করোনাকালে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে গোটা বিশ্বেই৷ মনস্তত্ত্ববিদরা এর পিছনে মন-সামাজিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
কয়েক দিন আগে গল্প হচ্ছিল মন-সমাজবিদ মোহিত রণদীপের সঙ্গে৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এই মানুষটি বেশ কয়েক বছর ধরে মনের উপর সমাজের প্রভাব কীভাবে পড়ে, এবং তা থেকে কত রকম মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে, এ বিষয়ে কাজ করছেন৷ করোনার শিকার মোহিত প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন একটি সরকারি হাসপাতালে৷ বলছিলেন, একজন করোনা রোগীকে কতরকম তাচ্ছিল্যের এবং আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে সেখানে৷
শুধু তাচ্ছিল্য নয়, শুধু আক্রমণ নয়, করোনাকালে গোটা বিশ্বেই আসলে সহিংসতা এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে৷ অসভ্য বর্বর আচরণ করছে আপাত সুশীল সমাজ৷ এমন নয় যে, করোনার আগে পৃথিবী স্বর্গরাজ্য ছিল, কোথাও কোনো ক্রাইম, সংঘাত, আক্রমণ ছিল না৷ ছিল, সবই ছিল৷ কিন্তু করোনাকালে তা যেন এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে৷ কেন? মনস্তত্ত্বিদদের কাছে এই প্রশ্নটিরই উত্তর খুঁজছিলাম৷ একেকটি ঘটনা ধরে জানতে চাইছিলাম, করোনাকাল না হলে কী এমন ঘটনা ঘটতো? উত্তরে পরে যাবো৷ প্রথমে এক নজরে ঘটনাগুলি দেখে নেওয়া যাক৷ ইচ্ছে করেই নানা ধরনের ঘটনার উল্লেখ করছি যাতে গোটা সমাজের চিত্রটি পাওয়া যায়৷
একমাসে খবরে আসা নির্মমতার আট ঘটনা
৯ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর৷ এই এক মাসে বাংলাদেশের কিছু মানুষের নির্মম আচরণের উদাহরণ তুলে ধরা হচ্ছে ছবিঘরে৷
ছবি: bdnews24.com
গরু চুরির অপবাদে নির্যাতন
২১ আগস্ট গরু চুরির অপবাদ দিয়ে পারভিন বেগম, তার দুই মেয়ে, এক ছেলে ও ছেলের বন্ধুকে কোমরে রশি বেঁধে প্রকাশ্যে রাস্তায় হাঁটিয়ে মারধর করতে করতে কক্সবাজারের চকরিয়ার হারবাং ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে৷ সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিরানুল ইসলাম মিরানও তাদের মারধর করেন৷ বুধবার মিরানসহ আটজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
নৈশপ্রহরীকে পিটিয়ে হত্যা
রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শঠিবাড়ির বাজারে নৈশপ্রহরীর চাকরি করতেন ৬০ বছরের তসলিম উদ্দিন৷ ৯ আগস্ট ঐ বাজারের এক মুদি দোকানে চুরি হলে দোকান মালিক জামিলুর রহমান (২৮) চুরির সঙ্গে তসলিম জড়িত থাকতে পারেন সন্দেহ করে তাকে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে বেঁধে মারধর করে৷ পুলিশ তসলিমকে হাসপাতালে নেয়ার উদ্যোগ নেয়, তবে পথেই তিনি মারা যান৷ জামিলুর রহমান ও তার ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
শিশু কেন্দ্রে তিন কিশোরের মৃত্যু
১৩ আগস্ট যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়, আহত হয় ১৫ জন৷ কর্তৃপক্ষের দাবি, কিশোরদের দুই দলের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে৷ তবে আহত কিশোরদের ভাষ্য, কেন্দ্রের প্রধান নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে কেন্দ্র কর্মকর্তা, আনসার সদস্য ও তাদের ‘অনুগামী’ কয়েকজন কিশোরের মারধরে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে৷ কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক ও সহকারী তত্ত্বাবধায়কসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
ছবি: bdnews24.com
চুরির অপবাদ দিয়ে মারধরের অভিযোগ
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চররমনী মোহন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ ছৈয়াল ২০ শতক জমি পেতে আমির হোসেনকে অনেকদিন ধরে চাপ দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ৷ এতে রাজি না হওয়ায় ২৩ আগস্ট রাতে চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে আমির হোসেনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান৷ পরে জ্ঞান ফিরলে মামলা না করতে ও চিকিৎসা না নিতে সাদা কাগজে সই নেয়া হয় বলে দাবি তার৷ চেয়ারম্যান ছৈয়াল সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷
ছবি: bdnews24.com
শ্বশুর-শাশুড়ির হাতে গৃহবধূ নির্যাতন
৩ সেপ্টেম্বর পিরোজপুর জেলার আমারগাছিয়া ইউনিয়নের মানিকখালী গ্রামে সৌদি আরব প্রবাসী ছেলের বউ-এর সাথে শাশুড়ি আলেয়া বেগমের পারিবারিক বিষয়ে তর্ক শুরু হয়৷ এক পর্যায়ে শ্বশুর, শাশুড়ি ও চাচা শ্বশুর মিলে গৃহবধূকে নির্যাতন করেন৷ ঐ গৃহবধূর মেয়ের করা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ৫ সেপ্টেম্বর রাতে মামলা হয়৷ এরপর শাশুড়িকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: bdnews24.com
চোর সন্দেহে শিশু পেটানো
ময়মনসিংহের সদর উপজেলার চর ভবানীপুর এলাকায় ৩ সেপ্টেম্বর মোবাইল ফোন চোর সন্দেহে ১২ ও ১৭ বছর বয়সি দুই শিশুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে পেটানো হয়৷ ঘটনার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ৬ সেপ্টেম্বর দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তাদের একজন গোলাম মোস্তফার (৪৫) নিজের মেয়ের মোবাইল চুরি করেছে সন্দেহে ঐ দুই শিশুকে পিটিয়েছিলেন৷
যৌতুক না পাওয়ায় এই নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ৷ ময়মনসিংহের নান্দাইলে ৬ সেপ্টেম্বর এই ঘটনা ঘটে৷ সেদিন কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে জুয়েল মিয়া (২৮) স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ফাহিমা সুলতানার (২২) মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষতবিক্ষত করেন৷ পরে বাঁশ দিয়েও মারধর করেন৷ এতে ফাহিমা অচেতন হয়ে যান৷ হাসপাতালে নেয়ার দুদিন পর মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি৷ স্বামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Keystone USA Falkenberg
পায়ে শিকল বেঁধে শিশু নির্যাতন
দিনাজপুরের বিরামপুরের ত্বালিমউদ্দীন ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র মো. মারুফ হোসেনকে (১০) ৮ সেপ্টেম্বর পায়ে শিকল বেঁধে লাঠি দিয়ে হাত, মাথা, পিঠসহ বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়েছে৷ এই অপরাধে মাদ্রাসার মোহতামিম লুৎফর রহমানকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে৷ মারধরের এক পর্যায়ে মারুফ নিস্তেজ হয়ে পড়লে লুৎফর ঘর থেকে বের হন৷ এই ফাঁকে মারুফ পালিয়ে পাশের ধানক্ষেতে আশ্রয় নেয়৷ স্থানীয় থানার ওসি তাকে উদ্ধার করেন৷
ছবি: picture alliance/dpa/Michelle Shephard
8 ছবি1 | 8
অ্যামেরিকার পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া যাক৷ রাজনৈতিক পক্ষপাতে না গিয়েই বলা যায়, করোনার এক মাস আগেও মার্কিন বিশ্বে ডনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট ছিল৷ তার মানে এই নয়, ট্রাম্পের আমল খুব নিষ্কন্টক৷ বহু অন্যায়, বহু অপরাধ হয়েছে৷ কিন্তু কোনো কিছুই এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে, ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্সে’র মতো একটি লাগাতার আন্দোলন গড়ে উঠবে৷ হয়েছে তো! করোনার আগেও ‘বর্ণবাদী’ মার্কিন পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গকে অপমান করেছে৷ মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট৷ শরণার্থীদের নিয়ে অন্যায় রাজনীতি হয়েছে৷ কিন্তু করোনাকালে জর্জ ফ্লয়েডের গলায় পা দিয়ে যেভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, তা এক কথায় বর্বর৷ ফ্লয়েডের হত্যা ঘিরে আন্দোলন হয়েছে৷ সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আরো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ পুলিশের নির্লজ্জ চেহারা আরো স্পষ্ট হয়েছে৷
