করোনার উৎপত্তি নিয়ে বাইডেন আরো গভীর তদন্ত চান। তিনি জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাস কোনো প্রাণীর কাছ থেকে এসেছে, এটা যেমন নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি, আবার গবেষণাগার থেকে লিক হয়েছে, তারও পুরো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এক বিবৃতিতে বাইডেন জানিয়েছেন, মার্কিন গোয়েন্দারা এই দুইটি তত্ত্বের মধ্যে বিভক্ত। কিন্তু কোনো একটি তত্ত্ব মেনে নেয়ার মতো যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। দুইটি গোয়েন্দা সংস্থার মতে, এই ভাইরাস প্রাণীর থেকে এসেছে। একটি সংস্থা মনে করে, গবেষণাগার থেকে লিক হয়েছে। তার বক্তব্য, এই তদন্তের কাজে মার্কিন জাতীয় গবেষণাগারগুলির উচিত গোয়েন্দা সংস্থাকে সাহায্য করা। আর চীনের উচিত আন্তর্জাতিক তদন্তে সাহায্য করা।
বাইডেনের প্রত্যাশা, ৯০ দিনের মধ্যে তদন্তের ফলাফল হাতে এসে যাবে।
সন্দেহ প্রবল
অ্যামেরিকায় বেশ কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তার সন্দেহ, চীনের ল্যাব থেকেই করোনা ভাইরাস লিক হয়েছিল। ট্রাম্পের আমলে হোয়াইট হাউসের করোনা বিষয়ক পরামর্শদাতা ফাউচি বলেছেন, তিনি ও অন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, স্বাভাবিকভাবেই এই ভাইরাস জন্ম নিয়েছে, কিন্তু কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নন। অনেকের মনে আশঙ্কা রয়েছে, অনেকে অনুমান করছেন। কেউই নিশ্চিত নন।
বাইডেনের প্রবীণ পরামর্শদাতা অ্যান্ডি স্ল্যাভিট মঙ্গলবার বলেছেন, ''আমরা চীনের কাছ থেকে স্বচ্ছ্বতা চাই। আমরা চাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তদন্তে সাহায্য করুক।''
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নভেল করোনা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হয়৷ শুরুতে এর নাম দেয়া হয় ২০১৯-এনসিওভি, পরে কোভাড-১৯৷ বিশ্বজুড়ে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ চীনে এরই মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন সহস্রাধিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/SOPA Images/A. Marzo২০১৯ সালের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে নতুন এক রোগের কথা জানায়৷ এক কোটিরও বেশি মানুষের উহান শহরে অনেকেই শ্বাসতন্ত্রের অজানা সংক্রমণ নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে৷ রোগের কারণ ও ধরন অজানা৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিশেষজ্ঞরা তাৎক্ষণিকভাবে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন৷ শহরের সামুদ্রিক খাবারের বাজার দ্রুত বন্ধ ঘোষণা করা হয়৷ শুরুতে কেবল ৪০ জনের মতো আক্রান্তের খবর এসেছিল৷
ছবি: Imago Images/UPI Photo/S. Shaver২০০২ সালে চীন থেকেই ছড়িয়েছিল আরেক করোনা ভাইরাস- সার্স৷ সার্সে বিশ্বজুড়ে আট শতাধিক মানুষ মারা যান৷ শুরুতে এই ভাইরাসকে সার্স মনে করলেও পরে ৭ জানুয়ারি তারা ঘোষণা করেন, এটি মানুষের অজানা সম্পূর্ণ নতুন এক ভাইরাস৷ সার্স এবং সাধারণ ঠান্ডা-কাশির মতো এটিও করোনা ভাইরাস পরিবারেরই সদস্য৷ এর লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়া৷
ছবি: picture-alliance/BSIP/J. Cavallini১১ জানুয়ারি করোনা ভাইরাসে প্রথম মৃত্যুর খবর ঘোষণা করে চীন৷ উহানের সামুদ্রিক খাবারের দোকানে এক নিয়মিত ক্রেতা ছিলেন এই ৬১ বছর বয়সি ব্যক্তি৷ শেষের দিকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি৷
ছবি: Reuters/Strপরের কয়েক দিনেই থাইল্যান্ড ও জাপানে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়৷ এসব আক্রান্তও উহানের সেই বাজারে গিয়েছিলেন৷ উহানে দ্বিতীয় মৃত্যুর খবর আসে৷ জানুয়ারির ২০ তারিখের মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হয়, ২০০ মানুষ আক্রান্ত হন ভাইরাসে৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoonনতুন ভাইরাস কিভাবে একজনের শরীর থেকে আরেক জনের শরীরে ছড়াচ্ছে, তা বের করতে পারছিলেন না বিজ্ঞানীরা৷ করোনা ভাইরাস জুনোটিক, অর্থাৎ, পশু থেকে মানুষে ছড়িয়েছে৷ কিছু করোনা ভাইরাস কাশি বা হাঁচির মাধ্যমেও ছড়াতে পারে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীন থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে পরীক্ষা