একই রোগ হলেও করোনা ভাইরাসে বিভিন্ন দেশে মৃত্যু হারে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য৷ এর কারণ কী? কিভাবে কিছু কিছু দেশ মৃত্যুর হার কমিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছে, ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছে সংক্রমণের প্রকোপও?
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী শনিবার পর্যন্ত দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ধরা পড়েছেন মাত্র ৪৮ জন৷ এর মধ্যে মারা গেছেন পাঁচজন৷ অর্থাৎ আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার প্রায় ১০ দশমিক চার দুই ভাগ৷ ইটালিতে এই হার দশ দশমিক দুই ভাগ, স্পেনে সাত দশমিক ছয় ভাগ৷ কিন্তু ইউরোপের অন্য দেশ জার্মানিতেই মৃত্যু হার মাত্র দশমিক ছয় ভাগ৷
হিসাবটি আরো সহজ করে বললে, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতি দশ লাখে ইটালিতে মারা যাচ্ছেন ১২৪ জন, স্পেনে ৭৮ জন, ইরানে ২৫ জন, ফ্রান্সে ২০ জন, যুক্তরাজ্যে সাতজন করে৷ অন্যদিকে জার্মানিতে দশ লাখে মৃত্যুর অনুপাত দুই দশমিক চার আটজন৷ যেই চীন থেকে এই ভাইরাসের উদ্ভব সেখানে দুই দশমিক তিন ছয় জন৷
মৃত্যু হারের এই পার্থক্যের বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ কোন দেশে কতজন মারা যাচ্ছেন তা নির্ভর করছে জনসংখ্যায় বয়সের অনুপাত, দেশগুলোর স্বাস্থ্য সেবার সক্ষমতা আর সবশেষে কতজনকে পরীক্ষা করা হচ্ছে তার উপর৷ শেষেরটির উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সংস্থাটি৷
কতজনকে পরীক্ষা করা হয়েছে?
আন্দ্রেয়াস ব্যাকহাউস নামের একজন জার্মান অর্থনীতিবিদের হিসাবে ইটালিতে করোনায় আক্রান্ত মানুষদের গড় বয়স ৬৩ বছর, জার্মানিতে তা ৪৫৷ জার্মানির তুলনায় ইটালি অল্প বয়সের নাগরিকদের করোনা পরীক্ষার আওতায় কম আনছে, এই পরিসংখ্যান অনেকটা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে৷ ইটালির গণমাধ্যমগুলোতেও এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হয়েছে৷ সেখানে অনেক সম্ভাব্য রোগীই করোনা পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন৷ এমনকি যারা মারা যাচ্ছেন তাদেরও অনেকে পরীক্ষার আওতায় আসছেন না৷
অন্যদিকে ঠিক বিপরীত চিত্র দক্ষিণ কোরিয়াতে৷ দেশটি কমপক্ষে তিন লাখ জনগণের করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা করেছে৷ তার মধ্যে নয় হাজার জনের সংক্রমণ ধরা পড়েছে৷ বড় আকারে পরীক্ষার উদ্যোগের কারণে তারা সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই নিয়ন্ত্রণে রাখতে সফল হয়েছে৷
করোনা আতঙ্ক থেকে নিরাপদ থাকতে যা করতে পারেন
করোনা ভাইরাস বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়েছে বটে, কিন্তু এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে বা নিজে আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নেই৷ বরং এই মুহূর্তে নিজেকে ফিট রাখা এবং সচেতন থাকাটাই বেশি জরুরি৷
ছবি: Imago Images/photothek/U. Grabowsky
