প্রায় এক বছর দাপট দেখানোর পর ক্রমশ নিয়ন্ত্রণে আসছে করোনা৷ সংক্রমণ ও দৈনিক মৃতের সংখ্যা কোনো কোনো দিন থাকছে শূন্যের কাছে৷ যদিও গ্রাফের ওঠানামা চলছেই৷ বাংলা-সহ গোটা ভারত কি বিপন্মুক্ত হবে অবশেষে?
বিজ্ঞাপন
গত বছর জানুয়ারিতে ভারতে প্রথম করোনা আক্রান্তের হদিস পাওয়া যায়৷ তারপর গোটা দেশে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়েছে মহামারীর জাল৷ অজানা ভাইরাসের সামনে অসহায় মানুষ মারা গিয়েছে৷ সংক্রমণ রুখতে করতে হয়েছে লকডাউন৷ গোটা বিশ্বের মতোই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারত৷ নতুন বছরের মুখেই দেখা যাচ্ছিল, ভাইরাস সংক্রমণের হার ক্রমশ কমছে৷ ফেব্রুয়ারির গোড়ায় যেন কাঙ্খিত সময় এসে উপস্থিত৷ এপ্রিলের পর প্রথম মৃত্যুহীন দিন দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ৷ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দুই দিন কলকাতায় কেউ মারা যাননি৷ ৫ ফেব্রুয়ারি রাজ্যে আক্রান্ত ১৯৪ জন, মৃত দুই জন৷ পরের দিন আক্রান্ত ১৯৭, কলকাতায় কেউ মারা যাননি৷ ৭ ফেব্রুয়ারি আক্রান্ত হয়েছেন ১৯৩ জন, মারা যান পাঁচ জন৷ ৮ ফেব্রুয়ারি আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে, ১১৯ জন৷ জেলায় দুই জনের মৃত্যু হলেও কলকাতায় শূন্য৷
কিছু দিন ধরে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে শুধু কমছে না, ভারতের রাজ্যগুলো মোটের উপর একই ছবি৷ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, গত দিন দশেকে সাতটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে করোনায় কারো মৃত্যু হয়নি৷ আর ৮ ফেব্রুয়ারি দেখা গিয়েছে, ১৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মারণ ভাইরাসে মৃত্যু শূন্য৷ দিল্লিও পেয়েছে মৃত্যুহীন দিন৷ এই পরিস্থিতি স্থায়ী হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে৷ নীতি আয়োগের প্রধান ভিকে পলের বক্তব্য, ‘‘করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমছে, এটা খুবই স্বস্তির খবর৷ তবে সেজন্য অসতর্ক হলে চলবে না৷ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে৷’’ এই সব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে একটি সঙ্গত জিজ্ঞাসা, আমরা কি করোনা ভাইরাসকে অবশেষে পরাজিত করতে পারলাম?
সংক্রমণ যতটা হতে পারত, ততটা হয়নি: ডা. অমিতাভ নন্দী
ইউরোপ ও আমেরিকায় যখন করোনার নয়া স্ট্রেন আবার তাণ্ডব চালাচ্ছে, ফের লকডাউন করতে বাধ্য হচ্ছে তারা, সেখানে ভারতে সাফল্যের কারণ কী? এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উঠে আসছে, তা হল গোষ্ঠীগত প্রতিরোধ ক্ষমতা৷ অর্থাৎ একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজে থেকেই প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে৷ সে কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে৷ এছাড়া কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে দেশের একটা বড় অংশের মানুষ যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে৷ এই নিয়মানুবর্তিতা কাজে লেগেছে৷ ডাব্লুএইচও-র প্রাক্তন পরামর্শদাতা ও সিনিয়র ভাইরোলজিস্ট ডাক্তার অমিতাভ নন্দী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সবাই মাস্ক পরেননি৷ স্যানিটাইজার ব্যবহার করেননি৷ এটা যেমন ঠিক, তেমন অনেকে করেছেন৷ যদি ধরে নিই ৫০ শতাংশ মানুষও করেছেন, তার সুফল এখন পাওয়া যাচ্ছে৷ সংক্রমণ যতটা হতে পারত, ততটা হয়নি৷ এখন তাই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে৷ তবে এতে আত্মতুষ্ট হওয়ার কারণ নেই৷ পরিস্থিতি যে কোনো দিন বদলাতে পারে৷’’
