণ শক্তি বা অলফ্যাক্টরি নার্ভ অনুনাসিক ঝিল্লি থেকে খুলির হাড়ের মাধ্যমে সরাসরি মস্তিষ্কে পৌঁছায়৷
ছবি: Colourbox
ধমনি
জুরিখের একদল প্যাথলোজিস্ট করোনায় মারা যাওয়া কয়েকজনের ময়নাতদন্ত করে দেখেছেন কারো কারো রক্তনালি এবং লাসিকা গ্রন্থি ফুলে গিয়ে সেগুলোতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ যার ফলে হৃৎপিণ্ড, কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এক সঙ্গে বিকল হয়ে মানুষ মারা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Burgi
মস্তিষ্ক
মার্স এবং সার্স ভাইরাসের সময়ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা গেছে৷ নতুন করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও আক্রান্ত অনেকের খিচুনি এবং মৃগীরোগের চিকিৎসা দিতে হয়েছে৷ এ কারণেই হয়তো আক্রান্ত অনেকের মধ্যে কোনো পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়৷ তবে করোনা ভাইরাসের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ার বিষয়ে এখনো পরিষ্কার কিছু জানা যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Prefeitura Manaus/I. Anne
কিডনি
কোভিড-১৯ আক্রান্ত অনেকের শরীরে মারাত্মক নিউমোনিয়ার লক্ষণ থাকে এবং ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন হয়৷ ফুসফুসে জমা তরল বের করতে ওই রোগীদের যে ওষুধ দেওয়া হয় তাতে তাদের পুরো শরীর থেকে তরল বের হয়ে যায়৷ ফলে কিডনিতে রক্ত সরবরাহ কমে যায় এবং কিডনি ঠিকমত কাজ করতে না পেরে অকেজো হয়ে পড়ে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Murat
রক্তপিণ্ড
কোভিড-১৯ এ গুরুতর আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে অনেক সময় রক্ত জমাট বেধে রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়৷ এটার কারণেও অনেক সময় কিডনিতে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে এ অঙ্গটি অকেজো হয়ে পড়ে৷
করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের ত্বকও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ অনেক দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ত্বকে ক্ষত বা র্যাশ সৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে৷ রক্ত জমাট বাধার কারণে ত্বকের নিচে এ ধরনের র্যাশ দেখা যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Wessels
9 ছবি1 | 9
মানুষের রক্তকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়: এ, বি, এবি এবং ও৷ গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী ‘এ’ রক্ত বহনকারীদের কোভিড-১৯ এ মারাত্মক ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় ৪৫ ভাগ বেশি৷ অন্যদিকে ‘ও’ রক্তধারীদের এমন ঝুঁকি ৩৫ ভাগ কম৷ গবেষকরা বলছেন এই রক্ত বহনকারীরা কিছু বিশেষ প্রোটিনকে সহজে শনাক্ত করতে পারে৷ বিজ্ঞানীদের ধারণা করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে একই ধরনের কিছু প্রোটিন তারা চিহ্নিত করতে পারে৷ যে কারণে ঝুঁকি কম থাকে৷ বি এবং এবি রক্ত বহনকারীদের করোনা সংক্রমণে ঝুঁকির মাত্রা অন্য দুটির মাঝামাঝি৷
গবেষকদের একজন নরওয়ের ওসলো বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ড. টম কার্লসেন৷ তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘কোভিড ১৯ এ মারাত্মকভাবে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে রোগটি কী ধরনের আচরণ করে এই গবেষণার ফলাফল তার কিছু নির্দিষ্ট ধারণা দিচ্ছে৷’’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ এর পরিচালক ও জীন বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিস কলিনস তার এক ব্লগে লিখেছেন, কিছু জীনগত পরীক্ষা এবং ব্যক্তির রক্তের ধরনের উপর নির্ভর করে কারা বেশি ঝুঁকিতে আছেন তা বের করতে গবেষণার এই তথ্যগুলো সহায়তা করবে৷