করোনা ব্যবস্থাপনা, আমরা কি উলটা পথে হাঁটছি?
২১ আগস্ট ২০২০![](https://static.dw.com/image/53683807_800.webp)
প্রায় পাঁচ মাস আগে করোনা প্যানডেমিকের কারণে বাংলাদেশে একটা বিশেষ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়৷ সে সময়ে সারা পৃথিবীতেই নতুন আসা এই রোগটিকে নিয়ে হইচই চলছে৷ সাধারণ মানুষ তো বটেই এমনকি চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত বুঝতে পারছিল না- এমন পরিস্থিতিতে করণীয়টা কী? রোগটি আগে কখনো দেখা যায়নি, তাই এর প্রতিষেধকের কথাও কেউ আগে চিন্তা করেনি৷ এর চিকিৎসাই বা কি হতে পারে- তা নিয়েও কোনো ধারণা নেই কারও৷ যাদের হলো এই রোগটা, তাদেরকে দেওয়া হতে থাকলো লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা৷ তাতে কেউ কেউ ভালো হলেন, কেউ কেউ হলেন না৷ চিকিৎসকরা মানলেন- এ রোগের কোনো নিশ্চিত চিকিৎসা নেই, সিমটোমেটিক বা লক্ষণনির্ভর চিকিৎসাই একমাত্র ভরসা৷
এখনো এর নিশ্চিত কোন প্রতিষেধক বা ভ্যাকসিন আবিস্কৃত হয়নি৷ তাড়াহুড়া করে কেউ কেউ ভ্যাকসিন বাজারে আনার চেষ্টা করছে, কিন্তু সাফল্য কতটুকু এসেছে- তা নিয়ে বিতর্ক ও সন্দেহ রয়েই গেছে৷
ওষুধ নেই, ভ্যাকসিন নেই, তাহলে এই আট মাস মানুষ কিভাবে মোকাবিলা করেছে কোভিড-১৯? আসলে মোকাবিলা করেনি, বরং এই ভাইরাসকে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছে৷ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছে৷ যারা আক্রান্ত হয়েছে, তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে, যাতে তাদের মাধ্যমে অন্য কেউ সংক্রমিত না হতে পারে৷ এই সময়ে আমরা কোয়ারিন্টিন, লকডাউন- এই শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছি৷ বিভিন্ন দেশ এই লকডাউন দিয়ে করোনার প্রাথমিক ধাক্কাটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে৷ তারপর যে-ই না এর প্রকোপটা কিছু কমে এসেছে, ধীরে ধীরে পরিকল্পিতভাবে লকডাউন তুলে নিয়েছে৷
আমাদের দেশকে সে বিবেচনায় খুবই ব্যতিক্রম বলা যায়৷ আমরা এক দিনের জন্যও পুরো দেশে লকডাউন দিইনি৷ আমরা লকডাউন দিইনি, দিয়েছি সাধারণ ছুটি৷ এই ছুটির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সরকার কিছু বিধি-নিষেধ জারি করেছে৷ সে বিধি-নিষেধগুলো মেনে চললে এক ধরনের লকডাউনই হয়ে যায়৷ অনেকের মতে, এই বিষয়টা আমাদের জন্য বুমেরাং হয়ে গেছে৷ এমনিতে লকডাউনে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের৷ আর লাভ হয়, রোগটা ছড়াতে পারে না৷
আমাদের ছুটির সঙ্গে ঘোষিত বিধি-নিষেধের কারণে অফিস আদালত কল কারখানা বন্ধ থেকেছে৷ ফলে শুরুতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে গেলে বন্ধই ছিল৷ আবার ‘ছুটি’ শব্দটা থাকার কারণে সাধারণ মানুষের চলাচলের উপর কোনো বিধিনিষেধ ছিল না৷ এতে করে লকডাউনের যে লাভ, রোগ ছড়াতে না পারা, সেটা আর আমরা পাইনি৷ সাধারণ ছুটির মাধ্যমে আমরা লকডাউনের ক্ষতিকর দিকটা অর্জন করেছি, কিন্তু লাভজনক দিকটা হারিয়েছি৷
সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়ার পর সরকার কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে৷ কিন্তু মজার বিষয় হলো, প্রতিটি পদক্ষেপই নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে, অনেক সময় এসব পদক্ষেপ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা হাস্যরসও হতে দেখা গেছে৷ একবার কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রী একত্রে বসে অনেক গবেষণার পর সিদ্ধান্ত নিলেন, ঢাকা শহরকে তারা লাল-হলুদ-সবুজ জোনে ভাগ করবেন৷ শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন কিংবা তার সুফল কতটুকু কি হয়েছে সেটা রহস্যই থেকে গেছে৷
করোনার প্রকোপের কথা বিবেচনা করে রাজধানী ঢাকার কয়েকটা এলাকাকে বিচ্ছিন্নভাবে লকডাউন করা হয়েছিল৷ কঠোর সেই লকডাউন বাস্তবায়নে বলা হলো, ওই এলাকার কেউ কোনো প্রয়োজনেই আর বাইরে যেতে পারবে না৷ কিছু সংগঠন দাঁড়িয়ে গেল ওইসব এলাকায় বাড়ি বাড়ি নিত্যপণ্য সরবরাহের জন্য৷ এ নিয়েও পরে বাণিজ্যের নানা কাহিনি শোনা গেল৷
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, লক ডাউনের ঠিক আগের দিন অনেকে ওই এলাকা ছেড়ে দু সপ্তাহের জন্য ঢাকাতেই অন্য এলাকায় তাদের আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে উঠলেন!
