নানা দেশ ও সংস্থা নানা ভাবে করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে৷ কেউ ইনঅ্যাক্টিভ ভ্যাকসিন, কেউ লাইভ ভ্যাকসিন আবার কেউ ডিএনএ ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে৷
বিজ্ঞাপন
আসুন দেখে নেওয়া যাক এ পদ্ধিতিগুলো আসলে কী:
লাইভ ভ্যাকসিন
লাইভ ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে মূলত রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসকেই ব্যবহার করা হয়৷ কিন্তু সেগুলো শরীরের ক্ষতি করতে পারে না, অর্থাৎ সেগুলোর রোগসৃষ্টির ক্ষমতা শূন্য থাকে৷ ফলে ওই ভাইরাসের কারণে শরীর আক্রান্ত হয় না, কিন্তু মানবদেহের কোষের ভেতর সেগুলো বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম৷ ভাইরাসের বংশবিস্তার শুরু হলে মানবদেহের প্রাকৃতিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সক্রিয় হয়ে উঠে এবং অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে ভাইরাস ধ্বংস করে৷ এভাবেই মানুষের শরীরে বিশেষ ওই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি হয় এবং পরবর্তীতে ওই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে শরীরে থাকা অ্যান্টিবডি সহজেই সেগুলোকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করে ফেলতে সক্ষম হয়৷ এভাবে মানবদেহে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে৷
এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করা হয়েছে৷ এছাড়া আফ্রিকার দেশেগুলোতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া ইবোলা-র বিরুদ্ধে প্রথম অনুমোদন পাওয়া টিকাও এক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছে৷
করোনা: এসব গুজবে কান দেবেন না
পুরো বিশ্বে নভেল করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে গুজবের শেষ নেই৷ বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গুজব সবচেয়ে বেশি৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এমনই কয়েকটি গুজবের জবাব দিয়েছে৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Geisler-Fotopress
১. ফাইভ-জি মোবাইল নেটওয়ার্কে করোনা ছড়ায়?
রেডিও তরঙ্গ বা মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোন ভাইরাস ছড়ায় না৷ এমন অনেক দেশেই করোনা’র সংক্রমণ হয়েছে, যাদের ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক নেই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/B. Roessler
২. রোদের তাপ কি করোনা প্রতিরোধ করে?
তাপমাত্রা যত বেশিই হোক না কেনো, যেকোন তাপমাত্রায় আপনি সংক্রমিত হতে পারেন৷ ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা আছে এমন অনেক দেশেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. van den Bergh
৩. একবার সংক্রমণ, সারাজীবনের সংক্রমণ?
করোনা আক্রান্ত যেকোন মানুষ পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেন৷ আপনার লক্ষণ চিনতে হবে এবং সেই বুঝে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে৷ আপনার যদি জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট থাকে তাহলে ডাক্তারকে ফোন দিন৷
ছবি: AFP/B.R. Smith
৪. ১০ সেকেন্ডের নাই ভরসা
অনেকে মনে করেন কোনো ধরনের কষ্ট বা কাশি ছাড়া ১০ সেকেন্ড বা তার বেশি সময় শ্বাস আটকে রাখতে পারলে তার করোনা নেই৷ এই ধারণা ভুল৷ করোনা ভাইরাসের খুব সাধারণ একটি লক্ষণ হল শুকনো কাশি, ক্লান্তি এবং জ্বর৷ কারো কারো ক্ষেত্রে ভয়াবহ ধরনের নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা যায়৷ আপনার উচিত এসব লক্ষণ থাকলে আগে পরীক্ষা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Campodonico
৫. মদে মুক্তি?
বেশি বেশি মদ বা অ্যালকোহল খেলে করোনা প্রতিরোধ হয় না বরং তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J.-P. Muller
৬. তীব্র শীতে করোনা মরে?
এটা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই যে তীব্র শীত বা বরফে করোনা ভাইরাস টিকে থাকতে পারে না৷ কারণ বাইরের তাপমাত্রা যাই হোক না কেনো আপনার শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷
ছবি: picture-alliance/AA/A. Ozdil
৭. হ্যান্ড ড্রায়ার করোনা মারে?
না৷ হাত শুকানোর যে মেশিন, করোনা ভাইরাসের উপর তার কোন প্রভাব নেই৷ আপনার যা করণীয় তা হল: বার বার সবান পানি বা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধোয়া৷ এরপর টিসু, তোয়ালা বা গরম ড্রায়ার দিয়ে হাত শুকাতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/AP/NIAID-RML
৮. নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন কি করোনায় কার্যকর?
