বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও-র মহাপরিচালক টেড্রস অ্যাডানম গেব্রেয়েসাস ফেব্রুয়ারিতে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘‘আমরা শুধু একটি মহামারির বিরুদ্ধে লড়ছি না, আমরা ইনফোডেমিক-এর বিরুদ্ধে লড়ছি।''
বিজ্ঞাপন
করোনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি অনলাইনে ও অফলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া তথ্য ও খবর সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করতে চেয়েছেন। তারও দুই সপ্তাহে আগে ডাব্লিউএইচও করোনা ভাইরাসকে ‘একটি বিশাল ইনফোডেমিক' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। তারা বলেছিল, করোনা ভাইরাস নিয়ে ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত তথ্য' ছড়িয়ে পড়ছে, যার কিছু সঠিক আর কিছু ঠিক নয়।
ডাব্লিউএইচওর মহাপরিচালক মিউনিখে আরও বলেছিলেন, ভুয়া খবর করোনা ভাইরাসের চেয়ে দ্রুত ও সহজে ছড়িয়ে পড়ছে, যা বিপজ্জনক। তিনি মনে করেন, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রমাণ দিয়ে নীতি নির্ধারণের এটিই সবচেয়ে ভালো সময়।
ডাচ সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি সাইবারস্প্রিন্ট বলছে, প্রায় ২২ হাজার নিবন্ধিত ওয়েবসাইটে ‘কোভিড-১৯' অথবা ‘করোনা' শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই কমবেশি ভুয়া।
করোনা: গুজব ও বাস্তবতা
করোনা ভাইরাস নিয়ে ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়৷ কিন্তু এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে ভুয়া তথ্য, মিথ্যা সংবাদ৷ ডয়চে ভেলে চেষ্টা করছে বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে আপনাদের সঠিক তথ্য জানানোর৷
ছবি: picture-alliance/Photoshot/Xiao Yijiu
শিশুদের আশঙ্কা কি বেশি?
শিশুদের নিয়ে আলাদা করে কোনো আশঙ্কা নাই৷ যে কোনো বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারেন৷ আক্রান্তদের পাঁচ জনের চারজনের ওপর এই ভাইরাস সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের মতোই প্রভাব ফেলবে৷ এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়া রোগীদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শিশু ও তরুণ বয়সিরা স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই সংক্রমণ কাটিয়ে উঠতে পারেন৷ মধ্যবয়সিরা এতে আক্রান্ত হলেও পর্যাপ্ত সেবা ও চিকিৎসায় তাদেরও সেরে ওঠার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ৷
ছবি: Reuters/A. Jalal
কী খেলে ঠেকানো যাবে করোনা?
কোনো কিছু খেয়েই করোনা ঠেকানো যাবে না৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য সুষম খাবার এমনিতেই প্রয়োজন৷ অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে৷ কেউ রসুন খাওয়ার কথা বলছেন, কেউ ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক দ্রব্যের কথা বলছেন৷ রসুনে নানা উপাদান রয়েছে যা শরীরের জন্য ভালো৷ রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ বাড়াতে তা ভূমিকা রাখতে পারে৷ তবে ব্লিচিং বা অন্য রাসায়নিক শরীরে গেলে তা করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে৷
ছবি: AFP/C. De Souza
গরম বা ঠান্ডা পানি পান করা উচিত?
নিয়মিত পানি পান করলে শরীরের জন্য ভালো৷ কিন্তু ১৫ মিনিট পর পর গরম পানি পান করলে ভাইরাস মারা যাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷ মুখে বা শরীরে একবার ভাইরাস প্রবেশ করলে কোনো খাবার বা পানীয় দিয়েই তা আটকানো যাবে না৷ শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেই এই ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম৷
ছবি: Colourbox/Haivoronska_Y
অ্যান্টিবায়োটিক বা কোনো ওষুধে কাজ হবে?
অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের জন্য কার্যকর, ভাইরাসের জন্য নয়৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসুস্থ শরীরে ভাইরাসের পাশাপাশি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণও হতে পারে৷ সেসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন৷ এখনো নভেল করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন বা প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি৷ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ শিগগিরই হয়তো আসবে সুখবর৷
ছবি: imago/Science Photo Library
আবহাওয়া ও তাপমাত্রার কোনো প্রভাব রয়েছে?
এ বিষয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ পরীক্ষাগারে দেখা গেছে ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাস মারা যায়৷ কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রা কোনো দেশেই থাকে না৷ অনেকে মনে করছেন গরম পানি দিয়ে স্নান করলে ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সবসময় জরুরি৷ কিন্তু প্রচণ্ড গরম পানি দিয়ে স্নান করলেই তা করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচাবে, এমন তথ্য সঠিক নয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/D. Lipinski
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে কি করোনা ভাইরাস শনাক্ত সম্ভব?
থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরে তাপমাত্রা বোঝা সম্ভব, ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চত করা সম্ভব না৷ সেক্ষেত্রে কারো শরীরে জ্বর বা অন্য উপসর্গ দেখা দেয়ার আগ পর্যন্ত তার শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি বোঝা যাবে না৷ সাধারণত ভাইরাস শরীরে ঢোকার ১ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দেয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ দিনের মধ্যেই তা টের পাওয়া যায়৷ তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৪ দিনের পরও ভাইরাস শরীরে কর্মক্ষম থাকতে পারে৷
ছবি: Reuters/P. Mikheyev
টাকার মাধ্যমে কী করোনা ছড়ায়?
শরীরের বাইরে করোনা ভাইরাস কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারে৷ ফলে আমদানি করা কোনো পণ্য বা চিঠির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে৷ ময়লা টাকা থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷ ফলে টাকা লেনদেনের পর ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত৷ যত বেশি সম্ভব হাত-মুখ-নাক-কানে হাত নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ছবি: DW
মশা বা অন্য পশুর মাধ্যমে ছড়াতে পারে?
সার্স ভাইরাস ছড়িয়েছিল এক ধরনের বেড়াল থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ নভেল করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ালো বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন৷ ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড় থেকে অন্য কোনো মাধ্যম হয়ে মানুষের মধ্যে এটি ছড়িয়েছে৷ তবে মশা বা অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে এটি আপনার মধ্যে ছড়াবে না৷ সতর্কতা হিসেবে মাছ-মাংস খাওয়ার আগে ভালোভাবে রান্না করতে হবে৷ অর্ধেক সিদ্ধ মাছ-মাংস বা পোচ করা ডিম থেকে যেকোনো জীবাণুই ছড়াতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel/A. Rose
কিভাবে থাকবো নিরাপদ?
সবচেয়ে জরুরি হাত পরিষ্কার রাখা৷ সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ২০ সেকেন্ড পরিষ্কার করতে হবে৷ যদি সাবান না থাকে, ব্যবহার করতে পারেন অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷ হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় টিস্যু ব্যবহার করে তা ডাস্টবিনে ফেলুন, হাত ধুয়ে নিন৷ অথবা হাতের কনুইয়ে মুখ ঢাকুন৷ হাতের তালুতে হাঁচি-কাশি দিলে সেখান থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে আক্রান্ত হতে পারেন অন্য়রা৷ হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানো ও কোলাকুলি থেকেও বিরত থাকুন৷
ছবি: AFP/N. Almeida
আমি কী মারা যাবো?
করোনায় আক্রান্ত হলেই আপনি মারা যাবেন, এমন আশঙ্কা একেবারেই কম৷ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করুন৷ চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ মেনে চলুন৷ অনলাইনে যা দেখবেন, সব বিশ্বাস না করে নির্ভরযোগ্য তথ্যের সন্ধান করুন৷ সাবান, স্যানিটাইজার নিজে কিনে জমিয়ে রাখবেন না৷ আপনি নিরাপদ থাকলেও আপনার আশেপাশের মানুষ নিরাপদ না থাকলে সহজেই তার কাছ থেকে ছড়াবে ভাইরাস৷ ফলে নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যদেরও থাকার সুযোগ দিন৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Moore
10 ছবি1 | 10
এদিকে, ভুয়া খবর ঠেকাতে ডাব্লিউএইচও ফেসবুক, গুগল, টুইটার, টিকটক, ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে বলে জানান সংস্থার মহাপরিচালক গেব্রেয়েসাস। ফলে এসব মাধ্যম ব্যবহারকারীরা এখন ফেসবুক, ইউটিউব খুললে তাদের করোনা ভাইরাস নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে ডাব্লিউএইচওর ওয়েবসাইটে যাওয়ার পথ দেখানো হচ্ছে। ঐ ওয়েবসাইটে করোনা নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন ভুয়া তথ্য, মিথ ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন অ্য়ালকোহল ও ক্লোরিন ইতিমধ্য়ে শরীরে ঢুকে যাওয়া ভাইরাস মারতে পারে না, গরম পানি দিয়ে গোসল করে কোভিড-১৯ এর সঙ্গে লড়া যায় না, ঠাণ্ডা পানি করোনা মারতে পারে না, আলট্রাভায়োলেট রশ্মি দিয়ে হাত জীবাণুনাশক করা যায় না - এসব তথ্য জানানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
করোনার কারণে সারা বিশ্ৱে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার সাতশ জনের বেশি মানুষের মৃত্য়ু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। ফলে কোভিড-১৯ এর মতো মহামারি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে ডাব্লিউএইচও। এর সঙ্গে ইনফোডেমিক বা তথ্য়ের মহামারি যোগ হওয়ায় পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।