বুধবার ইরানের এক সামরিক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঘোষণার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পারস্য উপসাগরে মার্কিন নৌবাহিনীকে প্রয়োজনে পালটা আঘাতের নির্দেশ দিয়েছেন৷ চলতি মাসে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে উত্তেজনা আবার বাড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ নিজ দেশে করোনা সংকট সামলাতে ব্যস্ত৷ এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধ শুরু হয়েছে৷ মার্কিন সেনাবাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, চলতি মাসের শুরুতে ইরানের ১১টি জাহাজ পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরি ও উপকূল সুরক্ষা বাহিনীর জাহাজের খুব কাছে এসে পড়েছিল৷ সে সময়ে মার্কিন বাহিনী আরব সাগরে আন্তর্জাতিক জলসীমানার মধ্যে এক মহড়া চালাচ্ছিল৷
এর মধ্যে ইরানের রেভোলিউশনারি গার্ডস বাহিনী বুধবার জানিয়েছে যে, সে দেশ এই প্রথম এক সামরিক স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠিয়েছে৷ কোনো গোপন মরুভূমি এলাকা থেকে ‘নুর ১' নামের এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়েছে৷ সেটির সাফল্য সম্পর্কে সংশয় সত্ত্বেও ওয়াশিংটন ইরানের মহাকাশ কর্মসূচিকে সার্বিকভাবে সন্দেহের চোখে দেখে৷ অ্যামেরিকার ধারণা, এর মাধ্যমে তেহরান গোপনে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নতির চেষ্টা করছে৷ চলতি মাসে এমন সব পদক্ষেপকে প্ররোচনা হিসেবে গণ্য করে পালটা প্রস্তুতি নিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷
উল্লেখ্য, ২০১৬ ও ২০১৭ সালেও সমুদ্রের বুকে দুই দেশের মধ্যে এমন সংঘাতের আশঙ্কা দেখা গিয়েছিল৷ ইরানের জাহাজ খুব কাছে এসে পড়ায় মার্কিন রণতরি সতর্ক করতে শূন্যে গোলাগুলি চালিয়েছিল৷ তবে সাম্প্রতিক কালে পারস্য উপসাগরে এমন ঘটনা আর ঘটেনি৷ বছরের শুরুতে ইরাকের ভূখণ্ডে দুই দেশের মধ্যে একাধিক সংঘাত ঘটেছে৷
এমন প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বুধবার এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, ইরানের কোনো সামরিক জাহাজ মার্কিন নৌবাহিনীর হয়রানি করলে সেটির উপর হামলা চালানো হবে৷ তিনি এই মর্মে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন৷
পরে অবশ্য তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মার্কিন বাহিনীর আচরণে নতুন কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না৷
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের ফলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ মার্কিন উপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ডেভিড নরকুইস্ট বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তেহরানকে সতর্ক করে দিতে এমন মন্তব্য করেছেন৷ তাঁর মতে, আত্মরক্ষার তাগিদে এমনিতেই মার্কিন নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার অধিকার রয়েছে৷
ইরানের সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, মার্কিন সেনাবাহিনীকে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচানোর কাজে মনোযোগ দেওয়া উচিত৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, ডিপিএ, এপি)
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
একটা সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল ইরান৷ সেখান থেকে চিরশত্রুতায় রূপ নিয়েছে তাদের সম্পর্ক৷ কীভাবে এই মেরুকরণ ঘটল দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: gemeinfrei
ইরানের সরকার উৎখাত
১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক৷ তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে দেশটির তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেন৷ ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স এবং এবং মার্কিন সিআইএ ক্যু ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে উৎখাত করে৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
শাহের ক্ষমতা আরোহন
মোসাদ্দেকের পতনের পর ক্ষমতায় ফেরেন ইরানের নির্বাসিত শেষ সম্রাট রেজা শাহ পাহলভি৷ পরবর্তী দুই দশক ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব৷ এক পর্যায়ে মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয় পারস্য উপসাগরের দেশটি৷ যুক্তরাষ্ট্রের কোন অনুরোধই এসময় ফেলেননি শাহ, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার৷
ছবি: gemeinfrei
ইসলামী বিপ্লব
শাহের আমলে ইরানের তেল ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ ও অ্যামেরিকান কোম্পানিগুলোর৷ ইরানি জনগণের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে৷ ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন রেজা শাহ পাহলভি৷
ছবি: Getty Images/Afp
খোমেনির ফেরা
দুই সপ্তাহ পর দেশে ফেরেন নির্বাসিত নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনি৷ তিনি ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবের’ নেতৃত্ব দেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই দেশটির ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে৷ ৪৪৪ দিনের জন্য বন্দী হয় ৫২ অ্যামেরিকান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP/G. Duval
প্রথম অবরোধ
বন্দী সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার৷ দেশটিতে মার্কিন পণ্য রপ্তানি ও তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়৷ জব্দ করা হয় ইরানের ১২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ৷ বের করে দেয়া কূটনীতিকদের৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ইরাক-ইরান যুদ্ধ
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইরান আক্রমণ করে সাদ্দাম হুসেন৷ যুদ্ধ চলাকালে ইরাককে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, অর্থ, সামরিক প্রযুক্তি এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এই যুদ্ধ চলে আট বছর৷ এসময় লেবাননে ইরানের সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর হামলায় বৈরুতের একটি ব্যারাকে ২৪৪ অ্যামেরিকান নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/Bildarchiv
ইরানের বিমানে হামলা
১৯৮৮ সালে পারস্য উপসাগরে ইরানের একটি যাত্রিবাহী বিমানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র৷ নিহত হয় ইরানের ২৯০ জন যাত্রী৷ একে দুর্ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান৷ এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক আরও তিক্ততায় রূপ নেয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Taherkenareh
নতুন অবরোধ
ইরান সন্ত্রাসীদের মদত দেয়ার পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, এমন অভিযোগে দেশটিকে একঘরে করার জন্য প্রচার চালায় ক্লিনটন প্রশাসন৷ ১৯৯৬ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ইরানে বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন৷
ছবি: AP
সম্পর্ক সহজীকরণ
১৯৯৮ থেকে পরবর্তী দুই বছর মোহাম্মদ খাতামি সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ প্রকাশ করে ক্লিনটন প্রশাসন৷ এজন্য রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়৷ খাতামি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রস্তাব দেন৷ ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়৷
ছবি: AP
পরমাণু আকাঙ্ক্ষা
২০০৫ সালে আহমদিনেজাদের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের আবারও অবনতি ঘটে৷ ইরান এসময় পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে৷ বুশ ইরানকে সন্ত্রাসের রপ্তানিকারক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন৷ তবে ২০১৫ সালে ওবামা যুক্তরাষ্ট্র ও জোট রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তিতে বৈরিতার সেই বরফ কিছুটা গলে৷
ছবি: AP
যুদ্ধের দামামা
২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমানু চুক্তি বাতিল করে ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ওয়াশিংটন৷ দুই দেশের প্রক্সি ওয়ার অনেকটাই যুদ্ধাবস্থায় রূপ নিয়েছে চলতি বছরের তিন জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জেনারেল কাসিম সোলেইমানিকে হত্যার পর৷