অসভ্যতা কেবল অ্যামেরিকায় হয়নি৷ জার্মানির রাজধানী বার্লিনে মাস্কবিরোধী মিছিলও অসহিষ্ণুতার অন্যতম উদাহরণ৷ যে কোনো বিষয়েই এক শ্রেণির মানুষের বিরোধিতা থাকতে পারে৷ বিতর্ক থাকতে পারে৷ কিন্তু সময়ের কথা মাথায় রেখে সভ্য মানুষ কোনো কথা বলেন, কোনো কাজ করেন, কোনো কোনো বিষয় থেকে নিজেকে বিরত রাখেন বৃহত্তর সমাজের মঙ্গলের কথা ভেবে৷ বার্লিনে মাস্কবিরোধী মিছিল সেই সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যে কাণ্ড করেছে, ইতিহাস তা ক্ষমার চোখে দেখবে না৷ যেমন ইতিহাস মনে রাখবে জার্মানির ওই মা-কে৷ ডুসেলডর্ফের কাছের একটি শহরে ছয় সন্তানকে নিয়ে থাকতেন তিনি৷ পাঁচ সন্তানকেই হত্যা করেছেন তিনি৷ নিজেও আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তবে বেঁচে গিয়েছেন৷ জার্মানিতে এমন ঘটনা অভূতপূর্ব৷
জার্মানিতে যা অভূতপূর্ব, ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মতো দেশে তা ততটা অস্বাভাবিক নয়৷ খাদ্যের অভাবে গোটা পরিবার আত্মহত্যা করছে, কিংবা বাবা অথবা মা হত্যা করছেন ছেলেমেয়েদের-- এমন খবর হরদম না হলেও মাঝে মধ্যেই শোনা যায়৷ ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি ভারতীয় উপমহাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷ কিন্তু করোনাকালে তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে৷ করোনা সেন্টারে ঢুকে রোগীকে ধর্ষণ করা হয়েছে ভারতে৷ অ্যাম্বুলেন্সের চালক গাড়িতেই রোগীকে ধর্ষণ করেছে৷ বিভিন্ন শহরে ক্রাইম রেট চোখে পড়ার মতো বেড়েছে৷ করোনাকালে পারিবারিক হিংসা শুধু ভারতেই বেড়েছে ৩৩ শতাংশ৷ বস্তুত গোটা পৃথিবীতেই করোনাকালে পারিবারিক হিংসা লাফিয়ে বেড়েছে৷ বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণও৷
ধর্ষক কেন, কী ভেবে ধর্ষণ করে?
ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সময় কীভাবে কাজ করে ধর্ষকের মন ও মস্তিষ্ক? এ সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানী কী বলেছেন তা বিস্তারিত জানুন ছবিঘরে...
ছবি: Getty Images/China Photos
সব সময় যৌনসুখ মুখ্য নয়
সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শেরি হামবির মতে, ‘‘ধর্ষণ যৌনসুখের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপরপক্ষকে দমিয়ে রাখতে ক্ষমতার প্রদর্শন হিসাবে করা হয়৷’’ কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষমতার প্রকাশ শুধু নারীদের বিরুদ্ধে হয়৷ অন্যদিকে, ধর্ষণ কাজ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘জাতে ওঠার’ পন্থা হিসাবে৷ এছাড়া ধর্ষণের পেছনে রয়েছে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, যা বুঝতে বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন৷
ছবি: Getty Images
কে ধর্ষক?
মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক ড. স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান একটি গবেষণার জন্য ৫০জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নেন৷ সেখানে তিনি বুঝতে পারেন যে, কয়েকটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক বা ভাষা বা ধর্মগোষ্ঠী থেকেই উঠে আসবে ধর্ষকামী চিন্তা, তা নয়৷ ধর্ষক উঠে আসতে পারে যে কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে৷ পাশাপাশি এক ধর্ষক থেকে আরেক ধর্ষকের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বৈচিত্র্যও লক্ষ্য করেন তিনি৷ ধর্ষণের উদ্দেশ্যও সেখানে থাকে ভিন্ন৷
ছবি: Gina Sanders - Fotolia.com
উদ্দেশ্য ভিন্ন, কিন্তু চারিত্রিক মিল
ড. স্মিথিম্যানের গবেষণা বলছে, প্রতিটি ধর্ষণের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও বেশির ভাগ ধর্ষকের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়৷ এর মধ্যে রয়েছে নার্সিসিজম বা আত্মমুগ্ধতা, নারীবিদ্বেষ ও অন্যের প্রতি সার্বিক সহানুভূতির অভাব৷ এছাড়া, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ধর্ষকদের মধ্যে নিজের অপরাধের প্রতি ঔদাসীন্য লক্ষ্য করেন৷
ছবি: Getty Images
ধর্ষণ করে ‘জাতে ওঠা’!