করোনার এই প্যানডেমিকের সময় সরকারের যে ভূমিকাটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে তা হলো, টেস্টের অপ্রতুলতা৷ শুরু থেকেই যেন নানা ছুতা-নাতায় করোনা টেস্ট কম করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে৷ পুরো সময়ের হিসাব যদি ধরি, তাহলে দেখা যাবে, গড়ে দিনে ৮ হাজার করে টেস্ট করা হয়েছে৷ প্রথম দিকে কম ছিল, এখন একটু বেড়েছে৷ বাড়লেও এটা কখনোই ২০ হাজারকে স্পর্শ করতে পারেনি৷ যেমন, সর্বশেষ আজকের (২০ আগস্ট,২০২০) কথা যদি ধরি, তাহলে দেখবো করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৪ হাজার ৬৭৮টি৷ এর মধ্যে ২ হাজার ৭৪৭ জনের দেহে করোনার উপস্থিতি পাওয়া গেছে৷ অর্থাৎ, আজকের হিসাবটিকে বিবেচনায় নিলে যাদের টেস্ট করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৭১ শতাংশের করোনা পজিটিভ৷ এ হারটা উপেক্ষো করার মতো নয়, বরং কিছুটা আতঙ্কজনকই৷
এখন টেস্টের সংখ্যা যদি বাড়ানো হতো, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যাটিও যে আনুপাতিক হারেই বাড়তো, সেটা বলা যায় নির্দ্বিধায়৷ তাহলে কি আক্রান্তের সংখ্যা কম করে দেখানোর লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবে অল্প সংখ্যক টেস্ট করছে সরকার?
এখানে আরেকটা তথ্য উল্লেখ করা যায়৷ সপ্তাহখানেক আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর'বি) যৌথভাবে একটি গবেষণা পরিচালনা করে৷ তাতে তারা দেখতে পায় ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দাদের ৯ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত৷ এর অর্থ হচ্ছে, দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে কমপক্ষে ১৮ লাখ মানুষের দেহে করোনা ভাইরাস রয়েছে৷ আর সরকারি হিসাবে কী বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে, পুরো দেশে গত পাঁচ মাসে সব মিলিয়ে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৫৯ জনের দেহে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে৷ হিসাবটা একটু বেশি রক্ষণশীল, একটু বেশি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না?
বিষয়টা মনে হয় সরকার নিজেও কিছুটা উপলব্ধি করেছে সম্প্রতি৷ এখন তারা টেস্টের সংখ্যা সম্ভবত একটু বাড়াতে চাইছে৷ নইলে করোনা টেস্টের ফি কমাতে চাইবে কেন? কিছুদিন আগে সরকার একটা অভিনব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষার জন্য সরকারিভাবে যে টেস্ট হয়ে থাকে, তার উপর সরকার একটা ফি আরোপ করেছিল৷ এই উদ্ভট সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিতে যেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছিলেন, বেশি বেশি মানুষ অহেতুক টেস্ট করাতে আসছে, তাই সেটা নিরুৎসাহিত করতেই এই ফি আরোপ করা হয়েছে৷ তখন ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল ২শ' টাকা ও ৫শ' টাকা৷ হাসপাতালে পরীক্ষা করালে ২শ' টাকা, এবং বাড়িতে পরীক্ষা করালে ৫শ' টাকা৷ গত বুধবার (১৯ আগস্ট) স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, এই ফি কমিয়ে ১শ' টাকা ও ৩শ' টাকা করা হয়েছে৷ তিনি অবশ্য কারণটাও উল্লেখ করেছেন, বলেছেন, ‘‘করোনা আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য মানুষ যাতে আরো বেশি পরীক্ষা করায়, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে করোনা পরীক্ষার এই নতুন ফি নির্ধারণ করে দিয়েছেন৷’’
মন্ত্রীর এই বক্তব্য আমার কাছে রীতিমতো ভয়াবহ বলে মনে হয়েছে৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়টি তাহলে চলছে কিভাবে? দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা, সমাধান- এসব বিষয়ে কি তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা এর কর্মকর্তাদের কোনোই ভূমিকা নেই? সবকিছুই কি প্রধানমন্ত্রীকে করতে হয়? তাঁকে বলে দিতে হয়? সেই যে আগে বেশি বেশি ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল- সেটা তাহলে কে নির্ধারণ করেছিল? সেই ফি-এর অঙ্কটা কি তাহলে ভুল ছিল?