শুরু হয়৷ জানুয়ারির ২০ তারিখে কর্মকর্তারা নিশ্চিত হন, নতুন এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/YONHAPNEWS AGENCYজানুয়ারির ২৩ তারিখে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুরো উহানকে কার্যত বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে চীন৷ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়৷ শ্রমিকরা দ্রুত হাসপাতাল তৈরি করা শুরু করেন৷ জানুয়ারির ২৪ তারিখের মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু হয়, আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৮৩০ জনে৷ উহানের পাশাপাশি আরো ১২টি শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলে চীন৷ এর প্রভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সাড়ে তিন কোটি মানুষ৷
ছবি: AFP/STRচীনের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নেপাল, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং তাইওয়ানেও ভাইরাসে আক্রান্তের খবর পাওয়া যেতে থাকে৷ আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে৷ কিন্তু জানুয়ারির ২৩ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ‘এখনই’ জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারির সময় হয়নি৷
ছবি: Getty Images/X. Chuজানুয়ারির ২৪ তারিখ ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইউরোপে প্রথম করোনা ভাইরাসে একজন আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ করে৷ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অস্ট্রিয়ায় চার জন আক্রান্ত হওয়ার খবর আসে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Mortagneজানুয়ারির ২৫ তারিখ চীনা নববর্ষ শুরু হয়৷ তবে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে বড় বড় সব অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ৷ জানুয়ারির শেষের দিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা শহরের সংখ্যা পৌঁছায় ১৭-তে, অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন পাঁচ কোটি মানুষ৷ মানুষের যাতায়াত কমাতে নববর্ষের ছুটি বাড়ানো হয় আরো তিন দিন৷
ছবি: Reuters/C. Garcia Rawlinsকম্বোডিয়ায় প্রথম ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ চীন সীমান্তে গাড়ি চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে মঙ্গোলিয়া৷ রাশিয়া পূর্বাঞ্চলের তিনটি সীমান্ত বন্ধ করে দেয়৷ বিশ্বজুড়ে পর্যটন ব্যবসা ও তেলের দামে ধস নামে৷ বিভিন্ন দেশ মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩০০-তে, মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয় ৪১৷ গবেষকরা তিন মাসের মধ্যে ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের আশা প্রকাশ করেন৷
ছবি: Reuters/C. G. Rawlins২৭ জানুয়ারি জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস উহান থেকে জার্মান নাগরিকদের ফেরত আনার ঘোষণা দেন৷ চিকিৎসকরা এর জন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানানো হয়৷ জার্মানির মারবুর্গে গবেষকরা এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Dedert২৭ জানুয়ারিতেই জার্মানিতে প্রথম সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ জার্মানি সফররত চীনা সহকর্মীদের কাছ থেকে বাভারিয়া অঞ্চলের ৩৩ বছর বয়সি এ নাগরিকএ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়৷ মিউনিখের হাসপাতালে তাকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়৷ পরের দিনই তার আরো তিন সহকর্মীর আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়৷ চীনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩২-এ৷
ছবি: Reuters/A. Uyanik২৮ জানুয়ারি জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উহান থেকে নিজেদের নাগরিক সরিয়ে আনে৷ চার নাগরিককে জ্বরে আক্রান্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডও তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দেয়৷ ২০০২ সালে সার্স ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় নতুন এ ভাইরাস, বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত হন ৬০০০ মানুষ৷
