বাংলাদেশকে করোনার দুইটি ঢেউ অনেকটাই বিপর্যস্ত করে দিয়েছে৷ প্রথম ঢেউটি ছিল গত বছর উহান করোনার৷ আর দ্বিতীয় ঢেউটি এবছর ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের৷ প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ কি করোনা ঠেকাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছিল?
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ৷ জুলাই মাসে করোনা সংক্রমণ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়৷ এরপর কমে আসলেও এখন আবার করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে৷ বাংলাদেশে এপর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ১৭ হাজার ২৭৮ জন৷ শনাক্ত হয়েছেন ১০ লাখ ৭১ হাজার ৭৭৪ জন৷ এখন প্রতিদিন মৃত্যু দুইশ’র উপরে৷ আর এই মাসেই করোনায় সর্বোচ্চ সংখ্যায় মারা যাচ্ছেন৷
বাংলাদেশে করোনা টেস্টের ওপর নির্ভর করছে শনাক্তের সংখ্যা৷ এখন প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়৷ তবে এই টেস্ট বাড়ানো হলে সঠিক পরিস্থিতি বোঝা যেত৷
ডা. মো. শহীদুল্লাহ
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার আগেই করোনা ঠেকাতে বিমান ও স্থল বন্দরে বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ আর চলতি বছরের মে মাসে সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট সনাক্ত হওয়ার পরও ভারতের সাথে সীমান্ত বন্ধসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়৷ কিন্তু কাজ হয়নি৷ করোনা ঠেকানো যায়নি৷ আইসোলেশন, কোয়ারান্টিন ঠিকমত না করায় এই পরিস্থিতি হয়েছে৷ গত বছর করোনা ছিলো ঢাকা ও শহর কেন্দ্রিক৷ কিন্তু এবার ডেল্টা ভেরিয়েন্ট গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে৷ এখন শহরের চেয়ে গ্রামে সংক্রমণ বেশি৷ আর গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে পরিস্থিতি অনেক খারাপ৷
করোনার টিকা নিয়েও বাংলাদেশকে হোঁচট খেতে হয়েছে৷ ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশেকে অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ টিকা দেয়ার চুক্তি করলেও শেষ পর্যন্ত তারা ৭০ লাখের বেশি টিকা দেয়নি৷ ফলে গত ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়ার গণটিকা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়৷
ডা. কামরুল ইসলাম
এই করোনা ঠেকাতে গত বছর টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি দিয়ে সব কিছু বন্ধ রাখা হয়৷ আর এবারও লকডাউন ও কঠোর লকডাউ দেয়া হচ্ছে৷ দুই সপ্তাহের কঠোর লকডাউন শেষ হয়েছে ১৪ জুলাই৷ কিন্তু এই এই লকডাউনও সঠিকভাবে করা হয়নি৷ আর স্বাস্থ্যবিধি মানাতে ও মাস্ক পরাতে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা কম৷ ফলে করোনা ছড়াচেছ দ্রুত৷
তাই বিশ্বের অনেক দেশ করোনা পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এলেও বাংলাদেশে দীর্ঘায়িত হচ্ছে৷
জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ বলেন,“১৫ জুলাই থেকে আমরা আরও দুই সপ্তাহের লকডাউনের প্রস্তাব করেছিলাম৷ কিন্তু উল্টো শিথিল করা হয়েছে৷ এতে করোনা আরো ছড়িয়ে পড়বে৷ আর লকডাউন এর আগে ঢিলেঢালা হওয়ায় সংক্রমণ কমানো যায়নি৷”
বিএসএমইউ এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন,“কোনো দেশই করোনা ঠেকাতে পারেনি৷ বাংলাদেশের পক্ষেও সম্ভব ছিল না৷ তবে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে আমরা এখনো করোনা বিদায় করতে পারছি না৷”
তিনি বলেন,“লকডাউন, ভ্যাকসিন, চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের ব্যবস্থাপনার সংকট এবং সমন্বয়ের অভাব শুরু থেকেই আছে৷ আছে করোনার সময় স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি৷ ফলে বাংলাদেশ করোনা থেকে বের হতে পারছে না৷”
ডা. মো শহীদুল্লাহ