গবেষক শেরি হামবি বলেন, ‘‘তরুণরা যৌন অভিজ্ঞতার সাথে সম্মানকে মেলায়৷ এটিকে এক ধরনের জয় হিসাবে দেখে তারা৷ যাদের বেশি যৌন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা হয়৷’’ এই ‘জাতে উঠতে চাওয়ার’ আকাঙ্খা থেকে ধর্ষণ করাকে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা ক্ষতিকারক পৌরুষের লক্ষণ হিসাবে দেখেন তিনি৷ ওপরের ছবিতে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: AFP/Abaad/P. Baz
ধর্ষণ একটি অপরাধ
শেরি হামবি এবং স্মিথিম্যান মনে করেন, ধর্ষণ কোনো বিশেষ মানসিক রোগ নয়, এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ কোনো কোনো ধর্ষকের মধ্যে বিশেষ কিছু মানসিক রোগের লক্ষণ দেখা গেলেও এমন কোনো নির্দিষ্ট মানসিক রোগের সন্ধান পাওয়া যায়নি যা ধর্ষণ করতে বাধ্য করে৷
ছবি: Getty Images/China Photos
নানা ধরনের ধর্ষকামী মানসিকতা
ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জয়দীপ সরকার ধর্ষকামী মানসিকতার মোট ছয়টি রূপকে চিহ্নিত করেছেন৷ এর মধ্যে রয়েছে সুযোগসন্ধানী ধর্ষক, স্যাডিস্টিক ধর্ষক, প্রতিহিংসাকামী ধর্ষক, কল্পনাপ্রবণ ধর্ষক, ক্ষমতালোভী ধর্ষক ও ক্ষুব্ধ ধর্ষক৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন ধর্ষকের মধ্যে একাধিক ধর্ষকামী মানসিকতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, বলে জানাচ্ছে সেই গবেষণা৷
ছবি: picture-alliance/F. May
বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব
ধর্ষকের মনস্তত্ত্বকে বোঝার উপায় কী হবে, এই প্রশ্ন বিভক্ত করেছে বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারার গবেষকদের৷ সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদরা ধর্ষণকে যৌনতা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে একে নিছক ক্ষমতার প্রকাশ হিসাবে দেখেন৷ অন্যদিকে, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান ও নৃতত্ত্বের গবেষক র্যান্ডি থর্নহিল ও ক্রেগ পামারের মতে, ধর্ষণের মূল উদ্দেশ্য যৌনতাই৷ ওপরের ছবিতে ব্রাজিলের সাওপাওলো শহরে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয়া এক নারী৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ধর্ষণের যত ‘মিথ’
ধর্ষণ বিষয়ে বেশ কিছু মিথ বা ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত রয়েছে৷ উদাহরণস্বরূপ, অনেক ক্ষেত্রেই একটি মিথ কাজ করে, যেখানে ধর্ষক আশ্বস্ত হয় যে, অপর পক্ষ যতই বারণ করুক বা বাধা দিক না কেন, বাস্তবে তারও এতে সম্মতি রয়েছে৷ মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক আন্টোনিয়া অ্যাবের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে এমন মিথে বিশ্বাসী এক ধর্ষকের বয়ান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/C. Klose
গবেষণার প্রাসঙ্গিকতা
মনস্তত্ত্বের আনাচ-কানাচ নিয়ে প্রতিদিন প্রকাশ পাচ্ছে বহু গবেষণা৷ এর একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ধর্ষণকে বুঝতে চাওয়া চেষ্টা৷ বিভিন্ন চিন্তাধারার বা অ্যাকাডেমিক ডিসিপ্লিন নিজেদের মতো করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে৷ এতে করে গভীরে গিয়ে চিহ্নিত করা যাচ্ছে ধর্ষণের নানা দিক৷ ধর্ষণ রুখতে ও ধর্ষকের মনস্তাত্ত্বিক ঝোঁক চিহ্নিত করতে কাজে লাগানো হচ্ছে এমন গবেষণাকে৷
ছবি: Ambrophoto - Fotolia.com
9 ছবি1 | 9
বাংলাদেশের পরিস্থিতিও একই রকম৷ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের উপর আক্রমণের ঘটনাই ধরা যাক৷ দিবাগত রাতে যেভাবে বাড়ির ভিতর ঢুকে হামলা হয়েছে৷ হাতুড়ি পেটা করা হয়েছে, তা এক কথায় ভয়াবহ৷ সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রশাসন যাদের আটক করেছে, তাদের জেরা করেও ওই হামলার স্পষ্ট কোনো কারণ এখনো বোঝা যায়নি৷ কেবলমাত্র চুরির উদ্দেশে এমন নৃশংসতা?