ভাইরাস বিশেষজ্ঞের এই মন্তব্যের সত্যতা মিলছে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে৷ গ্রাফের ওঠানামায় নিশ্চিন্তে থাকার উপায় নেই৷ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হিসেব অনুযায়ী, বুধবার দেশে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৬৭ জন৷ কিন্তু বৃহস্পতিবারের হিসেবে ১২ হাজার ৯২৩ জন৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, উপসর্গ না থাকলে আরটিপিসিআর পরীক্ষা করানো হয় না৷ ফলে উপসর্গহীন করোনা আক্রান্তের হিসেব পাওয়া সম্ভব নয়৷ তাই আক্রান্তের সংখ্যা দেখে স্বাস্থ্যবিধি পালনের ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখালে ভুল হবে৷ ইতিমধ্যে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে টিকাকরণ৷ তার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার আগে টিকাকরণ সম্পন্ন হয়েছে বলা যাবে না৷ তাই আক্রান্তের হার কমার সঙ্গে টিকা দেওয়ার সম্পর্ক না খোঁজাই ভালো৷ ভাইরোলজিস্ট অমিতাভ নন্দীর বক্তব্য, ‘‘এখন কোভিডে সংক্রমণ কমেছে মানে আবার হঠাৎ বেড়ে যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ যে কোনো সময় লোকাল স্ট্রেন তৈরি হতে পারে৷ তখন ইউরোপের পরিস্থিতি আমাদের দেশে হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷’’
করোনার টিকাদানে কে কতটা এগিয়ে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে করোনার টিকাদান৷ সেই দৌড়ে এগিয়ে উন্নত দেশগুলোই৷ উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশ থাকলেও কোনো ‘অনুন্নত দেশ’ এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি৷ বিভিন্ন দেশের টিকা কার্যক্রমের পরিসংখ্যান জেনে নিন ছবিঘরে৷
ছবি: Fedja Grulovic/REUTERS
ইসরায়েল
করোনার টিকা কার্যক্রমে সবার চেয়ে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে ইসরায়েল৷ বায়োনটেক-ফাইজারের টিকা দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু করেছে তারা ১৯ ডিসেম্বর থেকে৷ পাঁচ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে৷ অর্থাৎ, ১৭ ভাগ জনগোষ্ঠীকে এরই মধ্যে টিকার আওতায় এনেছে ইসরায়েল, যা সবার চেয়ে বেশি৷
ছবি: Tsafrir Abayov/AP/picture alliance
সংযুক্ত আরব আমিরাত
পাঁচ জানুয়ারি পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সোয়া আট ভাগের বেশি মানুষকে করোনার টিকা দিতে পেরেছে৷ মোট আট লাখ ২৬ হাজার ডোজ টিকা দিয়েছে তারা এই সময়ের মধ্যে৷
ছবি: Reuters/S. Kumar
বাহরাইন
পারস্য উপসাগরীয় দেশ বাহরাইনের প্রতি ১০০ জনের চারজন এরই মধ্যে টিকা পেয়েছেন৷ এক্ষেত্রে ইসরায়েল ও আরব আমিরাতের পরেই তাদের অবস্থান৷ মোট টিকাপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যা ৬৮ হাজারের বেশি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Jamali
যুক্তরাষ্ট্র