জানি না, পৃথিবীর আর কোনো দেশের সরকার এমন মানসিকতা লালন করে কিনা৷ করোনার টেস্ট বেশি বেশি হচ্ছে এটা থামানোর লক্ষ্যে সরকারি টেস্টের উপর ফি ধার্য করে কিনা? কোভিড-১৯ তো কোনো ব্যক্তিগত রোগ নয়৷ এটা সামাজিক, আরো বিস্তৃতভাবে দেখলে এটা একটা বৈশ্বিক রোগ৷ কারো যদি হৃদরোগ কিংবা কিডনির রোগ হয়, তার জন্য প্রত্যক্ষভাবে সরকারকে বা সমাজকে দায়ী করা যায়৷ রোগটি যার হয়েছে তার ব্যক্তিগত জীবন-যাপনের জন্যই হয়েছে৷ ফলে তার দায় তাকেই নিতে হবে৷ কিন্তু করোনা তো সেরকম কিছু নয়৷ এই দেশে এই রোগটা এলো কার দায়িত্বহীনতার কারণে? সরকার উহান থেকে ছাত্রদেরকে এনে কোয়ারিন্টিনে রাখতে পারলো, কিন্তু ইতালি থেকে আসা লোকগুলোকে পারলো না কেন? তাদেরকে কেন উন্মুক্তভাবে ছেড়ে দিলো? সেই যে শুরু হলো, এরপর বিদেশ থেকে আসা কোনো ফ্লাইটের যাত্রীদেরই তো আর নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হলো না৷ এই যে অবহেলা, দায়িত্বহীনতা, এর দায়ভার সাধারণ মানুষকে বইতে হবে কেন?
সরকারের দায়িত্বহীনতায় আমার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে যে পরীক্ষা তার জন্যও আবার সরকার আমার কাছ থেকেই পয়সা নেবে- এটা কি অবিচার নয়?
কিন্তু এতসব প্রশ্ন আপনি কার কাছে করবেন? কে দেবে জবাব? স্বাভাবিকভাবেই চলে আসবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নাম৷ জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে যখন প্রশ্ন ও উদ্বেগ, গণপ্রজাতন্ত্রী একটা সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীরই তো সে বিষয়ে কথা বলার কথা৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এমন একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের মাথার উপর চেপে আছেন, তিনি যে কখন কী বলেন, কেন বলেন- তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না৷ মাঝে কোভিডের চিকিৎসা ও করোনা পরীক্ষা নিয়ে বেশ কেলেঙ্কারি হয়ে গেল৷ রিজেন্ট নামের একটা ভুয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকার চুক্তি করলো, পরে দেখা গেল ওই প্রতিষ্ঠানটি কোনো পরীক্ষা না করেই করোনার সার্টিফিকেট দিচ্ছে৷ চিকিৎসা সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও রোগী ভর্তি করছে, রোগী মারা যাচ্ছে৷ ওই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে খোদ মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন, সে ছবিও পত্রিকায় এসেছে৷ কিন্তু বিষয়টি যখন ধরা পড়লো, মন্ত্রী বললেন রিজেন্টের মালিক মো. সাহেদকে তিনি চেনেন না! আবার এক পর্যায়ে বলেন, অজস্র চুক্তি হয়, মন্ত্রীরা এসব পড়ে দেখেন না৷ রিজেন্ট নিয়ে এরকম আরও অনেক কথা হলো, পানি ঘোলা হলো৷ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বললেন, মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশে তিনি এই চুক্তি করেছেন৷ এ নিয়ে মন্ত্রী সচিব ক্ষুব্ধ হলেন৷ শেষ পর্যন্ত মহাপরিচালক পদত্যাগ করলেন৷
এলোমেলো কথা বলার মাধ্যমে এরই মধ্যে এই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন৷ একবার বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম বন্ধেই অভিযান পরিচালিত হয়েছে৷ আবার কদিন পরেই বলেন, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে আর কোনো অভিযান পরিচালনা করা হবে না৷ অভিযান হবে সীমান্তে, হাসপাতালে নয়৷ করোনাকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্যখাতে অনেক কটি দুর্নীতির বিষয় ধরা পড়লেও, স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিন্তু শুরু থেকেই নিজের সাফল্যের কথা প্রচার করে আসছেন৷ তিনি দাবি করেছেন, করোনা মোকবিলায় তার মন্ত্রণালয় খুবই সফল৷ এই সফলতার প্রমাণ হিসাবে তিনি হাজির করেছেন মৃত্যুহারের বিষয়টি৷ বলেছেন, আশেপাশের দেশ, এমনকি ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের এখানে করোনায় মৃত্যুহার অনেক কম৷
