নতুন করোনা ভাইরাসের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে৷ একইসঙ্গে মানুষের ভেতরও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে৷ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরাও এর ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছেন৷ কেউ কেউ বলছেন, পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠেছে৷
বিজ্ঞাপন
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় নতুন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ৷ এখন সারাবিশ্বের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষের ভেতরে মিলেছে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব৷
ধর্মীয় ব্যাখ্যাগুলো
নানা সময়ে মহামারি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে একেক ধর্মে একেকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়৷ যেমন, বাইবেলের উক্তি তুলে ধরে অনেক খ্রিস্ট্রীয় অনুসারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, এমন একটি সময় আসবে ‘যখন একটি রোগে অনেক মানুষ মারা যাবেন৷’
একজন লিখেছেন, ‘‘দুঃখের দিনের শুরু’’- ম্যাথু ২৪:৩-৮৷
আরেকজন ‘যিশু ফিরছেন’ এই হ্যাশট্যাগ দিয়ে লিখেছেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলের আগুন... করোনাভাইরাস... অপ্রচলিত জায়গায় ভূমিকম্প... বিশ্বব্যাপী হিংসা/খুন বেড়ে যাওয়া... ক্ষুধার্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া... আর তারা যারা পুনরুত্থানের কিতাবকে অবজ্ঞা করে৷’’
ইসলাম ধর্মের অনেক অনুসারীও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন৷ অনেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের বারবার হাত ধোয়ার পরামর্শের সঙ্গে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়ার আগে ওযু করার সঙ্গে মিলিয়েছেন৷ অবশ্য বিশেষজ্ঞরা সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে বলেছেন৷
অনেকে হাদিসে বর্ণিত একটি অসুখের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, পৃথিবী শেষ হবার আগে একটি রোগ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে৷ অনেকে কেয়ামতের আগে কাবায় ‘তাওয়াফ’ বন্ধ হবে এই ঘটনার সঙ্গে চলমান করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কাবায় ওমরাহ বন্ধের তুলনা করেছেন৷
অনেক হিন্দু ধর্মের অনুসারীও এ নিয়ে তাদের ব্যাখ্যা হাজির করেছেন৷ অল ইন্ডিয়া হিন্দু মহাসভার সভাপতি স্বামী চক্রপাণি এই ভাইরাসকে একটি ‘রাগী দেবতা’ বলে অভিহিত করেছেন৷
‘‘করোনা ভাইরাস নয়, এটি নিরীহ প্রাণীকে রক্ষার অবতার৷ যারা এদের ভক্ষণ করেন, তাদের মৃত্যু ও সাজার শাস্তি শোনাবার জন্য এরা এসেছে,’’ বলেন তিনি৷
প্লেগ থেকে করোনা: রোগের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে নয়, তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের গবেষণাগারে, এমন গুজব হরহামেশাই ছড়াচ্ছে৷ শুধু করোনা নয়, যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো সব মরণব্যাধী নিয়েই এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিস্তার লাভ করেছে৷
ছবি: zecken.de
প্লেগের কারণ ইহুদিরা
১৪ শতকে ইউরোপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে৷ কারো জানা ছিল না কোথা থেকে এর উৎপত্তি৷ একটা সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ইহুদিরা পরিকল্পিতভাবে এই রোগ ছড়িয়েছে৷ প্লেগের পেছনে আছে ইহুদিরাই; এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন জায়গায় তাদের উপর নির্যাতন শুরু হয়৷ জোরপূর্বক উচ্ছেদও করা হয় অনেককে৷
ছবি: picture-alliance/National Museum of Health and Medicine
স্প্যানিশ ফ্লু জার্মানির অস্ত্র
১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালে স্প্যানিশ ফ্লু প্রায় আড়াই কোটি থেকে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়৷ ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই ভাইরাসের উদ্ভব রহস্য হয়ে ছিল৷ অনেকে মনে করতেন জার্মান সেনাবাহিনী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই জীবাণু আবিষ্কার করে৷
ছবি: picture-alliance / akg
এইডস ছড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
১৯৮০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রে এইডস ছড়িয়ে পড়ে৷ পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে এ নিয়ে গুজব ছড়াতে শুরু করে সোভিয়েত গোয়েন্দা বাহিনী কেজিবি৷ বলা হয় ফোর্ট ড্রেট্রিক-এ জীবাণু অস্ত্র হিসেবে মার্কিনিরা এইচআইভি উদ্ভাবন করেছিল, যা পরবর্তীতে প্রয়োগ করা হয় বন্দী, সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায় এবং সমকামীদের উপর৷ এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি আজও জনপ্রিয়৷
ছবি: Imago Images/ZUMA Press/D. Oliveira
ইবোলার দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের
নব্বইর দশকে এইডস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে৷ কিন্তু এ সময় আফ্রিকায় নতুন করে ইবোলা ছড়িয়ে পড়ে৷ যুক্তরাষ্ট্র এইডস ছড়িয়েছে এমন ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকরা এবার দাবি করল ইবোলার জন্যও তারাই দায়ী৷ সঙ্গে অবশ্য ব্রিটেনকেও জড়ানো হল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পেন্টাগনের এঁটেল পোকা প্রকল্প