করোনার টিকা বিতরণের মোট সংখ্যায় সবার উপরে যুক্তরাষ্ট্র৷ ৫৩ লাখের বেশি মানুষ এরই মধ্যে টিকা নিয়েছেন৷ কিন্তু শতকরা হিসেবে ৬ জানুযারি পর্যন্ত করোনার টিকার আওতায় এসেছেন এক দশমিক ছয় শতাংশ৷
ছবি: Alex Edelman/AFP
যুক্তরাজ্য
আট ডিসেম্বর বায়োনটেক ও ফাইজারের ভ্যাকসিন দিয়ে করোনার টিকা কার্যক্রম চালু করে যুক্তরাজ্য৷ তাদের হালনাগাদ তথ্যটি ২৭ ডিসেম্বরের৷ সেই হিসাবে সাড়ে নয় লাখ ডোজ টিকা বিতরণ করেছে তারা, যা মোট জনগোষ্ঠীর সোয়া এক ভাগের বেশি৷
ছবি: Danny Lawson/empics/picture alliance
চীন
গত সপ্তাহে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি সিনোফার্মের টিকার আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দিয়েছে চীন৷ শেষ ধাপের ট্রায়ালে আছে আরো কয়েকটি৷ তবে অনুমোদনের আগে পরীক্ষা পর্যায়েই সেসব টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে ৪৫ লাখ মানুষের দেহে৷ বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশটিতে শতকরা হিসাবে সেটি একভাগেরও কম৷ আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা দেশটির৷
ছবি: Zhang Yuwei/AP/picture alliance
রাশিয়া
ট্রায়াল শেষের আগেই বিশ্বে সবার আগে নিজেদের উদ্ভাবিত টিকার অনুমোদন দিয়ে আলোচনায় আসে রাশিয়া৷ ৫ জানুয়ারির ঘোষণা অনুযায়ী দেশটি এরই মধ্যে ১০ লাখ মানুষকে স্পুটনিক ফাইভ নামের সেই টিকা দিয়েছে, যা মোট জনগোষ্ঠীর এক ভাগের কম৷
ছবি: Natacha Pisarenko/AP Photo/picture alliance
জার্মানি
২৭ ডিসেম্বর থেকে ইউরোপের দেশগুলো একজোটে বায়োনটেক-ফাইজারের টিকাদান কার্যক্রম শুরু করে৷ তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছে জার্মানি৷ পাঁচ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশটিতে তিন লাখ ৬৭ হাজারেরও বেশি মানুষ টিকা পেয়েছেন৷ জনসংখ্যার হিসাবে এটি এক ভাগের প্রায় অর্ধেক৷
ছবি: Fabrizio Bensch/REUTERS
ইটালি
মোট সংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও জনসংখ্যার শতকরা হিসাবে জার্মানির চেয়ে ইটালি কিছুটা এগিয়ে৷ করোনায় ইউরোপে সবচেয়ে বেশি ভোগা দেশটিতে এখন পর্যন্ত তিন লাখ সাত হাজার ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে, যা মোট জনগোষ্ঠীর দশমিক পাঁচ-এক ভাগ৷
ছবি: Matteo Bazzi/REUTERS
ক্যানাডা
১৬ ডিসেম্বর থেকে টিকা দেওয়া শুরু করে ক্যানাডা৷ এক লাখ ৬৩ হাজার মানুষ এখন পর্যন্ত সেখানে করোনার প্রতিষেধক পেয়েছেন, যা জনসংখ্যার দশমিক চার-তিন ভাগ৷
ছবি: Adrian Wyld/REUTERS
স্পেন
৫ জানুয়ারি পর্যন্ত স্পেনে এক ৩৯ হাজার ডোজ ভ্যাকসিন বিতরণ করা হয়েছে, যদিও জনসংখ্যার শতকরা হিসেবে তা উল্লেখযোগ্য নয়৷
ছবি: Alvaro Calvo/Government of Aragon/Getty Images
বাকি বিশ্ব
ইউরোপের সব দেশেই করোনার টিকা দেয়া শুরু হয়েছে৷ সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশও তড়িঘড়ি করেই কার্যক্রম শুরু করেছে৷ লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে আর্জেন্টিনা এরই মধ্যে ৫২ হাজার ডোজ বিতরণ করেছে৷ তবে এই দৌড়ে এখনও যোগ দিতে পারেনি সিংহভাগ উন্নয়নশীল ও কোনো অনুন্নত দেশ৷ সব মিলিয়ে বিশ্বের জনসংখ্যার তুলনায় মাত্র দশমিক দুই ভাগ টিকা বিতরণ করা হয়েছে৷