আর পারিবারিক সহিংসতা? পিরোজপুরের ঘটনা এখনও টাটকা৷ সৌদি আরব প্রবাসী ছেলের বউকে কীভাবে শাশুড়ি এবং তার সহযোগীরা হেনস্থা করেছিলেন তা আরো একবার বিশদে বলার অর্থ হয় না৷ এমন ঘটনা বহু ঘটে৷ কিন্তু করোনাকালে এ ধরনের ঘটনা, সহিংসতার চরিত্র যেন একটু বেশিই ভয়াবহ৷
উদাহরণ দেওয়া যায় আরো৷ শুধুমাত্র কলম্বিয়ায় করোনাকালে পারিবারিক হিংসা বেড়েছে ৫০ শতাংশ৷ নারীদের খুন করার পরিমাণ ভেনেজুয়েলার বেড়েছে ৬৫ শতাংশ৷ মেক্সিকোয় পুলিশের ইমার্জেন্সি কলের সংখ্যা বেড়েছে ৫০ শতাংশ৷ আফ্রিকায় বেড়েছে মেয়েদের উপর নির্যাতন৷
প্রশ্ন হলো, কেন বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা? কেন এই সহিংসতা? মোহিত রণদীপের বক্তব্য, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হওয়ার অনেক কারণ আছে৷ কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তাহীনতা৷ কাজের নিরাপত্তা, খাদ্যের নিরাপত্তা, সুস্থ সমাজের নিরাপত্তা-- এই বিষয়গুলি যে কোনো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে৷ করোনার সময় গোটা বিশ্ব জুড়ে দুইটি বিষয় নিয়ে মানুষ অত্যধিক রকমের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ এক বেঁচে থাকার অধিকার এবং দুই কাজের অধিকার৷
মোহিতের সঙ্গে একমত আরও অনেক মনস্তত্ত্ববিদ৷ তাঁদের বক্তব্য, গত একশ বছরে মানুষ বিশ্ব জোড়া মহামারি বা প্যানডেমিক দেখেনি৷ রোগ হলে তার প্রতিকার আছে, এই ধারণা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে৷ রোগ আছে, কিন্তু ওষুধ নেই এই ভাবনাটিই এক চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে৷ তার উপর লকডাউনের কারণে মানুষ কাজ হারাতে শুরু করেছেন৷ প্রথম বিশ্বে তাও কাজের নিরাপত্তা আছে৷ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে সেটুকুও নেই৷ ফলে মানুষ দিশাহীন হয়ে পড়েছে৷ কাজ হারানো মানুষ বুঝতে পারছেন না কীভাবে সংসার চলবে৷ যাঁদের কাজ আছে, তাঁরা বুঝতে পারছেন না আগামীকাল তা থাকবে কিনা৷ এই পুরো বিষয়টি মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলছে৷ মানুষ মানসিক ভাবে হিংস্র হয়ে উঠছে৷ একই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। গত প্রায় পাঁচ মাসের তথ্য সে কথাই খাতায় কলমে স্পষ্ট করছে৷
আবার বলছি, অপরাধ আগে ছিল না এমন নয়৷ কিন্তু অপরাধের চরিত্র বদলেছে গত তিন-চার মাসে৷ বেড়েছে সংখ্যায়৷ যত দিন যাবে, নিরাপত্তাহীনতা যত বাড়বে সংখ্যাও বাড়তে থাকবে৷ এটাই মনুষ্য সমাজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি৷