মন্ত্রীর এই দাবিটি কিন্তু একেবারে অমূলক নয়৷ আসলেই আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুহার ১ দশমিক ৩২ শতাংশ৷ সারা বিশ্বের গড় মৃত্যু হার যেখানে ৫ শতাংশের মতো, যুক্তরাস্ট্রে ৩ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ১৩ শতাংশ, জার্মানিতে ৪ শতাংশ, সেখানে আমাদের দেশের এই মৃত্যুহার আসলেই কম৷ কিন্তু আমাদের দেশে করোনায় মৃত্যুহার এত কমের মূল কারণগুলো কি? কেউ বলছেন, আমাদের জনগণের মধ্যে এই জাতীয় রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেকটাই বেশি৷ আবার অনেকে এর জন্য আমাদের তুলনামূলক গরম আবহাওয়ার কথা বলছেন৷ যেহেতু কারণটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, তাই এ নিয়ে একটা গবেষণা হতে পারতো৷ তা হয়নি৷ গবেষণার কোন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি৷ সরকারই এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারতো৷ সেক্ষেত্রে হয়তো এই গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফল করোনা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকাও রাখতে পারতো৷
কিন্তু সেরকম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেউই৷ বরং, এই যে মৃত্যুহার কম, এটাকে নিজেদের কৃতিত্ব হিসাবে জাহির করার একটা উদগ্র চেষ্টা যেন লক্ষ্য করা গেছে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মধ্যে৷ তিনি দাবি করেছেন, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো বলেই, হাসপাতালগুলোতে অতি উন্নত চিকিৎসা হয় বলেই করোনায় মানুষ কম মরছে!
এই মন্ত্রীর অতি সাম্প্রতিক একটি মন্তব্য হচ্ছে, করোনার ভ্যাকসিন আসার আগেই বাংলাদেশ থেকে করোনা চলে যাবে! তার এমন বক্তব্যের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে৷ ঠিক কোন বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর নির্ভর করে তিনি এমন একটি বক্তব্য দিলেন তা তিনি নিজে এখনো পরিস্কার করেননি৷ তবে, দেশের চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা এরই মধ্যে মন্ত্রীর এমন মন্তব্যকে একেবারে বাতিল করে দিয়েছেন৷
তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যতই ভিত্তিহীন বা প্রগলভ হোক না কেন, সমাজে এর কিন্তু নেতিবাচক প্রভাব একটা পড়েছে৷ মানুষের মধ্যে করোনা নিয়ে ভীতি অনেকটাই কমে গেছে৷ রাস্তাঘাটে কিংবা হাট বাজারে মানুষের ভিড় বাড়ছে, ভিড়ের মধ্যে থাকা মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়েও তেমন একটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না৷ সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, করোনা চলে যাওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য বোধকরি একেবারেই উদ্দেশ্যহীন নয়৷ হয়তো বুঝেশুনেই কথাটা বলেছেন তিনি৷ এমন বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষকে বোধ করি তিনি রাস্তা-ঘাটে আরও বেশি বেশি করে নামার সাহস দিতে চাইছেন৷ এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে৷ গণপরিবহন তো আরও আগেই খুলে দেওয়া হয়েছে৷ এখন শুনছি সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হবে৷ সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, সরকার যেন বোঝাতে চাইছে করোনা নিয়ে ভয় পাওয়ার আর কিছু নেই, করোনা এমনি এমনি চলে যাবে৷ কাজেই আমাদের সকলের এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সময় এসে গেছে৷