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো জরুরি
শারীরিকভাবে যারা দুর্বল এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদেরকে যে কোনো ধরনের ভাইরাস খুব সহজে আক্রমণ করতে পারে৷ তাই সকলেরই এখন নিয়মিত যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, লেবু এবং বিভিন্ন ফল খাওয়া প্রয়োজন৷
ছবি: Fotolia/Dino Osmic
আদা ও লেবু পানি
এক গ্লাস গরম পানিতে দুই টুকরো আদা এবং একটু লেবুর রস দিয়ে দিন৷ তারপর ধীরে ধীরে তা পান করুন৷ এভাবে দিনে কয়েক গ্লাস পানি পান করতে পারেন৷ তাছাড়া অন্যান্য সময়ের চেয়ে এখন বেশি পানি পান করা জরুরি৷
ছবি: Imago Images/Rüdiger Wölk
জিঙ্ক
এখন জরুরি ভিটামিন ডি-৩ এবং জিঙ্ক যা, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখে৷ রাতে ১৫ মিলিগ্রাম জিঙ্ক ট্যাবলেট সেবন করতে পারেন৷ তাছাড়া বীজ জাতীয় খাবারে জিঙ্কের উপস্থিতি যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে করোনা ভাইরাসকে দূরে রাখতে এই পরামর্শগুলো দিয়েছেন জার্মান চিকিৎসক ডা. আনে ফ্লেক৷
ছবি: imago images/McPHOTO
নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন
জার্মানির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রবার্ট কখ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ডা. লোথার এইচ ভিলার এক টিভি সাক্ষাৎকারে জনগণকে যে কোনো ধরনের জনসমাগম থেকে দূরে থাকার অনুরোধ করেছেন৷ যে কোনো মানুষের কাছ থেকে কমপক্ষে দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি৷
ছবি: Reuters/E. Lopez
জীবাণু থেকে সাবধান
এই মুহূর্তে ভালোভাবে হাত ধোয়া খুবই জরুরি, তবে তা শুধু নিজের বাড়ি, অফিস বা কাছাকাছি কোনো বাথরুম থাকলেই সম্ভব৷ তাই বাইরে থাকাকালীন সময়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন আরেক জার্মান ডাক্তার ডা. এরন্সট টাবোরি৷
ছবি: AFP/S. Bozon
পয়সা বা কয়েন থেকে সাবধান!
হাজারো হাত ঘুরে পয়সা আমাদের হাতে আসে৷ আর সেকারণেই কয়েন বা ভাঙতি পয়সায় যে জীবাণু থাকে তা হয়তো অনেকেরই জানা৷ তাই কেনাকাটার সময় এদিকেও সচেতন থাকার পরামর্শ রয়েছে ডা. টাবোরি৷
ছবি: Colourbox/A. Makarov
6 ছবি1 | 6
জনস্যংখ্যায় বয়সের অনুপাত কত?
করোনা ভাইরাসে বয়স্করাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে৷ ভাইরাসটি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়৷ ইটালিতে মৃত্যু হার বেশি হওয়ার জন্য বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেশিকেই অনেকে দায়ী করে থাকেন৷ কিন্তু জার্মানি আর ইটালি দুই দেশেরই মানুষের গড় বয়স ৪৬ করে৷ তারপরও তাদের মৃত্যু হারে তফাতের কারণ কী?
অনেকের মতে কোন দেশ কত আগে আক্রান্ত হয়েছে এবং কবে থেকে আক্রান্তরা মারা যেতে শুরু করেছেন তার উপর মৃত্যুহার নির্ভর করছে৷ কেউ কেউ মনে করেন জার্মানি এখনও মহামারির সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছেনি৷ সেই জায়গায় যখন তারা পৌছাবে মৃত্যুহারও তখন বেড়ে যাবে৷
স্বাস্থ্য সেবা কার কেমন?
এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোন দেশের স্বাস্থ্যসেবা কতটা সক্ষম সেটিও বড় ভূমিকা রাখছে৷ করোনা ভাইরাসে সঙ্কটাপন্ন রোগীদের বাঁচাতে প্রয়োজন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র৷ হাসপাতালগুলোতে থাকতে হবে পর্যাপ্ত শয্যা আর নিবিড় পর্যবেক্ষণের যন্ত্রাদিও৷ এইসব সুবিধা যেসব রোগীরা পাবেন তাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, না পেলে থাকে মৃত্যু ঝুঁকি৷
ইটালিতে জনসংখ্যা মোট ছয় কোটি৷ সেখানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার সময় হাসপাতাগুলোতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ শয্যার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার৷ অন্যদিকে আট কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে জার্মানিতে এই ধরনের শয্যা আছে ২৮ হাজার৷ এই সংখ্যা শিগগিরই দ্বিগুণ করার প্রক্রিয়াও চলছে৷
প্রতি লাখ মানুষের বিপরীতে জার্মানির হাসপাতালগুলো আইসিইউ শয্যা সুবিধা আছে ২৯ টি আর যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪টি৷ যেখানে ইটালিতে রয়েছে ১২ টি আর স্পেনে ১০ টি৷ শেষের দুইটি দেশেরই মৃত্যু হার অন্য দেশগুলোর চেয়ে তুলনামূলক বেশি৷
কিন্তু উল্টো চিত্রও আছে৷ প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে নিবিড় পর্যবেক্ষেণ সুবিধা সম্বলিত শয্যার সংখ্যা মাত্র দশটি দক্ষিণ কোরিয়াতেও৷ কিন্তু তারপরও মৃত্যু হার তারা এক ভাগের নীচে নামিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, খুব দ্রুত সংক্রমণের হারও কমিয়েছে৷ যা সম্ভব হয়েছে হোম কোয়ারান্টিনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার মধ্য দিয়ে৷
গুডরুন হাইসা/এফএস
করোনার নতুন এপিসেন্টার কি যুক্তরাষ্ট্র?
যুক্তরাষ্ট্রে করোনা ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে দেশটি মারাত্মক সংক্রামক এই রোগের নতুন এপিসেন্টারে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও)।
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/M. Delacroix
আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে
চীন ও ইটালির পর এখন করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যায় তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ডব্লিউএইচওর মুখপাত্র মার্গারেট হ্যারিস ২৪ মার্চ এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় যত নতুন আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ৮৫ শতাংশের বেশি ইউরোপ ও আমেরিকার বাসিন্দা।
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/M. Delacroix
যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত ও মৃত্যু
জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্যানুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ৪৬ হাজার ৪৮১। মারা গেছেন প্রায় ৬০০ জন।
ছবি: picture-alliance/Zuma/Sopa/R. Utrecht
মারাত্মক ঝুঁকিতে নিউ ইয়র্ক
নিউ ইয়র্ক টাইমসের তথ্যানুযায়ী নিউ ইয়র্কে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সোমবার একদিনেই নতুন আক্রান্ত হয়েছেন চার হাজারের বেশি মানুষ।
ছবি: picture-alliance/EibnerT. Hahn
ইটালিতে কমছে আক্রান্তের সংখ্যা
মোট আক্রান্তে এখনো চীনকে অতিক্রম না করলেও মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকদিন আগেই চীনকে ছাড়িয়ে গেছে ইটালি। দেশটিতে প্রতিদিনই মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। তবে আশার কথা কয়েক সপ্তাহ ধরে পুরো দেশ লকডাউন করে রাখায় সেখানে নতুন আক্রান্তের সংখ্যা গত ১৯ মার্চ থেকে কমতে শুরু করেছে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/L. Bruno
বিশ্বে দ্রুত ছড়াচ্ছে করোনা
চীনের উহানে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এক লাখে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল ৬৭ দিন। তারপর দুই লাখ হতে সময় লেগেছে ১১ দিন। আর মাত্র চারদিনে আরো একলাখ নতুন আক্রান্ত হয়েছে।
ছবি: picture-alliance/abaca/Ipa/C. Carlo
ঘরে থাকুন, দূরে থাকুন
করোনার এই বিস্তার রোধের একমাত্র উপায় ঘরে থাকা এবং পরষ্পরের মধ্যে দূরত্ব বজায় রাখা। তাহলেই একজন থেকে আরেক জনে সংক্রমণের ভয়াবহ এ চক্র ভাঙ্গা সম্ভব হবে। দূরত্ব বজায় রাখাই এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র হাতিয়ার।