মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক দূরত্বের কঠিন বাস্তবতা
২ এপ্রিল ২০২০
করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে বারবার হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সবার জন্যই কঠিন৷ তবে বিশ্বের ৪৫ কোটি মানুষ এ নিয়ে খুব বড় সংকটে পড়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
ইয়াকুলিন ক্রুৎসমানের ঠান্ডা লেগেছে৷ মানুষ বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাবে- এই চিন্তায় ঘর থেকে বের হচ্ছেন না৷ এদিকে ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে বলে শিশু সন্তানের অস্থিরতা, চঞ্চলতা অনেক গুণ বেড়েছে৷ সারা ঘর জুড়ে চলছে দাপাদাপি৷ সোফায় উঠে লাফালাফি করা খুব প্রিয় খেলা তার৷ কী করবেন ইয়াকুলিন? ওইটুকু বাচ্চাকে তো বেশি বকাঝকা করে লাভ নেই৷ তাই সোফা ছেড়ে বসে পড়লেন মেঝেতে৷ বড় বেশি অসহায় লাগছে তার!
৩৩ বছর বয়সি ইয়াকুলিন ২০ বছর ধরে মনোরোগে ভুগছেন৷ করোনা ভাইরাস তাকে এবং তার মতো সব মনোরোগীকে খুব বড় ধরনের সংকটে ফেলেছে৷
করোনার মোকাবিলায় সংহতি ও হাস্যরস
করোনা সংকট মানুষের অনেক ভালো দিক জাগিয়ে তুলেছে৷ সরাসরি সহায়তা থেকে শুরু করে প্রতীকী পদক্ষেপ অথবা অন্যদের উৎসাহ দেবার অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে৷ এমনই কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যাক৷
ছবি: picture-alliance/TASS/O. Smolskaya
টেডি বেয়ারের সন্ধানে
সপ্তাহের পর সপ্তাহ স্কুল ও কিন্ডারগার্টেন বন্ধ থাকায় বাবা-মায়েরা পড়েছেন সমস্যায়৷ বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের অনেক মানুষ তাই খুদেদের আমোদের ব্যবস্থা করছেন৷ তাঁরা বাচ্চাদের জানালায় টেডি বেয়ার রেখে দিচ্ছেন৷ বাবা-মার সঙ্গে হাঁটতে বের হলে শিশুরা এক মানচিত্র অনুসরণ করে এমন আরও পুতুল খুঁজে পেতে পারে৷
করোনা ভাইরাস বিশেষ করে বয়স্ক মানুষের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে৷ তাঁদের সুরক্ষার জন্য অনেক সুপারমার্কেট বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে৷ দিনের নির্দিষ্ট সময়ে একমাত্র বয়স্কদের বাজারে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Dambarage
দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বৈচিত্র্য
তুরস্কে বয়স্কদের সহায়তা করতে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে৷ ৬৫ বছর ও তার বেশি বয়সের মানুষ অথবা যারা দীর্ঘদিন কোনো রোগে ভুগছেন, সুরক্ষার স্বার্থে তাদের জন্য কার্যত কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে৷ ২৫ বছর বয়সি এক তরুণ বয়স্কদের মনোরঞ্জন করতে তাদের বাসার সামনে গানবাজনার ব্যবস্থা করেছে৷ অন্য কিছু দেশে বৃদ্ধাবাসের সামনে গানের খবর পাওয়া গেছে৷ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে কাউকে তাঁদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে দেওয়া হচ্ছে না৷
ছবি: picture-alliance/AA/M. U. Uysal
সব ঠিক হয়ে যাবে
ইটালির অনেক মানুষ বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে কার্যত গৃহবন্দি রয়েছেন৷ কবে এই দশা শেষ হবে, কেউ জানে না৷ কমপক্ষে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ কার্যকর থাকবে৷ মানুষ পরস্পরকে সাহস জোগাতে অনেক কিছু করছে৷ অনেক জানালা ও বারান্দায় রামধনুর ছবিসহ তিনটি শব্দ শোভা পাচ্ছে, বাংলায় যার অর্থ ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’৷
ছবি: picture-alliance/abaca/IPA/P. Tenagli
ইটালির প্রতি সংহতি
কঠিন সংকটের মাঝেও সংহতিবোধের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে৷ রাশিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমে বেসলান শহরের মানুষ বারান্দায় মোমবাতি জ্বালিয়ে ইটালির প্রতি সংহতিবোধ জানিয়েছে৷ প্যারাগুয়ে, পোল্যান্ড ও বসনিয়ায় শহরের অনেক ভবনে ইটালির পতাকার রংয়ের আলোকসজ্জা দেখা গেছে৷ চীনেও একটি বাসের গায়ে ইটালির প্রতি সংহতি প্রকাশ করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/TASS/O. Smolskaya