তার মতে, বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে লকডাউন পুরোপুরি সম্ভব না৷ গত ঈদে এক কোটি মানুষ মহানগর থেকে গ্রামে গেল৷ ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না৷’’
এই বৈশ্বিক মহামারি পৃথিবীর কোনো দেশই ঠেকাতে পারেনি৷ তবে সঠিক এবং সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর ক্ষয় ক্ষতি অনেক কমিয়ে আনা যেত বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী৷ তিনি বলেন,“আমরা বিজ্ঞানসম্মতভাবে এটা মোকাবেলার চেষ্টা করিনি৷ আমরা কোনো পরিকল্পনা করিনি৷ এপিডেমিক প্রজেকশন করতে হয় তা আমরা করিনি৷ ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা দীর্ঘায়িত হচ্ছে৷ যেভাবে চলছে তাতে বাংলাদেশ ঠিক কবে করোনা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে তা বলা কঠিন৷”
তবে জাতীয় পরামর্শক কমিটির প্রধান ডা. মো শহীদুল্লাহ মনে করেন,“বাংলাদেশ যে খুব খারাপ করেছে তা নয়৷ ভারত, ব্রাজিলসহ অনেক দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের পারফরমেন্স তত খারাপ না৷ তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা করা গেলে পরিস্থিতি আরো ভাল করা সম্ভব ছিল৷’’
আর বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ মনে করেন,“ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এর চেয়ে আর ভালো কিছু করা সম্ভব নয়৷ এখানকার মানুষ মনে করে তারা করোনায় নয়, না খেয়ে মারা যাবেন৷ তাই করোনা ততটা গুরুত্ব পাচ্ছে না রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কাছে৷”
করোনা: সরকারের অঙ্গীকার, বাস্তবতা ও অব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই সরকারের নানা অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে৷ অনেক ক্ষেত্রে কথা ও কাজের মিল থাকেনি, কেন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে সেটি বোঝাও দুরুহ হয়েছে অনেক সময়৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
ছবি: Harun-Or-Rashi/Zuma/picture alliance
‘প্রস্তুতির ঘাটতি নেই’
গত বছরের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে৷ তখন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই৷ অথচ সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে দেশের চিকিৎসা খাতে চরম অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়৷ করোনায় সংক্রমিত ছাড়া অন্য রোগীদেরও চিকিৎসা বঞ্চিত হওয়ার চিত্র উঠে আসে গণমাধ্যমে৷ এমনকি করোনাকালীন চিকিৎসা সরঞ্জামের কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতির খবরও বেরোয়৷
ছবি: bdnews24.com
ছুটি ও লকডাউন বিড়ম্বনা
করোনা সংক্রমণ রোধে বিভিন্ন দেশ যখন লকডাউন আরোপ করে, বাংলাদেশ সেসময় সরকারি ছুটি ঘোষণা করে৷ এতে দেখা দেয় চরম বিশৃঙ্খলা৷ এরপরও কয়েক দফা কখনো বিধিনিষেধ আরোপ, কখনো শিথিলতা চলতে থাকে৷ ‘লকডাউনে’ শ্রমঘন শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে কিন্তু বন্ধ থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ গণপরিবহন বন্ধ থাকে, চলে ব্যক্তিগত যান৷ ঈদযাত্রায় ফেরিঘাটে পদপৃষ্ঠ হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
‘করোনা দূর হয়ে যাবে’
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কেনা টিকা দিয়ে সাত ফেব্রুয়ারি টিকাদান কর্মসূচি চালু করে সরকার৷ সেসময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘‘আমরা আশা করছি করোনা ভাইরাস দূর হয়ে যাবে। ফাইনাল ব্লো-টা আমরা দেবো ভ্যাকসিনের মাধ্যমে৷’’ বাস্তবতা হলো, ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় কয়েক মাসের মধ্যেই টিকা নিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ৷
ছবি: Rashed Mortuza/DW
দ্বিতীয় ডোজের অনিশ্চয়তা
দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ পাঠানোর পর ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। অন্য কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি না থাকায় ২৫ এপ্রিল দেশে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। যারা কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নেন তাদের মধ্যে ১৫ লাখ যথাসময়ে দ্বিতীয় ডোজ পাননি৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘সব ব্যবস্থা আছে’
করোনা সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষিতে গত ১১ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে কথা হয়েছে, তারা যেন তাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখে। হাসপাতালে যে বেড বরাদ্দ ছিল, সেগুলো আবারও প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে৷ এছাড়া চিকিৎসার জন্য যা লাগে, সব ব্যবস্থা করা আছে৷”
ছবি: bdnews24.com
তবু আইসিইউ সংকট
বাসস্তবতা হলো, করোনা সংক্রমণ শুরুর দেড় বছর পরও দেশের শতকরা ৫২ ভাগ কোভিড হাসপাতালে আইসিইউ নেই৷ আইসিইউ সুবিধা নেই এমন হাসপাতালের ৩৫টিই আবার ঢাকার বাইরের জেলা সদরগুলোতে৷ এরমধ্যে সারাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় ঢাকার বাইরের জেলা ও গ্রামে করোনা চিকিৎসা নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে৷ কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন সংকটে রোগীরা মৃত্যুবরণ করছেন৷
ছবি: bdnews24
বাজেট ব্যবহারে অক্ষমতা
৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, “বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ কম- এটা বাড়াতে হবে। ...যদি আমরা ব্যয় না বাড়াই, লোকবল, যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা না করি, হাসপাতালের ব্যবস্থা না করি, তাহলে কী যে হবে তা করোনা ভাইরাস শিখিয়ে দিয়ে গেল৷’’ বাস্তবতা হলো গত অর্থবছরের বাজেটে এডিপিতে এই খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল তার মাত্র ২৫ ভাগ ব্যয় হয়েছে দশ মাসে৷ গবেষণার জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল তা-ও ব্যবহার করা হয়নি৷
ছবি: PID
গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানোয় ব্যর্থতা
শুরুতে করোনা সংক্রমণ শহর পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে৷ এর মধ্যে গ্রাম পর্যায়ে সচেতনতা ও সক্ষমতা গড়ে তুলতে দৃশ্যত তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার৷ ১২ জুলাই উল্টো স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘গ্রামের মানুষের ধারণা ছিল, তাদের করোনা হবে না৷ কিন্তু এখন গ্রামের মানুষের করোনা সংক্রমণের হার সবচেয়ে বেশি৷’’
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/Reuters
মানুষের জীবিকা
করোনা বিধিনিষেধ বা লকডাউনের জেরে বিপুল সংখ্যক মানুষ দরিদ্র হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জরিপে৷ কিন্তু লকডাউন বা বিধিনিষেধ দেওয়ার আগে নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষের কথাও মাথায় রাখা হয় না৷ ১৩ জুলাই নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য তিন হাজার ২০০ কোটি টাকার পাঁচটি নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও কবে নাগাদ, কিভাবে বিতরণ হবে তা এখনও পরিস্কার নয়৷
ছবি: Mortuza Rashed
কেন কড়াকড়ি, কেন শিথিল
১ জুলাই থেকে বাংলাদেশে কঠোর লকডাউন শুরু হয়৷ সেদিন আক্রান্তের সংখ্যা ছিল আট হাজারের উপরে, মৃতের সংখ্যা ১৪৩৷ সেটি বেড়ে ১৪ জুলাই আক্রান্তের সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়েছে, মৃত্যু প্রতিদিন গড়ে ২০০ জনের উপরে৷ অথচ ঈদের কারণে বিধিনিষেধ শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ করোনা ভাইরাসে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার যখন বেড়ে চলেছে, তখন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় বিশেষজ্ঞরাও বিস্মিত, উদ্বিগ্ন৷