না৷ নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন যেমন: নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন বা হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি ভ্যাকসিন করোনার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়৷ এই ভাইরাস একেবারে নতুন এবং ভিন্ন ধরনের, যার জন্য চাই আলাদা ভ্যাকসিন৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় গবেষকরা এ বিষয়ে কাজ করছেন৷
ছবি: Reuters/B. Guan
৯. নাকের ড্রপ কি সংক্রমণ থেকে বাঁচায়?
না৷ এমন কোন তথ্য-প্রমাণ এখনো মেলেনি যে নিয়মিত স্যালাইন পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলে এই সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়৷
ছবি: Imago Images/Panthermedia/A. Guillem
১০. করোনা প্রতিরোধে বিশেষ কোন ওষুধ?
করোনা প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কোন ওষুধ নেই৷ কেবল লক্ষণ অনুযায়ী এ রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকেরা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Geisler-Fotopress
10 ছবি1 | 10
ইনঅ্যাক্টিভ ভ্যাকসিন
ভাইরাসের দেহে কোন নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম নেই; এটি কেবল প্রোটিন এবং নিউক্লিক এসিড দিয়ে গঠিত৷ ভাইরাস কেবল উপযুক্ত পোষকদেহের অভ্যন্তরে বংশবৃদ্ধি করতে পারে৷ এদের অভ্যন্তরীণ তথ্য বহনকারী সূত্রক দুই প্রকারের হতে পারে- ডিএনএ এবং আরএনএ৷
ইনঅ্যাক্টিভ ভ্যাকসিনে সুনির্দিষ্ট ভাইরাল প্রোটিন বা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস থাকে৷ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এগুলোকেই হত্যা করবে৷ যেহেতু শরীরে নিষ্ক্রিয় বা মৃত ভাইরাস প্রবেশ করানো হয় তাই সেগুলো বংশবিস্তার করতে পারে না৷ কিন্তু রোগের বিস্তার ঘটাতে না পারলেও দেহে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সেগুলোকে চিহ্নিত করে এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি করে৷
ইনফ্লুয়েঞ্জা, পোলিও, হুপিংকাশি, হেপাটাইটিস বি ও ধনুষ্টংকারের টিকায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে৷
জিন-বেজড ভ্যাকসিন
এটা অনেকটা ইনঅ্যাক্টিভ ভ্যাকসিন এর মত৷ তবে বাড়তি সুবিধা হচ্ছে, ঔষুধ কোম্পানিগুলো ইনঅ্যাক্টিভ ভ্যাকসিনের চেয়ে জিন-বেজড ভ্যাকসিন দ্রুত উৎপদান করতে পারে৷ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে৷
কারণ কোভিড-১৯ প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কার হলে দ্রুততম সময়ে সারা বিশ্বে সেই টিকা ছড়িয়ে দিতে কোটি কোটি ডোজ উৎপাদন করতে হবে৷ জিন-বেজড ভ্যাকসিন করোনা ভাইাসের ডিএনএ বা আরএনএ থেকে একদম সঠিক জিনগত তথ্য নিয়ে তৈরি করা যাবে৷
এই টিকা শরীরে প্রবেশের পর সেটা নির্বিষ ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করবে এবং মানবদেহের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা সেগুলোকে নির্মূল করতে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে৷
আতঙ্কের পৃথিবীতে নবজীবনের আনন্দ
করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে জীবন প্রায় স্থবির, হাসি-আনন্দহীন। এর মাঝেই দেশে দেশে, ঘরে ঘরে আসছে নতুন মুখ, নবজাতককে ঘিরে জীবনে ফিরছে প্রাণচাঞ্চল্য।
ছবি: Reuters/A. Perawongmetha
মায়ের কোলে প্লাটন
লক ডাউনোর সময় কোলে আসবে প্রথম সন্তান। বাবা-মা কাছে নেই। মস্কোয় খুব অসহায় লাগছিলো এভগেনিয়া দানিগেভিচের। ৪ মে সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলে প্লাটনকে কোলে পেয়ে ভুলে গেলেন সব।
ছবি: Reuters/E. Novozhenina
বোনের খুশি
ভিয়েতনামও লড়ছে করোনা ভইরাসের সঙ্গে। সে লড়াইয়ে এশিয়ার দেশটি এখনো বেশ সফল। ভাইরাসকে রুখতে নিয়মে বাঁধা জীবন মেনে নিয়েছে সবাই। পুঁচকে ভাই ফুক আন- এর মুখ দেখার সময়ও তাই মাস্ক পরতে ভোলেনি হা লিনিন।
ছবি: Reuters/Kham
নিরাপদ আশ্রয়ে ঘুমন্ত শিশু
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে মায়ের কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে এক নবজাতক।