চলো ছুটি-ছুটি খেলা যাক
আডাস ভাসিলিয়াউস্কাস করোনা মহামারির কারণে ফটোগ্রাফার হিসেবে কোনো কাজ পাচ্ছেন না৷ দমে না গিয়ে তিনি ড্রোনের মাধ্যমে লকডাউন চলাকালীন লিথুয়েনিয়ার মানুষের কার্যকলাপের ছবি তুলছেন৷ তাতে বেশ কিছু মজার দৃশ্য ধরা পড়ছে৷ ছাদের উপর রোদ পোয়ানো থেকে শুরু করে বারান্দায় ব্যায়ামের ছবিতেই মানুষের মনোভাব ফুটে উঠছে৷ কেউ ছদ্মবেশ পরে খেলছে, কেউ বা আগামী ছুটিতে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখছে৷
ছবি: picture-alliance/Cover Images/A. Vasilauskas
প্রাণীর করুণ দশা
অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের জনজীবনও স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ মানুষ বাসার বাইরে বের হচ্ছে না বলে উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে থাকা প্রাণীও সমস্যায় পড়েছে৷ ঢাকায় স্বেচ্ছাসেবীরা পথের কুকুরের খাদ্যের ব্যবস্থা করছেন৷ জার্মানির পশুকল্যাণ সংগঠনও শহরে অভুক্ত পায়রার হাল সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/S. M. Rahman
সম্মান ও মর্যাদা
অনেক দেশে চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন৷ ইউরোপের কিছু দেশে বিকালে ডাক্তার, নার্স ইত্যাদি পেশার মানুষের এই ভূমিকাকে সম্মান জানাতে হাততালি দেবার রেওয়াজ চালু হয়েছে৷ পাকিস্তানে সাদা পতাকা দুলিয়ে ডাক্তারদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে৷ তবে তাঁদের সহায়তা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো বাসায় থেকে মহামারির গতি কমাতে অবদান রাখা৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/PPI
সমবেত প্রচেষ্টা
গোটা বিশ্বে স্বেচ্ছাসেবীরা সেলাই মেশিন বার করে সহজ মাস্ক তৈরি করছেন৷ তবে এভাবে সংক্রমণ এড়ানো সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না৷ একমাত্র মুখ ও নাক ঠিকমতো ঢাকতে পারলে কমপক্ষে ভাইরাস ছড়ানো বন্ধ করা যায়৷ আর্মেনীয়-সিরীয় এই নারীরা যে মাস্ক তৈরি করছেন, সেগুলি আলেপ্পোর মানুষের কাছে বণ্টন করা হবে৷
ছবি: Getty Images/AFP
ফাউ হিসেবে টয়লেট পেপার
বর্তমান সংকটের সময় শুধু জার্মানিতেই টয়লেট পেপারের আকাল দেখা যাচ্ছে না৷ অ্যামেরিকার মিনেসোটা রাজ্যে এক রেস্তোরাঁয় ২৫ ডলারের বেশি মূল্যের খাবার অর্ডার দিলে বিনামূল্যে একটি টয়লেট পেপারের রোল পাওয়া যাচ্ছে৷ মালিক বলেছেন, ক্রেতারা সেটা পেয়ে মন খুলে হাসছেন৷ সেটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো পাওনা৷ বলা বাহুল্য, বিপণন কৌশল হিসেবে এমন চমক সত্যি কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/CBG/Cover Images
10 ছবি1 | 10
মহাসঙ্কটে ৪৫ কোটি মানুষ
এ মুহূর্তে বিশ্বের অন্তত ৪৫ কোটি মানুষ মনোরোগে ভুগছেন৷ ড্রেসডেন বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের ডিপার্টমেন্ট অফ সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড সাইকোথেরাপির সিনিয়র ফিজিশিয়ান এবং জার্মান সোসাইটি ফর সুইসাইড প্রিভেনশন-এর চেয়ারম্যান উটে লেভিৎসকা জানালেন, করোনা ভাইরাসের কারণে মনোরোগীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেড়েছে৷ তার কথায়, ‘‘যারা মনোরোগে ভুগছেন তাঁরা পিঠে একটা বাড়তি বোঝা বহন করেন৷ কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন বোঝাটাকে তুলনামূলকভাবে হালকা মনে হয়৷ তখন দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ভালোভাবে খাপ খাওয়ানো যায়৷ তবে কখনো কখনো এমন সময়ও আসে যখন সেই বোঝাটাই অনেক বেশি ভারী মনে হয়৷ বাইরের চাপ বা চাপে থাকার মতো পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে তাদের জীবন তখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে৷''
ইয়াকুলিন ভালোই ছিলেন৷ স্বাভাবিক নিয়মেই চলছিল জীবন৷ কিন্তু করোনাভাইরাস হঠাৎ বদলে দিয়েছে সবকিছু৷ এখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ৷ কাজ করতে হয় ঘরে বসে৷ বন্ধু বা আপনজনদের ফোন করে মনটাকে একটু চাঙ্গা করে নিতেও তার বাধে৷ কেউ যদি বিরক্ত হয়? যদি বিষয়টাকে অন্যভাবে নেয়?