ছবি: imago images/Kyodo Newsজানুয়ারির ৩০ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবশেষে জরুরি স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করে৷ তবে সংস্থার মহাসচিব তেদ্রোস আধানম গেব্রেয়েসুস বাণিজ্য ও পর্যটন সীমিত না করতে দেশগুলোকে আহ্বান জানান৷
ছবি: picture-alliance/KEYSTONE/J.-C. Bottপয়লা ফেব্রুয়ারি ১০২ জন জার্মান নাগরিকসহ ১,১২৪ জনকে উহান থেকে বিমানবাহিনীর বিমানে ফ্রাঙ্কফুর্টে নিয়ে আসা হয়৷ গেরমেরশাইমে সেনা ব্যারেক তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তাদের মধ্যে অন্তত দুই জনের ভাইরাস সংক্রমণের খবর মিলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Rumpenhorstউহানে আটকে পড়া বাংলাদেশিদেরও ফেরত নিয়ে আসা হয় ১ ফেব্রুয়ারি৷ বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে ৩১২ জনকে আনা হয় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে৷ সেখান থেকে তাদের সরাসরি আশকোনার হাজি ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ১৪ দিন পরও তাদের কারো মধ্যে সংক্রমণের লক্ষণ মেলেনি৷
ছবি: A. Goni২ ফেব্রুয়ারি চীনের বাইরে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় ফিলিপাইন্সে৷ তবে ৪৪ বছর বয়সি এ ব্যক্তিও চীনা নাগরিক৷ উহান থেকে ম্যানিলা যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি৷ নিউমোনিয়ায় মৃত্যু হয় তার৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Aljibeনতুন করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় উহানে মাত্র ১০ দিনে নতুন হাসপাতাল তৈরি করে তাক লাগায় চীন৷ ৩ ফেব্রুয়ারি চালু হয় দ্য হোশেনশান হাসপাতাল৷ আক্রান্তদের সারিয়ে তুলতে পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতির পাশাপাশি ঐতিহ্যগত চীনা ওষুধও ব্যবহারের কথা জানায় কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: Imago/L. He৩ ফেব্রুয়ারি জাপান উপকূলে ইয়োকোহামায় প্রমোদতরী ডায়মন্ড প্রিন্সেস-এ করোনা ভাইরাস সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়৷ ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখের মধ্যে প্রমোদতরীর ৪৫০ জন ভাইরাসে আক্রান্ত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/kyodo১৩ ফেব্রুয়ারি একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানায় চীন৷ অবশ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা সংক্রমণের তথ্য জানতে নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে৷ আগে কেবল নিউক্লিইক অ্যাসিড পরীক্ষা করা হলেও এখন ফুসফুসের সিটি স্ক্যানও করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP বাইডেনের এই তদন্তের ঘোষণা এসেছে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট প্রকাশের পর। উহানের ভাইরোলজি ল্যাবের কিছু গবেষক বলেছেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের একমাস আগে থেকে সম্ভবত করোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল, যখন তাদের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চীনের সমালোচনা
অ্যামেরিকায় চীনের রাষ্ট্রদূত বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ল্যাব থেকে ভাইরাস লিকের কথা বলেছেন, তা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছাড়া আর কিছ নয়।
কিছু রাজনৈতিক শক্তি এই অতিমারির ভাইরাস নিয়ে চীনের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চায়। এটা পুরোপুরি দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্ত
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে তদন্ত করেছে। তারা চীনেও গিয়েছিল। কিন্তু কোন প্রাণী থেকে এই ভাইরাস এসেছে, তা চিহ্নিত করতে পারেনি। তবে তাদের মতে, ল্যাব থেকে লিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ডনাল্ড ট্রাম্প বারবার করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। তিনি এটাও বলেছিলেন, এই ভাইরাস নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে অনেক তথ্যপ্রমাণ তার কাছে আছে। সেসময় একটা অভিযোগ উঠেছিল, এই ভাইরাস চীনের গবেষণাগারে তৈরি করা হয়েছে। যদিও ট্রাম্প তেমন কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।
জিএইচ/এসজি(এপি, এএফপি, রয়টার্স)