এমনটাই যদি সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে৷ সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতি কিন্তু দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ মোট আক্রান্তের হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৬ নম্বরে৷ ইতালি (১৭) কিংবা চীনের (৩৪) চেয়েও খারাপ৷ পাকিস্তানের অবস্থান ১৫ নম্বরে৷ তবে যেভাবে আমাদের প্রতিদিন আড়াই তিন হাজার করে নতুন আক্রান্ত হচ্ছে, হয়তো এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ অবস্থানে চলে যাবো৷
আর এই যে সবকিছু খুলে দেওয়ার মতলব, সে প্রেক্ষিতে মাস পাঁচেক আগের পরিস্থিতিটা একটু স্মরণ করতে অনুরোধ করবো৷ আমাদের দেশে মার্চের ৮ তারিখে প্রথম তিনজন করোনা রোগী চিহ্নিত হয়৷ এপ্রিলের ৮ তারিখে সংখ্যাটি হয় ২১৮ জন৷ মার্চের ২৬ তারিখে, যেদিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলো, সেদিন মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৪ জন৷ মে মাসের ৮ তারিখে সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩,১৩৪ জন৷ জুনের ৮ তারিখে ৬৮,৫০৪ ৷ জুলাইয়ের ৮ তারিখে ১,৭২,১৩৪, আগস্টের ৮ তারিখে ২,৫৫,১১৩ জন আর আজ যখন এই লেখাটি লিখছি, ২০ আগস্ট, সেই সংখ্যা দাড়িয়েছে ২,৮৭,৯৫৯ জনে৷ প্রথম এক মাসে বেড়েছে ২১৫ জন৷ দ্বিতীয় মাসে বেড়েছে ১২,৯১৬ জন৷ তৃতীয় মাসে বেড়েছে ৫৫,৩৭০ জন৷ চতুর্থ মাসে বেড়েছে ১,০৩,৬৩০ জন৷ পঞ্চম মাসে বেড়েছে ৮২,৯৭৯ জন৷ আর শেষ ১২ দিনে বেড়েছে ৩২,৮৪৬ জন৷ যদি অগাস্টে ১ তারিখ থেকে ২০ তারিখের হিসাব ধরি, তাহলে দেখা যাবে গড়ে প্রতিদিন নতুন রোগী বাড়ছে ২,৪০৪ জন করে৷ যেদিন প্রথম সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয় সেদিন মোট আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪৪ জন৷ অর্থাৎ, সেদিনের তুলনায় ৫৪ গুণ রোগী হচ্ছে প্রতিদিন৷ তাহলে পরিস্থিতি কি আগের চেয়ে ভালো, নাকি মন্দ? মাত্র ৪৪ জন রোগী দেখে আপনি যদি বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় ছুটি (প্রকারন্তরে লকডাউন) ঘোষণা করতে পারেন, তাহলে যখন প্রতিদিন আড়াই হাজার করে রোগী বাড়ছে, তখন স্বাভাবিক অবস্থা বলবেন কোন বিবেচনায়?
মানছি, কিছু কিছু দেশ লকডাউন তুলে দিয়েছে৷ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালুর প্রত্যাশায় তারা করেছে এমন৷ কিন্তু যে দেশগুলো লকডাউন তুলে নিয়েছে, তারা জোর দিয়েছে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতি৷ প্রতিটা মানুষ, যারা রাস্তায় বের হয়েছে, তারা মাস্ক পরেছে কিনা, সামজিক দূরত্ব বজায় রেখেছে কিনা, এসব বিষয় সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল রাখা হয়েছে৷ আমাদের একেবারে ভূখন্ড, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও দেখলাম নতুন করে দুদিনের (২১ ও ২২ আগস্ট) জন্য লকডাউন দেওয়া হয়েছে৷ স্বাস্থ্যবিধি না মানার জন্য, অর্থাৎ, মাস্ক না পরার জন্য বুধবার (১৯ আগস্ট) এক কলকাতাতেই ৪২৭ জনকে জরিমানা করা হয়েছে৷ আমাদের এখানে কি স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে সে রকম কোনো ব্যবস্থা নিতে কখনো দেখেছি? আমরা যেন গা ছেড়ে দিয়েছি৷
আমরা কি তাহলে উলটো দিকে হাঁটছি?