মনোরোগ, ডিপ্রেশন এবং বিপদ
কেউ কেউ করোনা ভাইরাসকে বড় বেশি ভয় পাচ্ছেন৷ চোখে দেখা যায় না, কোথায় আছে কোথায় নেই তা-ও বলা যায় না- এমন বিপদকে বেশি ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ তবে শারীরিকভাবে সুস্থ হলে মনে জোর থাকে৷ দুর্বল শরীরের মনেরোগীদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷
থেরাপির পথেও করোনা ভাইরাসের বাধা
আগে চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করে পরামর্শ নেয়া যেতো৷ এখন রোগী আর চিকিৎসক দু'জনকেই সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মানতে হচ্ছে৷
বিকল্প পথ
এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে বা ভিডিওকলে আলোচনা করাকে বিকল্প হিসেবে দেখছেন অনেকে৷ ‘হ্যালোবেটার' নামের অনলাইন পোর্টালের প্রতিষ্ঠাতা ও সায়েন্টিফিক ডিরেক্টর ডেভিড ড্যানিয়েল জানালেন, মনোরোগীদের সেবা দিতে টেলিফোন হটলাইন খুলেছেন তারা৷ সেখানে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে বিশেষ পরিস্থিতিতে সব সমস্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখার পরামর্শ৷
দূর থেকে এভাবে পরামর্শ নেয়ায় অবশ্য ইয়াকঙলিন এবং তার মতো অনেকের আস্থা নেই৷
আনা কার্টহাউস/এসিবি
বয়স্কদের যেভাবে করোনা থেকে বাঁচাবেন
করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে প্রবীণদের। যাদের বয়স একটু বেশি, তাদের পাশে কিভাবে থাকবেন? পাশে থেকে কিভাবে নিজেকেও বাঁচাবেন?
ছবি: AFP/Getty Images/T. Mustafa
আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি যাদের বেশি
বয়স যাদের ৬৫ বছরের বেশি, করোনায় সংক্রমিত হলে তাদের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা অন্য কোন জটিল রোগ থাকলে এর চেয়ে কম বয়সিদেরও করোনাভাইরাসে মৃত্যু হতে পারে।
অনেক দেশে প্রবীণদের অন্তত ১২ সপ্তাহ ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। চিকিৎসকদের পরামর্শ, এই সময় প্রবীণদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে অন্তত এক মিটার, অর্থাৎ তিন ফুট দূরে থেকে কথা বলতে হবে। চুমু খাওয়া বা আলিঙ্গন করা যাবে না।
ছবি: Imago/Science Photo Library
হাত ধুয়ে নিতে ভুলবেন না
ঘরের বাইরে গেলে এখন এমনিতেই সবার স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নেয়া উচিত। প্রবীণদের কাছাকাছি গেলেও এই নিয়ম মানতে হবে।
ছবি: Imago Images/Panthermedia
দেখা কম করা ভালো
এমনিতে দেখা কম করা ভালো। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া দেখা না করে ফোন করে, চিঠি লিখে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায় প্রবীণদের খোঁজখবর নেয়া যেতে পারে।
ছবি: Colourbox
প্রবীণদের যা যা করতে হবে
করোনার আতঙ্ক নিয়ে প্রবীণদের পক্ষে একা থাকা খুব কঠিন। সময় কাটাতে তাদের ঘর পরিষ্কার করা নাচা বা বসে বসে করা যায় এমন ব্যায়ামে মন দিতে হবে। এছাড়া সূর্যের আলো আর মুক্ত বাতাস যতটা সম্ভব গায়ে লাগাতে হবে।