২০১৯ সালে রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ক্রিস স্মিথ দাবি করেন পেন্টাগন এঁটেল পোকাসহ বিভিন্ন কীটের মাধ্যমে জীবাণু অস্ত্র তৈরির প্রকল্প চালিয়েছে৷ এই গবেষণা চলেছে ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে৷ স্মিথ সম্প্রতি এ নিয়ে একটি বইও লিখেছেন৷
ছবি: zecken.de
কোভিড-১৯ কৃত্রিমভাবে ছড়ানো
ডিজিটাল যুগে যেকোন ভুল তথ্য আগের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়৷ বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রের গোপন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কথা বারবার সামনে আসে৷ একইভাবে এবার ষড়যন্ত্র তত্ত্বপ্রেমীদের দাবি নভেল করোনা ভাইরাস চীনের কোন গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে৷ সেখান থেকেই তা পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে৷ কেউ কেউ দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্রই জীবাণুটি তৈরি করে চীনে পাঠিয়েছে৷ যদিও এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই৷
ছবি: picture-alliance/ZumaPress/Z. Maulana
6 ছবি1 | 6
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের করোনার মূর্তি তৈরি করে ক্ষমা চাওয়ার দরকার ছিল বলে মনে করেন চক্রপাণি৷
আসাম বিজেপির সদস্য সুমন হরিপ্রিয় দাবি করেন যে, গোমুত্র ও গোবর করোনা ভাইরাসের দূষণ থেকে বাঁচায়৷
বিজ্ঞান কী বলছে?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা ভাইরাস প্রাণী ও মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ছড়াতে পারে৷ এটি ভাইরাসের একটি বিশাল পরিবার যা সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা থেকে শুরু করে শ্বাসকষ্টজনিত জটিল রোগ মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (মার্স-কোভ) ও সিভিয়ার অ্যাক্যুট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম (সার্স-কোভ)-এর কারণ হতে পারে৷
এই পরিবারের নতুন সদস্য নতুন করোনা ভাইরাসটি, যা কোভিড-১৯ নামের নিউমোনিয়াসদৃশ রোগের কারণ হতে পারে৷ এই রোগ মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে৷
সার্স ভাইরাসটি ছড়িয়েছিল সিভেট নামের একরকমের প্রাণী থেকে৷ মার্স ছড়িয়েছিল উট থেকে৷ তবে নতুন করোনা ভাইরাসটি কোথা থেকে ছড়িয়েছে তা এখনো নিশ্চিত নন বিশেষজ্ঞরা৷
এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন এবং এদের প্রায় চার হাজার ৩০০ মারা গেছেন৷ এদের বেশিরভাগই চীনের হুবেই প্রদেশের৷
তবে পৃথিবীতে এর আগে রোগের এর চেয়েও ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব ঘটেছে৷ যেমন চতুর্দশ শতকে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটায় ইউরেশিয়া অঞ্চলের কমপক্ষে সাড়ে সাত কোটি থেকে ২০ কোটি মানুষ মারা গেছেন৷ এই প্লেগকে বলা হত ‘ব্ল্যাক ডেথ'৷ এটি ইঁদুর থেকে ছড়িয়েছিল ও এক রকমের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ৷
১৯১৮ সালে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে পরিচিত ইনফ্লুয়েঞ্জা ৫০ কোটি মানুষকে আক্রমণ করে এবং ১.৭ কোটি থেকে ৫ কোটি মানুষ মারা যান৷ কেউ কেউ অবশ্য বলেন তখন ১০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিলেন৷
আতিফ তৌকির/জেডএ
করোনায় আক্রান্ত মন্ত্রী-এমপিরা
চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস এখন সারা বিশ্বে চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আক্রান্ত এক লাখ ১৩ হাজার ৭০২ জন, মারা গেছেন চার হাজারের বেশি মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/AA/F. Bahrami
নাদিন ডোরিয়াস
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং কনজারভেটিভ এমপি নাদিন ডোরিয়াস করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন৷ নিজ বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে আছেন তিনি৷ তার সঙ্গে দেখা করায় লেবার এমপি র্যাচেল মাস্কেলকেও কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে৷ যুক্তরাজ্যে ৩৮২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ছয় জন৷
ছবি: picture-alliance/empics/S. Rousseau
ফ্রঁঙ্ক রিয়েস্তা
ফ্রান্সের সংস্কৃতিমন্ত্রী ৪৬ বছরের ফ্রঁঙ্ক রিয়েস্তা করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন৷ ফরাসি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, কোয়ারেন্টাইনে তিনি ভালো আছেন৷
ছবি: AFP/B. Guay
আরো পাঁচ ফরাসি এমপি
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ছাড়াও আরো পাঁচজন ফরাসি এমপির করোনা ধরা পড়েছে৷ তারা সবাই ‘আইসোলেশনে‘ আছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Guay
নিকোলা জিঙ্গারেত্তি
চীনের পর ইটালিতেই করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি৷ দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে, মারা গেছেন ৬৩১ জন৷ রোগের বিস্তার ঠেকাতে মঙ্গলবার থেকে দেশটি ‘লকডাউন’ হয়ে আছে৷ ইটালির ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা নিকোলা জিঙ্গারেত্তিও গত সপ্তাহ থেকে করোনার চিকিৎসা নিচ্ছেন৷
ছবি: Reuters/Y. Nardi
ডেভিড সাসোলি
গত সপ্তাহে ইটালি সফর করে আসার পর ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সাসোলি নিজেই কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন৷
ছবি: Imago Images/Pacific Press/
ইরান
ইরানে শীর্ষ পর্যায়ের ২০ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপি ও রাজনীতিক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন৷ মারা গেছেন দুই জন৷