ছবি: Reuters/Y. Herman
মা ইরাকে, সন্তান ইরানে
নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার কারণে স্বাভাবিক সময়ের দু মাস আগে সন্তান জন্ম দিয়েছেন রফিকা ইব্রাহিম। স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে ইরাকের বসরা থকে ইরানের আহবাজ শহরের এক হাসপাতালে যেতে হয়োছিল তাকে। সেখানেই জন্ম নেয় সেইফ। ডাক্তারদের পরামর্শে সন্তানকে রেখেই বাড়ি ফেরেন রফিকা। তারপর থেকে দু'দেশের সীমান্ত বন্ধ। ভিডিওতে সন্তানের মুখ দেখেই দিন যায় রফিকার।
ছবি: Reuters/M. Aty
মায়ের চোখে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে শিগগিরই প্রথম সন্তানের জননী হবেন স্টেফানি বাওয়ার্স। করোনা সংকটের কারণে তার চোখে-মুখে শুধু দুশ্চিন্তা।
ছবি: Reuters/P. Noble
হাশিমের অসীম আনন্দ
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের স্বাস্থ্যকর্মী হাসিম।করোনায় সংক্রমিতদের জীবন বাঁচাতে দিনের পর দিন হাসপাতালে থাকতে হয় তাকে। এরই মাঝে জীবনে এসেছে প্রথম সন্তানের বাবা হওয়ার আনন্দ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাচের ওপার থেকে সেই আনন্দ উপভোগ করছেন হাশিম।
ছবি: Reuters/J. Malone
সুখী পরিবার
সদ্যোজাত সন্তানের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের এক দম্পতি।
ছবি: Reuters/D. Balibouse
করোনা কালে নবজাতকের নিরাপত্তা
ব্যাংককের হাসপাতলে একটু আগে জন্ম নিয়েছে দুই শিশু। করোনার কবল থেকে বাঁচাতে 'নিরাপত্তাবেষ্টনী'তে ঘিরে রাখা হয়েছে তাদের।
ছবি: Reuters/A. Perawongmetha
দেখো! দেখো!
নুরিয়ার কাছে প্রতিবেশীদের আবদার, " ব্যালকনিতে এসে বাচ্চাটাকে দেখাও একবার।"
স্পেনের রোন্দা শহরের এই মা তাই সপরিবারে হাজির ব্যালকনিতে!
ছবি: Reuters/J. Nazca
মামা-ভাগ্নির দেখা
বৃটেনের স্ট্রেথামে বোনের বাড়িতে এসেছেন এক ভাই। জানালা দিয়েই দেখে নিচ্ছেন পুঁচকে ভাগ্নিকে
ছবি: Reuters/H. McKay
মা হেঁটে হেঁটে জীবনের ওপারে
লকডাউনের কারণে শহরে কোনো গাড়ি চলছে না।বিশেষ অনুমতি ছাড়া পাওয়াও যাবে না গাড়ি। প্রসব যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় উগান্ডার কাম্পালা শহরের অন্য প্রান্তের এক হাসপাতালের দিকে হাঁটতে শুরু করেছিলেন স্কোভিয়া। গর্ভের সন্তান মারা যায় পথেই। হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পর স্কোভিয়াও মারা যান। তার ছবি দেখিয়ে সেই কাহিনি শোনায় পরিবার।
ছবি: Reuters/A. Lubowa
11 ছবি1 | 11
তবে এখন পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে তৈরি কোনো টিকা বাজারে নেই৷ নানা দেশের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি এ পদ্ধতির উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে এবং তাদের গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে৷
কবে আসবে টিকা?
করোনা ভাইরাসে বিশ্ব জুড়ে মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রায় ৩৭ লাখ মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন৷ মারা গেছেন আড়াই লাখের বেশি মানুষ৷ এখনো ভাইরাস সংক্রমণের যে গতি তাতে এ মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ বলতে পারছে না৷
যথাযথ টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হলে এই ভাইরাস ফিরে ফিরে আসবে বলেও আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের৷ ফলে সবার মুখেই এখন এক প্রশ্ন, কবে আসবে টিকা?
নানা দেশে ও সংস্থা নিজেদের মত করে কোভিড-১৯ এর টিকা আবিষ্কারের চেষ্টা করছে৷ গবেষণাগারে পরীক্ষা এমনকি মানবদেহে পরীক্ষা পর্যন্ত শুরু করেছেন কেউ কেউ৷ কিন্তু তারপরও এখনো ঢের সময় প্রয়োজন৷ মানবদেহে পরীক্ষার পর প্রথমেই সেটা নিরাপদ কিনা দেখতে হবে৷ তারপর দেখতে হবে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কিনা এবং সেটা ঠিকঠাকমত কাজ করছে কিনা৷
সব কিছু ঠিকঠাকভাবে যাচাই করার পর শুরু হবে বাণিজ্যিক উৎপাদন৷ সেখানেও পেরুতে হবে নানা ধাপ৷ তাই ২০২১ সালের আগে করোনা ভাইরাসের টিকা বাজারে আসার সম্ভাবনা নেই বলেই মত অনেক বিশেষজ্ঞর৷